বিজ্ঞান ব্লগ

ইনফ্লুয়েন্সিং(Influencing) – যা আমাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়, আসলেই কি তা অসম্ভব?

আমরা বর্তমানে পোলারাইজেশনের যুগে বসবাস করছি। দাঁড়ান, দাঁড়ান, এই পোলারাইজেশন কিন্তু আবার মেরুকরণ নয়, এটা হলো আমাদের কোনো বিষয় বা সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয়ে যাওয়া (ইনফ্লুয়েন্সিং- Influencing), স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত। কিছুটা অদ্ভুতুড়ে ঠেকছে হয়ত, কিন্তু এই পুরো লেখায় আমি এটা নিয়েই আলোচনা করব, আশা করছি পুরো লেখাটায় আমি বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে সক্ষম হব।

একটু ভেবে দেখুন, ধরুন গত ৫ বছরেই, আপনার সাথে কতজন মানুষ দ্বিমত পোষণ করেছে, আর তাদের মাঝে কতজনকে আপনি আবার প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তাদের মতামতটি আবার বিবেচনা করার জন্যে? এমন অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের অনেকেরই আছে, যেখানে পারস্পারিক বোঝাবুঝির ভুলের কারণে অনেক সময় অনেক ভালো কোনো আইডিয়াও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়না, কারণ আমরা অপর পক্ষকে আমাদের মতামতটা ঠিকঠাক বুঝিয়ে নিতে পারিনা, যে কাজটা এভাবেও সম্ভব।

এই ধারা থেকে কেউই বাহিরে নয়, অনেক সময়ই আমাদেরকে এমন দলনেতা বা কর্তৃপক্ষের সাথে কাজ করতে হয়, যেখানে তারা নিজেদের সম্পর্কে অনেক বেশিই নিশ্চিত ও আত্মবিশ্বাসী থাকে, যে তারা আর কারো কোনো ভালো পরামর্শ বা মতামত গ্রাহ্যই করেনা, বা করতে চায় না। কিন্তু তাহলে কি এটা একদমই অসম্ভব, তাদের কাছে নিজের মতামত তুলে ধরা, গুরুত্ব পাওয়া? না, এই রিসার্চ আর্টিকলটির মূল লেখক, অ্যাডাম গ্র্যান্ট এর মতে, ‘একদম অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী, একরোখা, নার্সিসিস্ট ও অসহিষ্ণু ব্যক্তিকেও তার মতামত বা সিদ্ধান্ত পুনঃপর্যালোচনা করতে প্রভাবিত করা সম্ভব।

ইনফ্লুয়েন্সিং Influencing

এই রিসার্চ আর্টিকেলে তিনি এ সম্পর্কিত কিছু উপায় ও ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা আমাদেরকে সাহায্য করবে মানুষের সাইকোলজি বুঝে কার সাথে কিভাবে ডিল করব তা বুঝতে, একজন সবজান্তাকে তার শেখার সুযোগ দেখাতে, একরোখা কলিগকে তার ইগো কাটিয়ে উঠতে, আত্মকেন্দ্রিক কাউকে অন্যদের কথা ভাবতে শেখাতে, বা আপনার পরমত অসহিষ্ণু বন্ধুটিকে আপনার মতের সাথে সহনশীল হতে প্রভাবিত করতে।

স্টিভ জবসকে আমরা সবাই চিনি, বর্তমানে বহুল জনপ্রিয় অ্যাপল এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার ব্যাপারে খুবই প্রচলিত একটি কিংবদন্তী হলো, তিনি বিশ্বকে তার দূর-দৃষ্টির কাছে মাথানত করাতে পারতেন। কিন্তু, আসলে ব্যাপারটা হলো, স্টিভ জবস ও অ্যাপলের বিশ্বব্যাপী এই সাফল্যের পেছনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো টিমমেটদের তার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে নিজের সিদ্ধান্তগুলোকে পুনঃপর্যালোচনা করতে মোটিভেট করা। বলা হয়, যদি স্টিভ জবস নিজেকে এমন ইনফ্লুয়েন্সিং (Influencing) মানুষদের দ্বারা পরিবেষ্ঠিত করতে না পারতেন, যারা তার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারেন, তাহলে তিনি হয়ত প্রযুক্তিজগতে এই পরিবর্তনটা আনতে পারতেন না।

স্টিভ জবস কখনোই চাইতেন না তিনি অ্যাপলের স্মার্টফোন তৈরি করবেন, কিন্তু তার টিমের বাকি সদস্যরা তাকে বুঝিয়েছেন যেন তিনি তার সিদ্ধান্ত আবার ভেবে দেখেন, আর এরপরের গল্প আমাদের সবার জানা, এক দশক পরে আইফোন থেকে অর্জিত রেভিন্যু এর পরিমাণ ছিলো এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

