বিজ্ঞান ব্লগ

কসমিক ল্যাট্টের গল্প-তারা এবং মহাবিশ্বের প্রকৃত রূপ

তারাদের ভাষাই হলো মহাবিশ্বের ভাষা।সবাই না বুঝলেও আমাদের জ্যোতির্বিদরা এসব আয়ত্ত করে নিয়েছেন।রাতের আকাশে কতো বিচিত্র বর্ণের তারা দেখো,দপদপ করে জ্বলা এই তারা গুলো আসলে কী বলতে চায় তোমাকে,কখনো ভেবেছো?

রাতের আকাশে খালি চোখে আমরা নীল,লাল,কমলা ও সাদা রঙের অনেক তারা দেখি।লোহার কোন দা বা ছুরি কে আগুনে দিলে দেখা যায়,এটা প্রথমে লাল তারপর হলুদাভ সাদা এবং সবশেষে নীল রঙ ধারণ করে যদিও এর অনেক আগেই লোহা গলে যায়। এ থেকে বুঝা যায়,লাল হলো সবচেয়ে শীতল এবং সাদা তারচেয়ে বেশি উত্তপ্ত এবং নীল হচ্ছে সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত অবস্থা।তারাদের ক্ষেত্রেও তাই।নীল তারাগুলো হল সবচেয়ে কনিষ্ঠ ও প্রচন্ডরকম তেজী এবং প্রচুর আলো ও শক্তি নির্গমন করে।

সাদা বর্ণের তারাগুলো মাঝ বয়সী এবং নীল তারাদের চেয়ে কম তেজী।আর সবচেয়ে দুর্বল তারা হলো লাল বর্ণের তারাগুলো,এরা অনেকটা বুড়ো এবং মৃত্যুর কাছাকাছি।এই যে দেখো,তারাদের রঙ থেকেই আমরা কত্ত তথ্য পেয়ে যাচ্ছি,তাই জ্যোতির্বিদরা বলে থাকেন যদি মহাবিশ্বকে বুঝতে চাও তবে তারাদের বুঝতে হবে কারণ নক্ষত্ররা অনেক কালের স্বাক্ষী।

আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি এবং এদের প্রত্যেকটিতে গড়ে প্রায় ১০০ বিলিয়ন করে তারা আছে।তাহলে দেখো,মোট তারার সংখ্যা দাড়চ্ছে ১ এর পর ১৯ টা ০ বসালে যা হবে তাই,মানে ১ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন নক্ষত্র বা তারা আছে আমাদের এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বে।আবার প্রতিবছর ১৫০ বিলিয়ন নতুন তারার জন্ম ও ২৭৫ মিলিয়ন তারার মৃত্যু হয়।ভাবতে অবাক লাগে,কতো বিশাল আমাদের এই মহাবিশ্ব।

এই বিশাল মহাবিশ্বের এই যে Cosmic Spectrum(গ্যালাক্সি থেকে আসা আলোক তরঙ্গ)জরিপ করার সময় আস্ট্রেলিয়ায় থাকা দুই আমেরিকান জ্যোতিপদার্থবিদ(Glazebrook ও Baldry) আচমকা একটা বিষয় বুঝে গেলেন,আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃত বর্ণ।২০০১ সালে আস্ট্রেলিয়ার 2df redshift Survey তে তারা প্রায় ২০০০০০ টি গ্যালাক্সি থেকে নির্গত মহাজাগতিক রশ্মি বিশ্লেষণ করে মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য জানতে চাচ্ছিলেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তারা বুঝে গেলেন মহাবিশ্বের প্রকৃত বর্ণ কেমন ছিলো,এখন কেমন এবং অদূর ভবিষ্যতে কেমন হবে!

এটা বলার আগে তোমাদেরকে  Color Science নিয়ে কিছু ধারণা দেওয়া যাক। sRGB হলো Standard Red Green Blue,এই পদ্ধতিতে লাল,সবুজ ও নীল রং আনুপাতিক হারে মিশিয়ে অন্যান্য কালার প্রস্তুত করা হয়।কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসে কালার কে হেক্সাডেসিমেলে প্রকাশ করা হয় যেটা হলো একটা ছয় ডিজিটের নাম্বার। একে Hex Triplet বলে।

এটা ৩ বাইটের;বাইট ১,২ ও ৩ যথাক্রমে R,G ও B।যেমনঃ আমাদের সূর্যের প্রকৃত বর্ণ হলো #FFF5F2(সাদা),অবাক হলে তাইনা? সূর্যের আসল রং কিন্তু লাল বা কমলা নয়,সাদাই।sRGB সিস্টেম অনেক জনপ্রিয় কিন্তু পুরনো।তবে অধিকতর ভালো হলো NCS(Natural Color System) যা যেকোন কালার তৈরি করে HSL(Hue,Saturation,Lightness) এর ভিত্তিতে HSV মান এর মাধ্যমে।চলো এবার আমরা ঐ প্রশ্নে আসি।

