২য় পর্বের পর থেকে…
বিদেশ বিভূঁইয়ে একটি সম্মানজনক জীবিকা, আর সম্মানজনক অবস্থান পেলে কেই-বা চাইবেন এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে? কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামের মতো দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা এই সুযোগ আর বিলাসিতাকে পাত্তা দেন না। তাঁরা সুযোগ পেলেই নিজেকে নিয়োজিত করেন দেশের সেবায়।
তাই জামাল নজরুল ইসলাম সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফিরবেন। কিন্তু দেশে ফিরার সিদ্ধান্ত নেয়া আর তা বাস্তবায়ন করা এতোটা সহজ ছিলোনা মোটেও। জামাল নজরুল ইসলাম তার এক লেখায় নিজেই বলেছেন, তার পক্ষে দেশে ফিরে আসা সম্ভব হবার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার পরিবারের শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তি।
দেশে ফেরার পরেও তাঁকে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। আচ্ছা! এই মুহূর্তে যদি কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানী এসে তৃতীয় বিশ্বের কোনো এক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার আগ্রহ পোষণ করেন, তবে আমরা নিশ্চয়ই উনার যা ডিমান্ড তাতেই রাজি হয়ে যাবো অনায়াসে। তাতে আমার অন্তত সন্দেহ নেই। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম ঘরের ছেলে। তাই তাঁকে একটু অবজ্ঞার সাথে মূল্যায়ন করতেই পারি! তাই নয় কি?
জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৮১ সালে দেশে এসে যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক পদে। ১৯৮১ সালের দিকে দেশে ফিরে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় তার বেতন ছিল আটাশ শ’ টাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট কিছুতেই রাজি হয়নি তাকে তিন হাজার টাকা বেতন দিতে। এই বেতনেই তিনি অধ্যাপনা করে যান। এখানে এক বছর অধ্যাপনা করার পর গবেষণার কাজে এবং পারিবারিক প্রয়োজনে আবার লন্ডনে ফিরে যাবার প্রয়োজন দেখা দেয় তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণার জন্য বাইরে গেলে কর্তৃপক্ষ ছুটি প্রদান করে এবং ফিরে আসা পর্যন্ত চাকরি বলবৎ থাকে। এর জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটির আবেদন করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দিচ্ছিল না। উপায় না দেখে চাকরি ছেড়ে চলে যান তিনি। দুই বছরে সেখানে তার গবেষণা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে তিনি সেখানকার বাড়ি-ঘর বিক্রি করে স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসেন। এরপর অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বেতন বাড়িয়ে তিন হাজার টাকায় উন্নীত করে আর মাঝখানের সময়টিকে শিক্ষা ছুটি হিসেবে গ্রহণ করে।
দেশের মাটিতে তার ভোগান্তি এত অল্প ছিল না অবশ্যই। পরিস্থিতি কেমন নেতিবাচক ছিল সে সম্পর্কে একটু ধারণা পাওয়া যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এম হারুন অর রশিদের একটি লেখায়। হারুন অর রশিদ নিজেও অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব। জামাল নজরুল ইসলাম ও হারুন অর রশিদের মাঝে ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। অধ্যাপক ইসলামের মৃত্যুর পর তাকে স্মরণ করে কালি ও কলম নামের এক সাহিত্য ম্যাগাজিনে তিনি লিখেছেন-
“জামালের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৮৪ সালে, যখন তিনি কেমব্রিজ থেকে চট্টগ্রামে চলে আসার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। একদিন তিনি টেলিফোনে আমাকে লন্ডন থেকে জানালেন যে, তিনি বাংলাদেশে চলে আসতে চান। আমি বলেছিলাম, এটা নিশ্চয়ই খুব ভালো সিদ্ধান্ত। তবে তিনি যদি তাঁর দরখাস্তটি অবিলম্বে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন, তাহলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে আলাপ করে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দিতে পারি।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!!
ফটোগ্রাফির অন্যতম উপকরণ: লেন্স এর যত কার্যকারিতা |
তারপর তিনি যা বলেছিলেন তা আমি শুনতে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন, তিনি ঢাকায় যাবেন না, তিনি চট্টগ্রামে যাবেন। কেননা সেখানে রয়েছে তাঁর পৈতৃক ভবন। আমি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, মনে হয় না, চট্টগ্রামে তিনি খুব ভালো ছাত্র পাবেন এবং হয়তো সেখানে তাঁর গবেষণাকর্ম ব্যাহতই হবে। কিন্তু তিনি সে-কথা মোটেই কানে তুললেন না। তাঁর কথা ছিল একটাই যে, আমি যেন তাঁর দরখাস্তটি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করি। আমি তাই করেছিলাম। এক সকালে ট্রেনে চট্টগ্রামের টিকিট কিনে চট্টগ্রাম পৌঁছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বলেছিলাম, ‘জামাল নজরুল ইসলাম এদেশের সম্পদ – তাঁকে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা আপনাদেরই সৌভাগ্য।’ উপাচার্য করিম সাহেব আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, জামাল নজরুল ইসলামের জন্য একটি অধ্যাপক পদ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অবিলম্বে সৃষ্টি করে তাঁকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে।
দুঃখের বিষয়, ঢাকায় ফিরে এসে কয়েকদিন পরে খবর পেলাম যে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পদ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। তাই কিছুদিন পরে গণিত বিভাগেই একটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তাও দ্বিতীয়বার আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ করার পর। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এবং অকুণ্ঠ সহযোগিতা অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যোগদান করতে সমর্থ হয়েছিলেন।”
জামাল নজরুল ইসলাম ত্যাগ করতে পেরেছিলেন বিদেশের বিলাসিতাকে। জামাল নজরুল ইসলাম পেরেছিলেন জন্মভূমিকে সেবা দেয়ার ব্রতকে সত্যে পরিণত করতে। আন্তরিকতা ছিলো বলেই পেরেছিলেন প্রতিকূলতাকে জয় করতে।
২০১৩ সালের ১৬ মার্চ চট্টগ্রামে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের প্রতিথযশা এই বিজ্ঞানী। জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে অনন্তকাল। (সমাপ্ত)
তথ্যসূত্রঃ 1)রোর বাংলা
2) প্রথম আলো
3) বিডি নিউজ ২৪