আমরা সবাই-ই কমবেশি স্টিভ জবসকে নিয়ে পড়েছি, কিন্তু কতজন জানি তাদের সম্পর্কে, যারা তার মত পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিলো? কিন্তু ইনফ্লুয়েন্সিং (Influencing) খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদের সবারই শেখা ও জানা প্রয়োজন। এটা প্রমাণিত, আমাদের রেসপন্সের প্যাটার্ণ যে সবগুলো ঘটনাতেই একদম একই রকম থাকবে, ব্যাপারটা এমন নয়। তাই যদি কাউকে মোটিভেটেড করতে হয়, সেক্ষেত্রে প্রথমে আমাদেরকে তাদের আচরণগত বিষয়গুলো বুঝতে হবে, অর্থাৎ তার পার্সোনালিটি কেমন, তার পছন্দ-অপছন্দ কি, এবং সে কোন ধারায় চিন্তা করে, আশাবাদী, হতাশাবাদী নাকি বাস্তবধর্মী। নির্দিষ্ট কয়েকটা ধরণ নিয়ে এখন আলোচনা করব।

 

একজন সবজান্তাঃ 

এধরনের কারো সাথে সমঝোতায় আসার পথে অন্যতম বাঁধা হলো ইগো ও অহংকার। সবজান্তা ধরণের মানুষ ভাবে, সে নিজেই সব জানে, তার জানার কোনো বাকি বা ফাঁকা নেই। আর তাই সে মনে করে তার নেওয়া সকল সিদ্ধান্ত সঠিক। অন্য কেউ যে তার চেয়ে ভালো জানতে পারে, এই বিষয়টা তারা মেনে নিতে পারেনা। তারা আসলে জানেই না, যে তারা কি জানেনা। এবং এই ধরণের মানুষদেরকে মোটিভেটেড করতে হলে একদম প্রথমেই যা মাথায় রাখতে হবে, তা হলো ধৈর্য্য ধরা ও সরাসরি না বলা। কারণ সরাসরি বললে সে বিষয়টা তো বুঝার চেষ্টা করবেই না, বরং ডিফেন্সিভ হয়ে যাবে, মনে করবে আপনি তার সাথে শত্রুতাবশত তার ভুল ধরছেন। 

এক্ষেত্রে আপনার পদক্ষেপটা হতে পারে, তার নিজের ভুল নিজেকে ধরতে দেওয়া। তা কিভাবে? এর উপায়টা হলো, তাকে তার সিদ্ধান্তটাই লজিক্যালি এক্সপ্লেইন করতে বলা, ধাপে- ধাপে। তখন তারা দেখতে পাবে তাদের সিদ্ধান্তের ফাঁকফোকর গুলো। এবং এই সময়েই আপনি আপনার আইডিয়া গুলো দেখাতে বা বলতে পারবেন বুঝিয়ে, যে কিভাবে আপনার আইডিয়াটা এই ফাঁকফোকর গুলো ফিল আপ করতে পারবে।

একরোখা পার্সোনালিটিঃ 

যা বলেছি তা-ই হতে হবে বা একরোখা মনোভাব এই ক্ষেত্রে বেশ সমস্যার সৃষ্টি করে। এই ধরণের ব্যক্তিরা কারো কথা শুনতেও চায় না, আবার নিজেদের বক্তব্যও তারা ব্যখ্যা করতে রাজি হয়না। এক্ষেত্রে তাদেরকে ইনফ্লুয়েন্সিং (Influencing) এর উপায় হতে পারে, তাদের মাথায় নতুন আইডিয়ার বীজ বপন করে দেওয়া। 

একরোখা মানুষেরা সাধারণত বেশ যুক্তিবাদী হয়, আর তাই তাদের সামনে কোনোভাবে যৌক্তিক কোনো আইডিয়া বলা হলে তারা সাথে সাথে না বুঝতে চাইলেও যুক্তি দিয়ে বোঝানো হলে নতুন আইডিয়া মেনেও নিতে পারে।

আত্ম বিমোহিত বা নার্সিসিস্টঃ 

এবার আসি ‘নিজেই সেরা’ ভাবা মানুষদেরকে নিয়ে। তারা নিজেদেরকে নিয়ে বিমোহিত, তাদের চিন্তা অনুসারে তাদের চেয়ে চমৎকার আর কেউ হতেই পারেনা! আর নার্সিসিস্ট মানুষেরা প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে। আর তাই, তাদের সাথে সমঝোতায় আসার অন্যতম ভালো একটি মেথড হতে পারে ‘বার্গার মেথড’। এবার বলি, কি এই বার্গার মেথড।

