বিজ্ঞান ব্লগ

আবদুস সাত্তার খান: যুগ বদলে দেওয়া ৪০ টিরও বেশি সংকর ধাতুর আবিষ্কারক যিনি

একটি দেশের মেরুদণ্ড হচ্ছে শিক্ষা। যা দাঁড়িয়ে থাকে সেই দেশের বুদ্ধিজীবী ও মেধাবী সন্তানদের কাধের উপর ভর দিয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বহু মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করে পাকিস্তানি বাহিনী।

সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া একজন মানুষ হলেন আবদুস সাত্তার খান, আমাদের গর্ব। যাকে হয়তো বা আমরা চিনি না, যদিও চেনা আমাদের দায়িত্ব ছিলো।

আব্দুস সাত্তার খান বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত মহাকাশ গবেষক। নাসা, ইউনাইটেড টেকনোলজিস এবং অ্যালস্টমে কাজ করার সময়ে ৪০টিরও বেশি সংকর ধাতু উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানী আব্দুস সাত্তার। এই সংকর ধাতুগুলো ইঞ্জিনকে আরো হালকা করেছে, যার ফলে উড়োজাহাজের পক্ষে আরো দ্রুত উড্ডয়ন সম্ভব হয়েছে এবং ট্রেন হয়েছে আরো গতিশীল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য জন্য তিনি নাসা, আমেরিকান বিমানবাহিনী, ইউনাইটেড টেকনোলজি এবং অ্যালস্টম থেকে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন।

আবদুস সাত্তার খান

১৯৪১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নবীনগর উপজেলার খাগাতুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুস সাত্তার খান। ৮ বছর বয়সেই তার বাবা মারা যান। তিনি বড় হন নানার বাড়িতে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা অর্জন সহজ ছিলো না। কিন্তু তিনি তার শিক্ষকদের নিষ্ঠার কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, “পড়া শেষের পর মুখস্থ বলতে পারলে পুরস্কার থাকতো জাম্বুরার বল। আগে জ্ঞানঅর্জন, তারপর খেলা – এই ছিলো মূলমন্ত্র।”

রতনপুর উচ্চ বিদ্যালয় এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেন তিনি। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগ থেকে ১৯৬২ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।১৯৬৪ সালে তিনি স্কলারশিপে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে যান এবং ১৯৬৮ সালে রসায়নের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ধাতব প্রকৌশল নিয়ে গবেষণা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার কিছু কাল পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা গনহত্যায় তিনি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পাকিস্তানিরা তার রুমে আসলে তিনি লুকিয়ে পড়েন এবং পাকিস্তানী বাহিনী রুম চেক না করেই চলে যায়।

১৯৭৬ সালে তিনি যোগ দেন নাসা লুইস রিসার্চ সেন্টারে। এখানে তিনি রকেট ইঞ্জিনে ব্যবহৃত সংকর ধাতু নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি উচ্চ শক্তি সম্পন্ন এক ধরণর নিকেল ভিত্তিক সংকর ধাতু (high strength nickel based alloys) উদ্ভাবন করেন। এই সংকর ধাতু ব্যবহারে ইঞ্জিনের জ্বালানি দক্ষতার অভূতপূর্ব বৃদ্ধি ঘটে। তার এই আবিষ্কারের জন্যে তিনি ১৯৮৬ সালে “United Technologies Special Award” অর্জন করেন। পরবর্তীতে উন্নত বিমান ইঞ্জিন তৈরিতে এটি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

পরবর্তীতে তিনি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জ্বালানী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আলস্টমে যোগ দেন। এখানে তিনি দ্রুত গতির ট্রেনের উচ্চতর দক্ষতা সম্পন্ন ইঞ্জিনের জন্য সংকর ধাতু তৈরিতে গবেষণা করেন।

আবদুস সাত্তার খান তার পুরো কর্মজীবনে চল্লিশটির ও বেশি সংকর ধাতু উদ্ভাবন করেছেন। জেট ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশে কিংবা অন্যান্য বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত, গ্যাস টারবাইন তৈরিতে উচ্চতর তাপসহিষ্ণু এইসব সংকর ধাতু পরিবেশ বান্ধব এবং টেকসই হওয়ায় এদের ব্যবহার বহুল প্রচলিত এবং বিস্তৃত।

বাণিজ্যিকভাবে এইসব সংকর ধাতু ব্যবহৃত হয় স্পেস শাটলে ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর বিভিন্ন ধরণের বিমান তৈরিতে। তার উদ্ভাবিত এইসব সংকর ধাতুর আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এদের স্বল্প ভর। এসকল সংকর ধাতু দ্বারা তৈরি বিমান ইঞ্জিনগুলি হালকা হওয়ায় তা বিমানকে এবং ট্রেনকে আরও দ্রুত গতিসম্পন্ন করে তোলে।

তিনি ছিলেন ৩১টি প্যাটেন্টের অধিকারী। তার প্যাটেন্ট সমূহ দেখুন: এখানে

তার অবদানের জন্য তিনি নাসা, আমেরিকান বিমানবাহিনী, ইউনাইটেড টেকনোলজি এবং অ্যালস্টম থেকে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ব্রিটেনের রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির একজন পেশাদার রসায়নবিদ এবং নির্বাচিত ফেলো। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি থেকে ফেলো নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্য থেকে পেশাজীবী বিজ্ঞানী হিসেবে রয়েল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি থেকে স্বীকৃতি পান এই মহান বিজ্ঞানী।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব মেটালসেরও সদস্য। ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান এফ-১৫এফ-১৬-এর ইঞ্জিনের জ্বালানি খরচ কমানোয় বিশেষ অবদান রাখার জন্য পান ইউনাইটেড টেকনোলজিস স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড। ১৯৯৪ সালে পান উচ্চগতিসম্পন্ন জেট বিমানের ইঞ্জিন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে অবদানের জন্য ‘ইউনাইটেড টেকনোলজিস রিসার্চ সেন্টার অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স’ পদক। ১৯৯৩ সালে অর্জন করেন ‘প্রাট অ্যান্ড হুইটনি’র বিশেষ অ্যাওয়ার্ড।
পেশাদার বিজ্ঞানী থেকে অবসর গ্রহণের পর আবদুস সাত্তার ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের গবেষক ও  অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে কাজ করার সময় কার্বন ন্যানো টেকনোলজি-সম্পর্কিত বস্তুগত বিজ্ঞান ও জৈব রাসায়নিক প্রযুক্তির প্রয়োগের ওপর একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

আবদুস সাত্তার খান যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ফ্লোরিডায় বাংলাদেশি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং এশিয়ানদের স্থানীয় সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রলয়ংকরী বন্যার সময় তিনি ৬১ হাজার ডলার সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠান।

২০০৮ সালের ৩১ জানুয়ারি এই মহান বিজ্ঞানী ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

Exit mobile version