ছোটবেলায় বন্ধু নির্বাচনের বেলায় প্রায়ই শুনতাম একটি বিখ্যাত প্রবাদ “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ”। কিন্তু এটি সম্ভবত শুধুমাত্রই প্রবাদ নয় বরং একটি বাস্তব সতর্কবার্তা। ইয়োশিয়ে শিরাটোরি, বাবা মারা যাওয়ার পরে দুই বছর বয়সে মা পরিত্যক্ত করে চলে যায় আর এরপরেই খারাপ সঙ্গের সাথে জড়িয়ে পড়ে।
১৯৩৩ সালে বন্ধুদের করা খুনের মিথ্যা দায়ে জড়িয়ে পড়ে শিরাটোরি, জোর করে স্বীকার করানো হয় যে খুনটি সেই করেছে আর সেই দায়ে তাকে ১৯৩৬ সালে প্রেরণ করা হয় জাপানের আওমোরি কারাগারে। প্রতিরাতে প্রহরীদের মার,অত্যাচার এবং প্রসিকিউশনের মৃত্যুদন্ড চাওয়ার কারণে মনে মনে শিরাটোরি জেল থেকে পালানোর উপায় খুঁজতে থাকে।
দীর্ঘদিন প্রহরীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে একদিন ভোর ৫:৩০ এ যখন আশেপাশে কেউ ছিল না সেইসময় গোসলের বালতি থেকে খুলে নেওয়া তার দিয়ে জেলের তালার লক খোলার চেষ্টা করে, বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টার পরে লক খুলতে সমর্থ হয় শিরাটোরি। কিন্তু এই লকই শেষ লক ছিলনা,সামনে আরো অনেকগুলো তালাবদ্ধ দরজা ছিল। নিজের কয়েকমাসের পর্যবেক্ষণের কারণে সে জানতো যে ১৫ মিনিটের পেট্রোল ব্রেক শেষ হতে বেশী সময় বাকি নেই, তাই সময় নষ্ট না করে বাকি লকগুলোও খুলে সে মুক্তির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সে যেই এলাকা থেকে পালানোর চেষ্টা করছিল সেটা কারাগারের অনুসন্ধান পরিধিসীমার মধ্যেই ছিল,যার অর্থ হচ্ছে যেকোন সময় সে ধরা পড়ে যেতো। কিন্তু তার জন্য শিরাটোরি তার বুদ্ধির প্রয়োগ আগেই করে রেখেছিল। প্রহরীরা তাদের পেট্রোল ব্রেক শেষে এসে দেখে শিরাটোরি ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু পরদিন সকালেই ভালমতো চেক করে দেখতে পায় যাকে তারা ঘুমন্ত শিরাটোরি ভেবেছিল সেটা আসলে ছিল চাদরে ঢাকা আলগা তক্তার স্তূপ!
এতমাসের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শেষে মাত্র তিনদিন পরেই হাসপাতালে চুরির অভিযোগে আবারও ধরা পড়ে ইয়োশিয়ে আর এইবার তাকে জেল থেকে পালানোর এবং চুরির জন্য আজীবন কারাদন্ডের শাস্তি দেয়া হয়। আওমোরি থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তাকে বদলি করা হয় আকিতা কারাগারে।
গতবারের পালানোর রেকর্ড থাকায় এইবার শিরাটোরিকে রাখা হয় প্রচন্ড ছোট বিশেষ কারাকক্ষে। কক্ষটি শুধুমাত্র তার জন্যই ছিল। তার কক্ষে আলো-বাতাসের জন্য কেবল একটিই জানালা ছিল যা ছিল প্রচন্ড দীর্ঘ সিলিং এর উপরে এবং কক্ষটির দেয়াল কপার শীটের তৈরী হওয়ায় অসম্ভব মসৃণ ছিল।
অস্বাভাবিক মারধোর, অনবরত শারিরীক পরিশ্রম তো ছিলই, এবার সাথে যুক্ত হলো হাড়-কাপানো শীতে কংক্রিটের মেঝেতে ঘুমানোর পালা। শিরাটোরি এইসব অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তবুও যা তাকে তখনো বাঁচার প্রেরণা দিয়েছিল তা হচ্ছে কবিয়াশী নামক এক গার্ডের সদয় ব্যবহার।
এক মধ্যরাতে একজন গার্ড যখন জেলের কক্ষে উঁকি দিয়ে সবাইকে চেক করছিল তখন গার্ডটি নিজের চোখকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না, কারণ সে আবিষ্কার করলো ইয়োশিয়ে তার কক্ষে নেই। কক্ষে যা আছে সেটি হচ্ছে শুধুমাত্র তার হাতকড়াটি। যেটা ছিল প্রায় অসম্ভব!
