বিজ্ঞান ব্লগ

গণিতের রঙ্গমঞ্চে পাই “π” এর আবির্ভাব এর গল্প

পাই (প্রতীক “π”, প্রাচীন গ্রিক ভাষায় “পি”) অথবা ‘π’ একটি গুরুত্বপূর্ণ গাণিতিক ধ্রুবক, মোটামুটিভাবে যার মান ৩.১৪১৫৯ ধরা হয়। ইউক্লিডীয় জ্যামিতিতে যেকোনো বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে এই ধ্রুবক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। তবে একইভাবে এটি বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সঙ্গে এর ব্যাসার্ধের বর্গের অনুপাতেরও সমান।

গণিত, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিদ্যার অনেক সূত্রে পাইয়ের দেখা পাওয়া যায়। পাই একটি অমূলদ সংখ্যা, অর্থাৎ এটিকে দুইটি পূর্ণসংখ্যার ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করা যায় না। অন্যভাবে বলা যায়, এটিকে দশমিক আকারেও সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার মানে আবার এও নয় যে, এটিতে কিছু অঙ্ক পর্যাবৃত্ত বা পৌনঃপুনিক আকারে আসে। বরং দশমিকের পরের অঙ্কগুলো এক্ষেত্রে দৈবভাবেই পাওয়া যায়।

পৃথিবীর যে সকল বিষয়ে যত বেশি রহস্য থাকে সেই সকল বিষয় নিয়ে মানুষের আগ্রহের পরিমাণ তত বেশি। তেমনি এক রহস্যে ঘেরা গাণিতিক চিহ্ন পাই(π)। আজ থেকে প্রায় ৪০০০ হাজার বছর পূর্বে মিসরীয়রা সর্বপ্রথম (π) নিয়ে কাজ শুরু করে এবং ধারণা করা হয় ঐ সময়েই তাঁরা পাই এর ব্যবহার জানতেন। সেই সময় থেকে শুরু করে বর্তমানের গণিত পিপাসুরা সমান আগ্রহে (π) নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছে।

গণিতে পাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। পাই এর মান ৩.১৪১৬ বলে প্রতি বছর মার্চের ১৪ তারিখ পাই দিবস উদযাপন করা হয়। পাই(π) দিবস কখনও কখনও ১৪ই মার্চ দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটে উদযাপন করা হয়। ঐ দিন দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটকে পাই মিনিট নামে আখ্যায়িত করা হয়।

পাই যে কেবল অমূলদ তাই নয়, বরঞ্চ এটি একই সঙ্গে একটি তুরীয় সংখ্যা। অর্থাৎ এটিকে কোনো বহুপদী সমীকরণের মূল হিসাবেও গণনা করা যায় না। গণিতের ইতিহাস জুড়ে, নির্ভুলভাবে পাইয়ের মান নির্ণয়ের ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি, এই ধরনের প্রচেষ্টা কখনও কখনও সংস্কৃতির অংশও হয়েছে। গ্রিক বর্ণ পাই (গ্রিকঃ π পি) গ্রিক পরিধি “পেরিমেত্রোস্‌” থেকে এসেছে।

সম্ভবত ১৭০৬ সালে উইলিয়াম জোনস প্রথম এটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে লিওনার্দো অয়েলার এটিকে জনপ্রিয় করেন। পাইকে গণিতে ব্যবহারের সময় ইংরেজি পাই (pie) হিসেবে উচ্চারণ করা হয় যদিও এর গ্রিক উচ্চারণ পি। এটিকে কোনো কোনো সময় বৃত্তীয় ধ্রুবক, আর্কিমিডিসের ধ্রুবক অথবা রুডলফের সংখ্যাও (জার্মান গণিতবিদের নাম হতে এসেছে, যার পাইয়ের মান নিয়ে কাজ পৃথিবীখ্যাত) বলা হয়। 

ইউক্লিডিয় সমতলীয় জ্যামিতিতে, বৃত্ত

লক্ষনীয় যে, পরিধি বা ব্যাস বৃত্তের মাপের ওপর নির্ভর করে না। যদি একটি বৃত্তের ব্যাস অন্য একটি বৃত্তের ব্যাসের দ্বিগুন হয়, তাহলে সেই বৃত্তের পরিধি পরের বৃত্তের পরিধির দ্বিগুন হবে। অর্থাৎ (পরিধি/ব্যাস) একই থাকবে। এই ঘটনাটি সমস্ত বৃত্তের সদৃশতার একটি ফলাফল। বৃত্তের ক্ষেত্রফল = π × দাগকাটা অংশের ক্ষেত্রফল; অন্যভাবে বলা যায়, বৃত্তের ক্ষেত্রফল ও যে বর্গক্ষেত্রের দৈর্ঘ্য বৃত্তের ব্যাসার্ধের সমান তার ক্ষেত্রফলের অনুপাত হিসাবেও একে প্রকাশ করা যায়।

