বিজ্ঞান ব্লগ

অর্কিড নিয়ে যত কথা এবং অন্যান্য আলোচনা

ফুলের রাজ্যে অর্কিড এক অনিন্দ সুন্দর বস্তু।উজ্জ্বল,আশ্চর্য ও অদ্ভুত সুন্দর এ অর্কিডগুলো প্রাচীনকাল থেকেই নানা রহস্যের জন্ম দিয়ে চলেছে।

বেলজিয়ামের প্ল্যান্ট কালেক্টর গোস্ট অর্কিডকে প্রথম কিউবার জঙ্গলে আবিষ্কার করার পর থেকেই একে ঘিরে জেগে ওঠে নানান লোকের অদ্ভুত সব শখ ও সংগ্রহের বাতিক।এরপর এটি উঠে আসে নানা  খবর,জার্নাল,বিখ্যাত ব‌ই এমনকি ভ্রমন কাহিনীতেও।আর এই নেশায় মাতোয়ারা লোকেরা মিলে গড়ে তোলে অর্কিড সোসাইটি বা ক্লাবের মতো সংগঠন,যেখানে শুধু অর্কিড নিয়েই চর্চা হয়।তবে “অর্কিড” নামকরণটি করেন উদ্ভিদবিজ্ঞানের জনক থিওফ্রাস্টাস  এবং এ  শব্দটি গ্রীক শব্দ ‘অর্কিস’ থেকে নেওয়া।যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় “অণ্ডকোষ”। ইউরোপীয় অনেক স্থলজ অর্কিডের গোড়ায় অণ্ডকোষ সদৃশ দু’টি গঠন দেখা যায় বলেই হয়তো এমন নামকরণ।

বর্তমান পৃথিবীতে ৩৫ হাজারের‌ বেশি প্রজাতির অর্কিড আছে।প্রজাতি ভেদে এদের ফুলের গঠন, আকার, আকৃতি এবং বর্ণে অনন্য বৈচিত্র ও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।পৃথিবীর সব মহাদেশেই একে দেখা যায় যার সিংহভাগ  পরাশ্রয়ী,তবে ভূমিজ ও মৃতজীবী প্রজাতিও আছে। 

অর্কিড তার সৌন্দর্য,অপূর্ব রং,সুবাসে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি বিচিত্র এর ব্যবহার।প্রাচীন চীনা গ্রন্থে তিন হাজার বছর আগে প্রথম একে ঔষধি উদ্ভিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।সম্প্রতি কিছু গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, ভ্যানিলার ফ্লেভার কেমোথেরাপি  দেওয়া রোগীদের খাদ্য গ্রহণ বৃদ্ধি করে এবং অবসাদ দূর করে বমি বমি ভাব থেকে মুক্ত করে।গবেষক ফ্ল্যাডবাই ও তার সহকারীরা প্রমাণ করেছেন,আলজেইমার রোগ সনাক্তকরণে ভ্যানিলা ব্যবহার করা যায়।এছাড়াও অনেক অর্কিড মাথা ব্যাথা দূরীকরণে, বিষাক্ত পোকার দংশনে উপশম হিসেবে এবং পেটের পিড়ায় ওষুধ হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে।

কোন অর্কিডই বিষাক্ত নয় জানার পর খাদ্য ও পানীয় হিসেবেও সম্প্রীতি এর ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।জীববিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, আফ্রিকানরা প্রায় ৭৭ প্রজাতির অর্কিড খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।এ ক্ষেত্রে Disa, Habenaria এবং Satyrium গণভূক্ত অর্কিড বেশি ব্যবহৃত হয়।সুস্বাস্থ্যের আশায় নেপালে কিছু প্রজাতির অর্কিড ফুলসমূহ শুকিয়ে চায়ের সঙ্গে খাওয়া হয়। হাওয়াই দীপপুঞ্জে অর্কিড বিভিন্নভাবে খাদ্য হিসেবে প্রচলিত‌।বিশেষ করে খাদ্য ভান্ডার, ডেকোরেশনে এবং খাবার প্লেটে ডেকোরেশনে বিভিন্ন হোটেলে ও রেস্তোরাঁয় এর কদর অনেক।এছাড়াও খাদ্যের ডিশে এটি সালাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

অপূর্ব এই ফুলের বিভিন্ন প্রজাতি,বিভিন্ন দেশে,জাতীয় ফুল হিসাবে সম্মান পেয়েছে। অদ্ভুত সুন্দর এই ফুলগুলোর মতো অপরুপ সৌন্দর্য আর হয়না বিধায় এ  খুবই দামি।চলুন দেখে আসা যাক এমনি কিছু অর্কিড।

 

মাঙ্কি ফেইস অর্কিড (Dracula Simia):

এই ফুলটি দক্ষিণ আমেরিকায় বেশি দেখা যায়। সব ঋতুতে ফোটে এবং এই ফুলটির ঘ্রাণ পাকা কমলার মত।সাধারণত বাদরের মুখের মতো দেখতে হ‌ওয়ায় এটিকে মাঙ্কি ফেইস  নামে ডাকা হয়।


নেকেড ম্যান অর্কিড(Orchis italica):

এ ফুলটি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অনেক দেশে দেখা যায়। ছোট্ট অর্কিডে গুচ্ছ ফুল হয়। আর প্রতিটি ফুল দেখলে মনে হয়, যেন খালি গায়ের কোনো পুরুষ মানুষ। সাধারণভাবে এটিকে ন্যাকেড ম্যান অর্কিড (naked man orchid ) বা ইটালিয়ান অর্কিড (Italian orchid) ডাকা হয়।