আসলে শিরাটোরি আগে থেকেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে লক খুলতে অভিজ্ঞ ছিল, তাই তার হাতকড়াটি সুপরিচিত সাধারণ লক সিস্টেমের হওয়ায় এটি খুলতেও তার বেগ পেতে হয়নি। এছাড়াও শিরাটোরির আরেকটি গুণ ছিল যেটা কেউ জানতো না, সেটা হচ্ছে সে টিকটিকির মতো করে ওপরে আরোহণ করতে পারতো। আরোহণ করে সিলিং এ পৌছে শিরাটোরি লক্ষ্য করে যেই জানালাটি আছে সেটি কাঠের ফ্রেমের এবং সেটি পচতে শুরু করেছে।
তাই রোজ সে উপরে উঠে একটু একটু করে সেটিকে নাড়িয়ে ঢিলে করে দিতো, আর নিচে নেমেই আবার হাতকড়া পরে নিতো যেন কারো সন্দেহের কারণ না হতে পারে। সব ঠিকঠাক ছিল, শুধু অপেক্ষা ছিল সঠিক সময়ের। তাই যখন প্রহরীরা কোনরকম শব্দ শুনে কিসের শব্দ আলাদা করতে পারবেনা সেটা চিন্তা করে এক ঝড়ের রাতে আবার আরোহণ করে জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল শিরাটোরি।
জাপানে ১৮৬৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত মেইজি যুগে কারাবাসীদের ওপরে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো, কারাবাসীরাও যে রক্ত-মাংসের মানুষ সেটা গণ্যই করা হতো না। আর এই নির্যাতনের প্রতিই ছিল শিরাটোরির দারুণ অনীহা।
কারাগার থেকে দ্বিতীয়বার পালানোর তিনমাস পরে আকিতা কারাগারের প্রধান রক্ষী কোবিয়াশীর ঘরে স্বেচ্ছায় যায় শিরাটোরি, কারণ একমাত্র কোবিয়াশীই এই পর্যন্ত তার সাথে ভাল ব্যবহার করেছিল। তার ইচ্ছা ছিল কোবিয়াশীর সহায়তায় নিজেকে জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে সমর্পণ করা যেখানে সে জাপানের কারাগারের দুর্নীতি এবং বর্বর আচরণের বিপক্ষে মামলা দায়ের করতে পারবে।
সে এই রীতিতে পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখতো। কোবিয়াশী তার সকল কথা ধৈর্য সহকারে শুনে তাকে আপ্যায়নও করলো, কিন্তু শিরাটোরি কিছুক্ষণ এর জন্য আড়ালে গেলে সে পুলিশকে কল দিয়ে সব জানিয়ে দিল। আবার কারারুদ্ধ হলো শিরাটোরি এবং এইবার প্রতিজ্ঞা নিল কোন আইন কর্মকর্তাকে আর কখনো ভরসা করবেনা।
এইবার বিচারালয় থেকে আরো বাড়তি তিন বছরের জন্য কারাগারে সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হলো, শিরাটোরি অনুরোধ করেছিল তাকে যেন এইবার টোকিও কারাগারে দেওয়া হয় কারণ উত্তরাঞ্চলের কারাগারে থাকতে তার কষ্ট হতো এবং আগের কারাগারে থাকতে থাকতে সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু সেটা গ্রাহ্য করেনি।