Big Bang এর মাধ্যমে স্থানকালের প্রসারণ শুরু হয়েছিল যার ফলে মহাবিশ্বের জন্ম ও বিকাশ হয়।এর ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন বছর পর মহাবিশ্বে যখন অনেক অনেক তারার জন্ম হয়  তখন তারাগুলো ছিলো প্রচন্ড তেজী,উত্তপ্ত নীল ও শক্তিশালী রশ্নি বিকিরণকারী,যা আমাদের ঐ দুই বিজ্ঞানী বুঝতে পারে এবং তারা এও বুঝে গেলেন যে সেসময় আমাদের মহাবিশ্বের বর্ণ ছিলো নীলাভ সবুজ(Turquoise)। 

কিন্তু ধীরে ধীরে বয়োবৃদ্ধির ধারায় তারাগুলো নীল থেকে লাল দানব হয়ে যাচ্ছে,মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।আমাদের বর্তমান মহাবিশ্বে লাল তারার সংখ্যাই বেশি তাই মহাবিশ্বের বর্তমান বর্ণ নীল নয় বরং নীলাভ সাদা যাকে জ্যোতির্বিদরা এখন Cosmic Latte বলে থাকেন।

অনেকেই হয়ত বলবা,মহাবিশ্ব তো কালো,অন্ধকার।হ্যাঁ তা সত্য তবে মহাবিশ্বের একটা গড় বর্ণ আছে যা আমরা হিসাব করতে পারি Cosmic Spectrum থেকে এবং এটাই বিজ্ঞানীরা করেছেন।মহাবিশ্বের বর্ণ প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।এমন সময় আসবে অদূর ভবিষ্যতে যখন বেশিরভাগ তারাগুলোর মৃত্যু হবে এবং মহাকাশ তখন ব্ল্যাকহোলে ছেয়ে যাবে।

বাকি তারাগুলো এরাই গ্রাস করে নিবে।কোন আলোই আর থাকবে না।অন্ধকারে শূণ্য মহাবিশ্ব।তাই বলাই যায় আমরা নীল থেকে লাল হয়ে কালোর দিকে যাচ্ছি।

মন খারাপ হয়ে গেল?NASA,ESA এরা নিরন্তর চেষ্টা করে আমাদেরকে কতো রঙ্গিন মহাকাশ উপহার দেয় তবে এগুলোর একটিও আসলে এমন নয়,পৃথিবীর বাইরে থেকে মহাকাশ কে মোটেও এমন দেখাবে না যেমনটা তুমি পিকচার গুলোতে দেখ।মহাকাশ থেকে মহাকাশকে বড্ড অন্ধাকার কালো,ঝাপসা ধূসর দেখাবে। Telescopic Vision আর Edited Version এ অনেক তফাৎ আছে।একই ভাবে মহাকাশ থেকে মহাকাশ দেখা আর পৃথিবী থেকে আকাশ দেখার মাঝেও অনেক অনেক তফাৎ আছে।

এবার একটা গল্প শুনো,আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃত বর্ণ Cosmic Latte নামকরণের গল্প। Glazebrook এবং Baldry এটা আবিষ্কার করার পর এই রঙের নাম কী রাখা যায় তার জন্য ভোটের আয়োজন করে।সবচেয়ে বেশি ভোট পায় Cappuccino Cosmico নামটি যা Petar Drum নামের একজন দিয়েছিলো,মজার ব্যাপার হলো এই নামটা বাদ দিয়ে ওনার দেওয়া আরেকটা নাম Cosmic Latte কে গ্রহণ করা হয়।

এই নামটা দেওয়ার সময় ওনি পেপার হাতে স্টারবাকস কোম্পানির কফি খাচ্ছিলেন(Latte)।পেপারে ভোটের আর্টিকেল পড়ার সময় পেপারে মহাবিশ্বের রং টা তার ল্যাট্টের রং এর সাথে মিলে যায়।এ থেকেই তিনি নাম দিলেন Cosmic Latte।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না!!!

গ্লাডিয়েটর: এবং কোন 2050 সাল এর ডিপ্রেসন

ইলেক্ট্রনিক্সে রেজিস্টরের গল্পসল্প (পর্ব ২)

ইলেক্ট্রনিক্সে রেজিস্টরের গল্পসল্প ( পর্ব ১ )

এছাড়াও গ্যালিলিও’র দেশ মানে ইটালিতে আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথ কে বলে via latte যার গড় কালারও এই ল্যাট্টের মতো।এত্তসব দিক বিবেচনায় এনে ৭-৮ টা নাম থেকে এই Beigewish White(অত্যন্ত হালকা হলুদাভ সাদা বাদামী ক্রিমের মত) Cosmic Latte নামটিই অবশেষে নির্বাচিত হয়।

এই রঙটার RGB মান হলো-২৫৫,২৪৮,২৩১

HSV মান হলো-৪০°,৯.৪%,৯০%

Hex Triplet হলো-#fff8e7

হুম মানুষ এই রংটাকে খুব তাড়াতাড়ি ভালোবেসে ফেলেছে।তাই ঘরের দেওয়াল সহ অনেক ডিজাইনে এখন Univeige বা ল্যাট্টে কালার টি ব্যাবহার করা হয়।বাবা মাকে বলো ঘর টাকে যেন মহাবিশ্বের রং করে দেয়।

 

তথ্যসূত্রঃ

https://en.wikipedia.org/wiki/Cosmic_latte

https://www.newscientist.com/article/dn2013-the-universe-is-not-turquoise-its-beige/

https://laughingsquid.com/an-explanation-of-the-true-cosmic-latte-color-of-the-universe/

Exit mobile version