এই মেথডের সিস্টেম হলো বার্গারের মতই, প্রথমে নিচের স্তরের বান এর মত করে প্রশংসার একটা লেয়ার, যেহেতু নার্সিসিস্ট-রা প্রশংসা পছন্দ করে, তাই এই ধাপে সে আপনার কথাগুলো পছন্দ করবে ও আগ্রহী হবে, শোনার জন্যে। এবার হলো মাঝের স্তর, প্যাটি। এই লেয়ারটা হবে ক্রিটিসিজম এর। এই সময়ে আপনি তার ভুল বা ল্যাকিংস গুলো ধরিয়ে দিবেন, আক্রমনাত্মক ক্রিটিসিজম না করে গঠনমূলক ক্রিটিসিজম করবেন। এই ধাপে অপর পক্ষ কিছুটা রুষ্ট হতে পারে, স্বাভাবিক, কারণ আপনি তার ভুল ধরেছেন। আর সেটারই পরিপূরক হলো সর্বশেষ স্তর, আবার বান, অর্থাৎ প্রশংসার লেয়ার। এইখানে আপনি আবার তার আইডিয়ার ভালো দিক গুলোয় ফোকাস করে ইম্প্রুভমেন্ট করলে আরো ভালো করার পথটা দেখাবেন, যা সেই নার্সিসিস্ট ব্যক্তিকে আবার তার সিদ্ধান্ত পুনঃ পর্যালোচনা করতে বাধ্য করবে। 

বিতার্কিক মনোভাবসম্পন্নঃ 

এরা হলো তর্ক প্রিয় মানুষ, যেকোনো সময়, যেকোনো কিছুতেই তারা তর্ক করতে ভালোবাসেন। এবং তারা যথেষ্ট যুক্তিবাদী, তাই এই ধরণের পার্সোনালিটির মানুষদের সাথে সমঝোতা করতে হলে আপনাকে অবশ্যই খুবই যৌক্তিকভাবে আপনার পয়েন্ট গুলো তুলে ধরতে হবে। এই পার্সোনালিটির মানুষদের সাথে সরাসরিই তাদের ভুল ধরা যায় বা ভুল নিয়ে কথা বলা যায়, এবং তারা নিজেরাও ক্লিয়ার-কাট কথাবার্তা বলে। যুক্তি দিয়ে যুক্তি খণ্ডন করাই তাদের সাথে সমঝোতা করার মোটামুটি সাধারণ উপায়।

খুব ইমোশনালঃ 

তারা আসলেই কিছুটা ডিফিকাল্ট সমঝোতায় আসার জন্যে, কারণ আবেগ দিয়ে চিন্তা করা মানুষকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো কঠিন। এবং তাদের সাথে ডীল করতে হলে আপনাকে আগে বুঝতে হবে তার ইমোশনের হাল-চাল। তাদেরকে মোটিভেটেড করা আবার এক অর্থে সহজ, তা হলো তাদের কাছে আস্থাভাজন হওয়া, তাদের বিশ্বাস অর্জন করা। ইমোশনাল ব্যক্তিরা যাকে বিশ্বাস করে, সাধারণত দেখা যায় তারা তাদের কথা শুনে ও বুঝার চেষ্টা করে, এই ক্ষেত্রে তাই আপনি এভাবেও চেষ্টা করতে পারেন!

এখানে কয়েকটা নির্দিষ্ট ধরণ নিয়ে কথা বললাম, অবশ্যই এর বাহিরেও আরো ভিন্ন ভিন্ন পার্সোনালিটির মানুষ রয়েছেন আমাদের আশেপাশে। কিন্তু এই কিছু টাইপ নিয়ে আলোচনার পেছনে কারণ ছিলো আপনাকে কিছুটা হলেও আইডিয়া দেওয়া, কিভাবে আপনি বিভিন্ন ধরণের মানুষকে ইনফ্লুয়েন্সিং (Influencing) এর মাধ্যমে তাদের সাথে নেগোশিয়েট বা সমঝোতা করতে পারবেন, যা হয়ত বদলে দিবে আপনি সহ হাজারো মানুষের জীবন!

 

লেখাটি একটি বইয়ের ছোট্ট অংশ থেকে ধারণা নিয়ে লেখা, যার মূল লেখক, অ্যাডাম গ্রান্ট। তিনি একজন অরগানাইজেশনাল সাইকোলজিস্ট, এবং নিউইয়র্ক টাইম নাম্বার ওয়ান বেস্ট সেলার বই, Think Again: The Power of Knowing What You Don’t Know এর লেখক। আমি চেষ্টা করেছি তার লেখার মূল ভাবটি ঠিক রেখে সহজবোধ্য বাংলায় তার বইএর একটা অংশ থেকে এই সাইকোলজিক্যাল বিষয়বস্তু গুলো তুলে ধরতে, যা আপনাকে সাহায্য করতে পারে আপনার জীবনে। লেখাটি উক্ত বইয়ের সম্পূর্ণ ভাব ধারণ করেনা।

Exit mobile version