অমূলদত্ব ও তুরীয়ত্ব

ধ্রুবক π একটি অমূলদ সংখ্যা; মানে এটিকে দুইটি পূর্ণসংখ্যার অনুপাত হিসেবে লেখা যাবে না। ১৭৬১ সালে জোহান হেনরিখ ল্যাম্বার্ট এটি প্রমাণ করেন। বিশ শতকে, এমন সাধাসিধে প্রমাণ বের করা হল যা বোঝার জন্য ক্যালকুলাস সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান থাকলেই চলে। এর মধ্যে আইভান নিভেন-এর প্রমাণটি সর্বজনবিদিত। এর আগের আর একটি প্রমাণ করেন মেরি কার্টরাইট।

১৮৮২ সালে ফার্দিনান্ড ভন লিনডেম্যান প্রমাণ করেন যে, পাই একটি তুরীয় সংখ্যা। এর মানে মূলদ সহগবিশিষ্ট এমন কোন বহুপদী সমীকরণ নেই, π যার মূল। তাহলে এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য দাড়ালো এই যে, কম্পাস ও রুলারের সাহায্যে পাই আছে এমন সমতুল কিছু আঁকা যাবে না। মানে হল কম্পাস ও রুলারের সাহায্যে একটি বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সমান ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট একটি বর্গক্ষেত্র কখনোই আঁকা যাবে না।

দশমিকের পর এক হাজার ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান নিচে দেওয়া হল:

π=3.1415926535897932384626433832795028841971693993751058209749445923078164062862089986280348253421170679821480865132823066470938446095505822317253594081284811174502841027019385211055596446229489549303819644288109756659334461284756482337867831652712019091456485669234603486104543266482133936072602491412737245870066063155881748815209209628292540917153643678925903600113305305488204665213841469519415116094330572703657595919530921861173819326117931051185480744623799627495673518857527248912279381830119491298336733624406566430860213949463952247371907021798609437027705392171762931767523846748184676694051320005681271452635608277857713427577896091736371787214684409012249534301465495853710507922796892589235420199561121290219608640344181598136297747713099605187072113499999983729780499510597317328160963185950244594553469083026425223082533446850352619311881710100031378387528865875332083814206171776691473035982534904287554687311595628638823537875937519577818577805321712268066130019278766111959092164201989

দশমিকের পর ট্রিলিয়নের (১ এর পর ১২টি শূন্য) বেশি ঘর পর্যন্ত পাই-এর মান বের করা হলেও সাধারণ কাজে দশমিকের পর ১২ ঘরের বেশি মান তেমন একটা প্রয়োজন হয় না। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, সারা দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় বৃত্তের পরিধি গণনার জন্য ৩৯ ঘরের মান ব্যবহার করলে তার সূক্ষ্মতা হবে হাইড্রোজেন পরমাণুর সমান।

পাই  নিজেই একটি অসীম দশমিক বর্ধন কারণ π একটি অমূলদ সংখ্যা, এর দশমিক বর্ধন কখনো শেষ হয়না বা পুনরাবৃত্তি করে না। এই অসীম ধারাটি গণিতজ্ঞ ও সাধারন মানুষকে যুগে যুগে চমৎকৃত করেছে। তাই সবাই চেষ্টা করেছে এর সঠিক মান বের করার জন্য। কেবল যে বিশ্লেষণী কাজ হয়েছে এতে তা নয়, এই কাজে এমনকী সুপার কম্পিউটারও ব্যবহার করা হয়েছে।

সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে দশমিকের পর লক্ষ কোটি ঘর পর্যন্ত হিসাব করে কোনো পুনরাবৃত্তি পাওয়া যায় নি।উল্লেখ্য, ১৬৬৫ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন পাই এর মান নির্ণয় করেন এবং দশমিকের পর ১৬ ঘর পর্যন্ত বের করেন।বর্তমান কম্পিউটারের যুগে পাই(π) এর মান ট্রিলিয়ন ঘর পর্যন্ত বের করা সম্ভব। কিন্তু পাই একটি অমূলদ সংখ্যা বিধায় এর মান কখনোই শেষ হবে না।

তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া

Exit mobile version