বরং এইবার বিচারক তাকে পাঠালেন কুখ্যাত আবাশিরি কারাগারে, যেটি জাপানের সবচেয়ে উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এই শীতল কারাগার থেকে কেউ কখনো পালাতে পারেনি। কারাগারটি এতটাই শীতল ছিল যে সেখানে কারাবাসীদের দেওয়া খাবার,মিস্যো স্যুপ এবং সয়া সস খুব দ্রুত বরফ হয়ে যেতো। এমন অবস্থায় শিরাটোরিকে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় গ্রীষ্মকালীন কাপড়ে জেলে প্রেরণ করা হয়। এমন ঠান্ডায় দেহ অসাড় হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না।
বেপরোয়া শিরাটোরি রক্ষীদের হুমকি দিয়েছিল যেভাবেই হোক তাকে আটকে রাখা যাবেনা, আর তার প্রমাণস্বরুপ সে রক্ষীদের সামনেই তার হাতকড়াটি হ্যাঁচকা টানে ভেঙে ফেলে। শিরাটোরির এমন অভাবনীয় শক্তি, টিকটিকির মতো আরোহণ ক্ষমতা সব বিবেচনা করে এইবার তাকে রাখা হয় “এস্কেপ-প্রুফ” সেলে যেখানে পুরো কক্ষটি তৈরী করা হয় ইস্পাত দিয়ে আর সেখানের যেকোন জানালা অপরাধীর শরীরের আকার থেকে ছোট রাখা হয় তাছাড়া, জেলের বারগুলোও সরিয়ে ফেলা হয়।
বিশেষভাবে তৈরী চাবির ছিদ্রবিহীন ২০ কেজির লোহার হাতকড়া পেছন দিক দিয়ে পরিয়ে শিরাটোরিকে রাখা হয় সেই কক্ষে। হাতকড়াটি খোলার জন্য কয়েক সপ্তাহ পরপর কেবল দুইজন মেটালওয়ার্ক স্পেশালিস্টের আশ্রয় নেওয়া হতো এবং প্রায় দুইঘন্টার লম্বা প্রসেসের পরেই সেটি খোলা সম্ভব হতো। কয়েক সপ্তাহপরে হাতকড়াগুলো না খুলে দিলে হাতে হওয়া ক্ষতে শূককীটের আক্রমণ শুরু হতো।
শিরাটোরির খাবারের পরিমাণও এইবার অর্ধেক করে দেওয়া হয় ,আর খাবার দেওয়া হতো ছোট্ট একটি জানালা দিয়ে। প্রায় কুকুরের মতো বুকে ভর করে টেনে টেনে চলতে হতো তাকে, এত ভারী হাতকড়া তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল, শান্তিমতো ঘুমাতেও পারতো না শিরাটোরি। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে বসন্ত প্রায় চলে এসেছিল, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে তার শরীরে শক্তিও ধীরে ধীরে ফিরে আসছিল।
এরপরে একদিন হঠাত আগস্টের এক রাতে এক গার্ড যখন কিছু প্রশাসনিক কাজ করছিল তখন ছাদে কিছু একটার শব্দ শুনে কারাগারে চেক করতে গিয়ে দেখে শিরাটোরি “এস্কেপ-প্রুফ” সেল থেকেও পালিয়ে গেছে। আর এইবার শিরাটোরি যেভাবে পালিয়েছে সেটা আরো রোমাঞ্চকর।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না!
