শ্রীনিবাস রামানুজন ছিলেন অসামান্য প্রতিভাবান একজন ভারতীয় গণিতবিদ।অল্প বয়সে গণিতের অন্তর্নিহিত উপলব্ধি প্রদর্শনের পরে, শ্রীনীবাস রামানুজন তাঁর নিজস্ব তত্ত্বগুলি বিকাশ শুরু করেছিলেন এবং ১৯১১ সালে তিনি ভারতে তাঁর প্রথম পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি গণিতের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষ করে গাণিতিক বিশ্লেষণ, সংখ্যাতত্ত্ব, অসীম ধারা ও আবৃত্ত ভগ্নাংশ শাখায়, গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। খুব অল্প সময় বাঁচলেও তিনি গণিতে সুদূরপ্রসারী অবদান রেখে গেছেন। তার রেখে যাওয়া নোটবুক বা ডায়েরি হতে পরবর্তীতে আরও অনেক নতুন সমাধান পাওয়া গেছে।
জন্ম ও বংশপরিচয় :
রামানুজন ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর প্রাচীন ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের একটি ছোট গ্রাম ইরোডে , দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শ্রীনিবাস ইয়েঙ্গার ছিলেন শহরের একটি কাপড়ের দোকানের হিসাব রক্ষক।
বাল্যকাল :
রামানুজন স্থানীয় ব্যাকরণ স্কুল এবং উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েন এবং প্রথম দিকে গণিতের প্রতি একটি স্নেহ প্রদর্শন করেছিলেন। তার অসাধারণ প্রতিভা স্কুল কর্তৃপক্ষের গোচরে আসে এবং তার প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে বৃত্তি দেওয়া হয়। তিনি বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে বিভিন্ন গাণিতিক উপপাদ্য, গণিতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তার এক বন্ধু তাকে G S Carr-এর লেখা “Synopsis of elementary results in Pure and Applied Mathematics” বইটি পড়তে দেন। মূলত এই বইটি পড়েই তার গাণিতিক প্রতিভার বিকাশ ঘটতে শুরু করে।
যৌবনকাল:
১৬ বছর বয়সে রামানুজন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হন ও জুনিয়র শুভ্রামানায়াম বৃত্তি লাভ করে কুম্ভকোনাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু গণিতের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার ফলে পরের পরীক্ষায় ইংরেজিতে অকৃতকার্য হন এবং তার বৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি কুম্ভকোনাম ত্যাগ করে প্রথমে বিশাখাপত্তনম এবং পরে মাদ্রাজ যান। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ফার্স্ট এক্সামিনেশন ইন আর্টস (F.A. বা I.A.) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন এবং অকৃতকার্য হন। তিনি আর এই পরীক্ষা দেননি। এরপর কয়েক বছর তিনি নিজের মত গণিত বিষয়ক গবেষণা চালিয়ে যান।
বিবাহ ও গবেষণা কর্ম:
১৯০৯ সালে রামানুজন বিবাহ করেন। কিন্তু তার কোন স্থায়ী কর্মসংস্থান ছিলনা।এ সময় তার ঘনিষ্ঠ একজন একটি পরিচয়পত্র দিয়ে চাকুরীর সুপারিশ করে তাকে দেওয়ান বাহাদুর রামচন্দ্র রাও-এর কাছে প্রেরণ করেন। তিনি গণিতের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। তিনি কিছুদিনের জন্য রামানুজনের সকল ব্যয়ভার বহন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
রামানুজনের দুটি নোটবুক তার সকল গাণিতিক সূত্রের প্রতিপাদন ও এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় লিপিবদ্ধ ছিল। পোর্ট ট্রাস্টে কাজ করার সময় কিছু লোকের সাথে তার পরিচয় হয় যারা তার নোটবুক নিয়ে উৎসাহ প্রকাশ করেন। এর সূত্র ধরে গণিত বিষয়ে কিছু বিশেষজ্ঞের সাথে তার যোগাযোগ হয়। ১৯১১ সালে তার প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ Journal of the Mathematical Society পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সংখ্যাতত্ত্বের উপর তার গবেষণালদ্ধ “Some Properties of Bernoulli’s Numbers” নামে তার প্রথম দীর্ঘ প্রবন্ধ একই বছর প্রকাশিত হয়। ১৯১২ সালে একই পত্রিকায় তার আরো দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এবং সমাধানের জন্য কিছু প্রশ্নও প্রকাশিত হয়। তিনি ম্যাজিক স্কোয়ার গঠনের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।
প্রতিভার স্বীকৃতি:
রামচন্দ্র রাও মাদ্রাজ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের মি. গ্রিফিথ-কে রামানুজনের ব্যাপারে বলেন। মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের চেয়ারম্যান স্যার ফ্রান্সিস স্প্রিং-এর সঙ্গে মি. গ্রিফিথ এর আলাপ হওয়ার পর থেকেই রামানুজনের প্রতিভার স্বীকৃতি শুরু হয়।
মাদ্রাজ শহরের বিশিষ্ট পন্ডিত শেশা আইয়ার এবং অন্যান্যদের পরামর্শে কেমব্রিজের ত্রিনিত্রি কলেজের ফেলো জি.এইচ. হার্ডির সঙ্গে রামানুজন যোগাযোগ শুরু করেন এবং তার বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একটি পত্র লেখেন।
এই পত্রের সঙ্গে ১২০ টি উপপাদ্য সংযোজিত ছিল, তার ভিতর থেকে নমুনাস্বরূপ হার্ডি ১৫টি নির্বাচন করেন। একটি গাণিতিক পদের জন্য ব্যবহৃত প্রতীক (notation) ১৯০৮ সালে এডমুন্ড ল্যান্ডাউ প্রথম উদ্ভাবন করেন। ল্যান্ডাউয়ের মত এত কিছু রামানুজনের ছিলনা। তিনি ফরাসী বা জার্মান ভাষায় কোন পুস্তক কখনো দেখেন নি, এমন কি ইংরেজি ভাষায় তার জ্ঞান এত দুর্বল ছিল যে কোন ডিগ্রীর জন্য কোন পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হওয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিলনা।
তিনি এমন কিছু বিষয় ও সমস্যার উপস্থাপনা করেছেন যা ইউরোপের অসামান্য প্রতিভাধর বিজ্ঞানীরা ১০০ বছর ধরে সমাধান করেছেন- এমন কি কিছু এখনো সমাধান হয়নি।১৯১৩ সালে তাকে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বৃত্তি এবং কেমব্রিজের অনুদান উভয়ই সুরক্ষিত করতে সক্ষম হন।পরের বছর, হার্ডি রামানুজনকে কেমব্রিজে তাঁর সাথে পড়াশোনা করতে রাজি করান। রামানুজন ১৯১16 সালে কেমব্রিজ থেকে গবেষণার জন্য স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯১৮ সালে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হন।
তত্ত্ব এবং উদ্ভাবন:
রামানুজনের উদ্ভাবন সমূহ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। রামানুজনের নিজের মৌলিক উদ্ভাবনসমূহ এবং হার্ডির সাথে তার গবেষণার ফসলসমূহ নিম্নরূপঃ ” বিভাজন ফাংশন এবং এর অসীমতট সম্পর্কীয় তত্ত্বসমূহ।নিম্নোক্ত ক্ষেত্রেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে: গামা ফাংশন মডুলার রূপ (Modular forms) রামানুজনের অবিচ্ছিন্ন ভগ্নাংশসমূহ (Ramanujan’s continued frations) অপসারী ধারা (Divergent series) অধিজ্যামিতীয় ধারা (Hypergeometric series) মৌলিক সংখ্যা তত্ত্ব।
দুইজন ক্লাসমেট:- বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন এবং সাহা সমীকরণ সম্পর্কে জানতে ক্লিক করো এখানে |
|
রামানুজনের মৌলিক সংখ্যা সমূহ ১৯১৯ সালে রামানুজন কর্তৃক প্রকাশিত হয়। মক থেটা ফাংশন (Mock theta functions) রামানুজনের অনুমিতি এবং এদের অবদান মূল নিবন্ধ: রামানুজনের অনুমিতি রামানুজনের বিপুল সংখ্যক তত্ত্ব তার অনুমান হিসেবে পরিচিত হলেও পরবর্তীকালে এগুলো গবেষণা ক্ষেত্রে বিশাল অবদান রেখেছে।
রামানুজনের অনুমিতি ছিল টাউ ফাংশনের (tau function) আকার নিয়ে একটা পূর্বানুমান, যেটা {\displaystyle \Delta }{\displaystyle \Delta }(q) এর মডুলার রূপের পার্থক্য নিরূপন করে। পিয়ের ডেলিগনি কর্তৃক ওয়েলের অনুমিতি (Weil conjectures) প্রমাণের ফলাফল সরূপ এটি প্রমাণিত হয়।
|
মৃত্যু:
১৯১৭ সালের বসন্তকালের প্রথমে রামানুজন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে কেমব্রিজের একটি নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হয়। এরপর তিনি আর কখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেন নি। তাকে ওয়েলস, ম্যালটক এবং লন্ডন শহরের স্বাস্থ্য নিবাসে ভর্তি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এক বছর তার শারীরিক কোন উন্নতি দেখা যায়নি।
এই সময় রামানুজন রয়েল সোসাইটি-র সদস্য নির্বাচিত হন। গবেষণা কাজে অধিক মনোযোগ দেওয়ার ফলে তার সবচেয়ে মূল্যবান উপপাদ্যগুলো এই সময় আবিষ্কৃত হয়। তিনি নির্বাচিত ত্রিনিত্রি ফেলো ছিলেন। ১৯১৯ সালে রামানুজন ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। যক্ষ্মার সংক্রমণের পরে, রামানুজন ভারতে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি ১৯২০ সালে ২৬ই এপ্রিল ৩২ বছর বয়সে মারা যান।
|