হুকার’স লিপস (Psychotria Elata):

লাল টুকটুকে ঠোঁট দুটি যেন চুম্বনের অধীর অপেক্ষায়। এটি Psychotria বর্গের ১৮৫০ টি প্রজাতির একটি।ল্যাটিন আমেরিকার রেইনফরেস্টে এই ফুল পাওয়া যায়।ঠোটের মতো দেখতে এটি হট লিপস নামেও পরিচিত। 


লাফিং বাম্বল বি অর্কিড (Ophrys bomybliflora):

এটি দক্ষিণ আফ্রিকা,ইউরোপ,ক্যানারি আইল্যান্ড, তুর্কিমেনিস্তানে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।দেখতে অনেকটা পতঙ্গের হাসির মতো বলেই এর এই রকম নাম। 


কাডলিং বেইবিজ (Anguloa Uniflora):

ফুলগুলোকে দেখলে মনে হয় কাঁথায় মুড়ানো আদুরে বাচ্চাসব।মূলত তাদের এ লুকের কারনেই সবাই একে কাডলিং বেইবিজ নামেই চেনে।


প্যারট (Impatiens Psittacina):

ফুলগুলোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের তোতাপাখি নাম হওয়ার কারণ। মায়ানমার,থাইল্যান্ডে এই প্রজাতির ফুলগুলো প্রথম পাওয়া যায়।



ব্যালেরিনা অর্কিড (Ballerina Orchid):

যেন কোন ব্যালেডেন্সার তার নাচের মুদ্রায় তন্ময় হয়ে আছে। এটিও অর্কিড জাতীয় ফুল।



ফ্লায়িং ডাক অর্কিড (Caleana Major):

এই  জাতীয় ফুলগুলো প্রথম পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায়। দেখে মনে হয় যেন পাতি হাঁস উড়ছে।


হোয়াইট ইগ্রেট অর্কিড (Habenaria Radiata):

চীন,জাপান,কোরিয়া এইসব অঞ্চলে এই ফুলটির দেখা মেলে। দেখে মনে হয় যেন সাদা বক উড়ে যাচ্ছে।


ক্যান্ডি স্কাল (Antirrhinum):

এটি আসলে ফুল না।এটি এন্টিরাইনাম ফুলের ঝরে যাওয়ার পর বৃতি।দেখলে মনে হয় যেন কংকাল ঝুলে আছে।


ডেন্সিং গার্ল ( Impatiens bequaertii):

এটি পূর্ব আফ্রিকার চিরহিরৎ বনের।এ বনে প্রায় সারাবছরই বৃষ্টি হয় আর তাতে গাছ,তার পাতা আর লতাগুল্ম থাকে সবুজ,সতেজ।  স্থানীয়ভাবে অর্কিডটিকে ড্যান্সিং গার্ল অর্কিড (Dancing Girl) ডাকা হয়।


ঘুঘু অর্কিড(Peristeria elata):

এটি দেখতে অনেকটা ঘুঘুর মতো বিধায় এর এমন নাম।অদ্ভুত সুন্দর এ ফুলটি পানামার জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে।


ব্লিডিং হার্ট ফ্লাওয়ার (Lamprocapnos spectabilis):

এই ফুলগুলো সাধারণত লাল রংয়ের হলেও আরও কয়েক রং-এর হয়। তবে, আকৃতিটা হয় এমন,যেন হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে,তাই এটাকে ব্লিডিং হার্ট বলে ডাকা হয়।


ড্যান্সিং লেডি অর্কিড(Oncidium):

হলুদ এ ফুলটির আকৃতির কারণে এই ধরনের নামকরণ করা হয়।ফুলের উপরে ছোট অংশ এবং নিচে বড় অংশ নাচের আকৃতি প্রকাশ করে।এই ফুলগুলো দক্ষিণ আমেরিকা,মধ্য আমেরিকা ও মেক্সিকো এর গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বেড়ে ওঠে।  

এগুলো পড়তে ভুলবেন না!

“১৯৬” : যে সংখ্যা কাজী নজরুল ইসলামের মতই বিদ্রোহী!

গ্র্যান্ডির সিরিজ: একটি রহস্যময় সিরিজের গল্প


হ্যাপি এলিয়েন ফ্লাওয়ার(Calceolaria uniflora):

দক্ষিণ আমেরিকার গরমকালে এই ফুলগুলো দেখতে পাওয়া যায়। এর উচ্চতা ২ ইঞ্চি হয়ে থাকে। সাধারণত কমলা এবং হলুদের সম্বনয়ে হয়ে থাকে।চার্লস ডারউইন তাঁর দক্ষিণ আমেরিকায় সমুদ্রযাত্রার সময় আবিষ্কার করেন অদ্ভুত সুন্দর এই ফুলটি। তাঁর নামানুসারে ফুলটির নাম দেওয়া হয় ডারউইন’স স্লিপার ফ্লাওয়ার বা হ্যাপি এলিয়েন ফ্লাওয়ার

ব্ল্যাক ব্যাট ফ্লাওয়ার(Tacca chantrieri):

কালো এই ফুলটি থাইল্যান্ড,ভারত,মালয়েশিয়া এবং পূর্ব এশিয়া দেখতে পাওয়া যায়।এই ফুলটি কালো রং ছাড়াও ব্রাউন,সবুজ এবং মেরুন হয়ে থাকে। সাধারণত রঙের কারনেই এর এমন নাম।

 

Exit mobile version