পুরো মহাবিশ্বের ইতিহাস এবং কসমিক-ক্যালেন্ডার |
মেঝেতে খাওয়ার জন্য কষ্ট করতে হলেও প্রতিবার শিরাটোরি একটু করে মিস্যো স্যুপ বাঁচিয়ে রাখতো, আর সেই বাঁচিয়ে রাখা স্যুপ ঢেলে দিতো জানালার স্টিল ফ্রেম আর হ্যান্ডকাফে। স্যুপের লবণ ধীরে ধীরে হ্যান্ডকাফ আর ফ্রেমে জং ধরতে সাহায্য করেছিল আর যার কারণে মাসখানেক পরে হ্যান্ডকাফের স্ক্রুগুলো ধীরে ধীরে খুলে আসে।প্রথম স্ক্রুটি খুলে আসার পরে বাকি মাসগুলোতে সেই স্ক্রুকেই স্ক্রুড্রাইভার হিসেবে ব্যবহার করে বাকি স্ক্রুগুলো খুলে ফেলে।
হাতকড়া তো খুলে গেলো,কিন্তু কক্ষ থেকে বের হবে কি করে? জানালাগুলোতো শরীরের আকারের থেকে ছোট! কিন্তু শিরাটোরীর আরেক দক্ষতার খবর কেউ জানতো না, শিরাটোরির নিজের হাড়ের অবস্থান বদলে ফেলার ক্ষমতা। শিরাটোরি সেই জানালা দিয়ে নিজের শরীরের হাড়গুলোর অবস্থান বদলে শুয়োপোকার মতো করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায় আর এরপরে পালিয়ে যায়। পালানোর পরে দুইবছর সে একাকী ঠান্ডা পর্বতে জীবনযাপন করে।
আমেরিকার সাথে জাপানের যুদ্ধের অবসান ঘটার পরে শিরাটোরি এক কৃষককে আত্মরক্ষার জন্য খুন করে আর সেই খুনের দায়ে আবার তাকে ধরে পাঠানো হয় জেলে, আর এইবার নিয়ে যাওয়া হয় সাপোরো কারাগারে। এবার ২৪ ঘন্টা ৬ জন সশস্ত্র প্রহরী দিয়ে সার্বক্ষণিক কড়া নজরদারীর সাথে কারাগারের কক্ষ আরো আপগ্রেড করা হয়।
জানালার মাপ এবার মাথার মাপের চেয়ে ছোট করা হয়। রক্ষীরা এবার এত বিশ্বাসী ছিল যে এবার কোনরকম হাতকড়া পরানোর প্রয়োজনই মনে করেনি।আর তাছাড়াও,শিরাটোরি অনেক দুর্বল আর বুড়ো হয়ে যাচ্ছিল তাই আত্মবিশ্বাসটি এইবার বেশী।
ইয়োশিয়ে এবার সারাদিন সিলিং এর দিকে তাকিয়ে পালাবার পথ খুঁজে বেড়াতো আর শুয়ে থাকতো,উঠতে চাইতো না। রোজ এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল প্রহরীরা। একদিন সকালে বিরক্ত হয়ে প্রহরীরা কক্ষে ঢুকে তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে গিয়ে দেখে বিছানায় শিরাটোরি নয়,আছে আলগা কাঠের তক্তা।
আসলে এইবার শিরাটোরি মনোবিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে ধোকা দেওয়ার জন্য ওপরের দিকে তাকিয়ে অভিনয় করতো,আর সিলিং এর চারপাশের দিকে বেশী মনোযোগ দেওয়ায় মেঝের গঠনের দিকে নির্মাতা খেয়ালই করেনি। তাই শিরাটোরি এইবার রোজ মেঝের কাঠগুলো উঠিয়ে স্যুপের বাটি দিয়ে মাটি কেটে মাটির নিচ দিয়ে রাস্তা বানিয়ে পালিয়ে যায়। আর রোজ রাতে সে কাঠগুলো সঠিক স্থানে রাখার কারণে কেউ ধরতেও পারেনি শিরাটোরির এই বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল। আর এভাবেই চতুর্থবারের মতো পালালেন ইয়োশিয়ে শিরাটোরি।
অবশ্য পরে একটা সময় শিরাটোরি নিজেই এক অফিসারকে নিজের পরিচয় জানিয়ে ধরা দেয় এবং তার সমস্ত কাহিনী এবং আচার-ব্যবহারের কারণে জাপানের বিচার-ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য জোর দেওয়া হয়। তাকে তার পছন্দমতো টোকিওতে ফুচু কারাগারে রাখা হয় এবং সেখানে স্বচ্ছন্দে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত সে কারাজীবন কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
এভাবেই ইয়োশিয়ে শিরাটোরি নিজেকে জাপানের এন্টি-হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ।তার স্মরণার্থে আবাশিরি কারাগার (বর্তমানে আবাশিরি মিউজিয়াম) এ তার প্রতিকৃতিও রাখা হয়েছে।