বিজ্ঞান ব্লগ

আব্বাস ইবনে ফিরনাসঃ আকাশে ওড়া প্রথম মানব

ইতিহাসে প্রথম সফলভাবে আকাশে ডানা মেলেছিলেন যিনি তিনি হচ্ছেন আব্বাস ইবনে ফিরনাস। তিনি ৯ম শতাব্দীতে উমাইয়া খিলাফতের সময় স্পেনের আন্দালুসিয়ার একজন পলিম্যাথ বা বহুশাস্ত্র বিশারদ ছিলেন।
তার উড্ডয়ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ফিলিপ কে. হিট্টি তার হিস্ট্রি অব আরব গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “ইবনে ফিরনাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি আকাশে ওড়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন বৈজ্ঞানিকভাবে।

ইবনে ফিরনাসের পরিচয়:

আব্বাস ইবনে ফিরনাসের পুরো নাম আব্বাস আবু আলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি। তার জম্ম ৮১০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মুসলিম জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র স্পেনে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, কবি, সুরকার, পদার্থবিদ, সঙ্গীতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

ইবনে ফিরনাসের উড্ডয়ন প্রচেষ্টা:

ইবনে ফিরনাসের উড্ডয়ন প্রচেষ্টার বিস্তারিত পাওয়া যায় ঐতিহাসিক আল মাকারির লেখায়।

ইবনে ফিরনাসের উড্ডয়ন প্রসঙ্গে মন্তব্য পাওয়া যায় সমসাময়িক কর্ডোবার আমির প্রথম মুহাম্মদের রাজকবি মুমিন ইবনে সাইদের কবিতায়। ইবনে সাইদ ফিরনাস সম্পর্কে কবিতায় লিখেন, “শকুনের পালক দ্বারা আবৃত হলে তিনি ফিনিক্সের চেয়েও দ্রুত ওড়েন।

ইবনে ফিরনাস তার উদ্ভাবিত উড্ডয়ন যন্ত্রে পালক ও সিল্কের ব্যবহার করেছিলেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তিনি স্পেনের কর্ডোবার নিকটবর্তী রুসাফা এলাকার আরুস পর্বত থেকে তার উদ্ভাবিত উড্ডয়নযন্ত্র সহকারে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

কর্ডোবা থেকে অনেক মানুষ তার আকাশে ওড়া দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিলেন। ইবনে ফিরনাস তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এখান থেকে ওড়ার পর যদি সব ঠিক থাকে তবে আমি এখানেই আবার ফিরে আসব। তার উড্ডয়নযন্ত্র সফলভাবেই কাজ করে এবং প্রায় দশ মিনিট তিনি তার যন্ত্রের সাহায্যে উড়তে সমর্থ হন। কিন্তু সফলভাবেউড়লেও তিনি একটু ভুল করেছিলেন।

আল মাকারি উল্লেখ করেন, তিনি তার শরীরকে পালক দ্বারা আবৃত করেন এবং তার শরীরে কয়েকটি পাখা যোগ করেন। তারপর শূন্যে ভেসে পড়েন।
যারা তার এই উড্ডয়ন প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের লেখনীতে পাওয়া যায়, তিনি পাখার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দূরত্ব অতিক্রম করেন এবং যেখান থেকে উড্ডয়ন শুরু করেছিলেন আবার সেখানে ফিরে আসেন।
কিন্তু সফলভাবে অবতরণ করতে ব্যর্থ হন। এ সময় তিনি গুরুতর আহত হন।
ইবনে ফিরনাস প্রাণে বেঁচে গেলেও তার দুই পা ভেংগে যায়। তার বয়স তখন সত্তর বছর। এরপর তিনি তার উড্ডয়নযন্ত্রে ঠিক কী ভুল ছিল তা শনাক্তকরনে মনোনিবেশ করেন। তিনি উপলদ্ধি করেন, পাখি অবতরণের সময় লেজ এবং ডানাগুলোর সমন্বিতভাবে কার্যক্ষমের মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ করে।
কিন্তু তিনি তার যন্ত্রে গতি কমানোর জন্য সেরকম কোনো লেজ বা বিকল্প পদ্ধতি রাখেননি।

তারপরেও তিনি প্রায় ১২ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার পক্ষে আর আকাশে ওড়া সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি আর আগের মতো সুস্থতা লাভ করেননি। ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইবনে ফিরনাস ইন্তেকাল করেন।

অন্যান্য উদ্ভাবন:
আকাশে ওড়া ছাড়াও ইবনে ফিরনাস বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণা করতেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পানির শক্তিতে চলা ঘড়ি। বালি ও স্ফটিকের প্রকৃতি জানতে এ দুটি বিষয়েও ছিল তার গবেষণা। অনেক ইতিহাসবিদ স্বচ্ছ কাচ তৈরির কৃতিত্বও দেন তাকে।

বিখ্যাত আন্দালুসিয়ান কাঁচ তৈরির নেপথ্যেও ইবনে ফিরনাসের নাম বলেন অনেকে। যে কাঁচ এখনো ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ক্ষীণদৃষ্টি শক্তির মানুষদের জন্য যে চশমা ব্যবহৃত হয় সেই কাঁচ আবিষ্কারের পেছনেও রয়েছে তার দীর্ঘ গবেষণা।

ইবনে ফিরনাস ছিলেন উত্তর আফ্রিকার বারবার বংশোদ্ভূত। তার নামের মূল শব্দ আফেরনাস, যে নামটি বর্তমান সময়েও মরক্কো ও আলজেরিয়ায় বহুল প্রচলিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে এই বিখ্যাত দার্শনিকের নামে অনেক বিমানবন্দর, সেতু, পর্বতের চূড়া, পার্ক, সড়ক ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে।

ইরাকের বাগদাদ এয়ারপোর্টের কাছে রয়েছে তার একটি বিশাল ভাস্কর্য। স্পেনের কর্ডোভায় গুয়াদেলকুইভার নদীর ওপর ব্রিজটির নামকরণ করা হয়েছে এই দার্শনিকের নামে।

Exit mobile version