বিজ্ঞান ব্লগ

গ্যাসলাইটিং (Gaslighting)- আপনার স্বকীয়তা যখন হুমকির মুখে

মিসেস মেহরিমা একজন গৃহিণী, স্বামী -সংসার সব গুছিয়ে নিয়ে চলছেন তিনি। কিন্তু প্রতিনিয়ত তার ভুল-ভ্রান্তি বেড়েই চলছে। যেমনঃ একদিন তাঁর স্বামী সাদাফ তাকে বললো চা দিতে, সে যখন চা নিয়ে গেলো তখন সাদাফ বললো যে সে চা চায়ইনি। তাহলে মেহরিমা কেন নিয়ে আসলো?! আবার ঘুরতে যাওয়ার সময় মেহরিমা সানগ্লাস নিয়েছিলো, কিন্তু স্পটে গিয়ে আর সানগ্লাস পেলো না, অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে সে ব্যাগে সানগ্লাস রেখেছিলো। এরকম কেন হচ্ছে?!

পারতপক্ষে মানুষের ভুলে যাওয়া কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু কাউকে ক্রমাগত ভুল প্রমাণ করাটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক।

গ্যাসলাইটিং কী?

কাউকে ভুল প্রমাণ করে তার মাইন্ড কে ম্যানিপুলেট করাকে বলা হয় গ্যাসলাইটিং। গ্যাসলাইটিং, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত, যাই-ই হোক না কেন, এটি এক ধরনের  মানসিকভাবে ম্যানিপুলেট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিভিন্ন রিলেশনের ক্ষেত্রে গ্যাসলাইটিং এর প্রভাব দেখা যায়, হতে পারে সেটা বসের সাথে, কিংবা ফ্রেন্ডসদের সাথে। বাট সবচেয়ে বেশি দেখা যায় লাইফ পার্টনার এর সাথে যা অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়৷

কোথা থেকে এসেছে গ্যাসলাইটিং?

প্যাট্রিক হ্যামিলটন এর “গ্যাসলাইট” উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৪৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “গ্যাসলাইট” মুভি হতে এই “গ্যাসলাইটিং- Gaslighting”  নামকরণটি এসেছে। মুভিতে নায়ক চার্লস বয়ার যিনি স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তিনি  ধীরে ধীরে তাঁর স্ত্রীর মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। স্ত্রীকে (বার্গম্যান) মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। একপর্যায়ে স্ত্রীকে ভাবতে বাধ্য করান যে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। যাঁরা এ ধরনের নিপীড়ন করেন, তাঁদের বলা হয় ‘গ্যাসলাইটার’ আর মানসিক নিপীড়ন এর এই কৌশল কে বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং’।

এখন প্রশ্ন, কীভাবে হয় গ্যাসলাইটিং?

গ্যাসলাইটিং–প্রক্রিয়ায় শিকারকে ভাবতে বাধ্য করা হয় তিনি ভুল করেছেন বা ভুল ভেবেছেন। যেমন যে কাজটি তিনি করেননি, তাঁকে ভাবতে বাধ্য করা হয় সেই কাজটি তিনি করেছেন। আবার যা প্রকৃতপক্ষে ঘটে গেছে, কিন্তু শিকারকে ভাবতে বাধ্য করা হয় এমনটা আদৌ ঘটেনি। ফলে বাস্তবতা আর বিশ্বাসের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই দ্বন্দ্ব থেকে মানসিক বিপর্যস্ততা দেখা দেয়।

গ্যাসলাইটিং- Gaslighting

যে গ্যাসলাইটিং- Gaslighting এ এক্সপার্ট, সে স্বভাবতই শিকারের সেন্সিটিভ জায়গা জানে কিংবা জেনে নেয় কৌশলে, এবং সেটা ইউজ করেই ম্যানিপুলেট করে ভিক্টিমের মাইন্ডকে। এমনভাবে ম্যানিপুলেট করে যাতে ভিক্টিম ভাবতে শুরু করে যে নিজে ঠিক না, কিংবা আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করে, নিজেকে নিজেই সন্দেহ শুরু করতে থাকে। যেমনঃ আপনার কাছে সে  কোনো টাকা ধার চাইলো, এবং আপনি যখন  টাকা দিতে গেলেন তখন আপনাকে বললো যে সে টাকা চায়ইনি। তখন আপনারও মনে হতে শুরু করবে যে এইটা হয়তোবা আপনারই ভুল। এইভাবে ধীরে ধীরে প্রতিপদে সে ক্রমাগত আপনাকে ভুল ভাবাতে শুরু করবে। আর একটা পর্যায়ে গিয়ে মনেই হবে, সত্যিই আপনি পাগল হয়ে গেছেন।

গ্যাসলাইটিং এর ধরন-

নারী বা পুরুষ যে কেউ গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হতে পারে, তবে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। “দ্য গ্যাসলাইট ইফেক্ট” বইয়ের লেখক ড. রবিন স্টার্ন, যিনি ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স  নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি তিন ধরনের ‘গ্যাসলাইটার’–এর বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।

কারা করেন গ্যাসলাইটিং?

সাধারণত নার্সিসিস্ট মানুষের মাঝে গ্যাসলাইটিং (Gaslighting) করার প্রবণতা দেখায়। তারা মনে করতে থাকে যে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আর এই ভাবনা- চিন্তা থেকেই  তারা তাদের  কাছের মানুষজনদের গ্যাসলাইটিং করে থাকেন। কারণ তারা চায় তাদের সেই মানুষের জগৎ শুধু তাকে নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকুক। গ্যাসলাইটিং এর মাধ্যমে তারা সেই মানুষকে মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত করে ফেলে, এতে করে মানুষটি আস্তে আস্তে গুটিয়ে নেওয়া শুরু করে, আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করে। এছাড়া সঙ্গীর প্রতি ইনসিকিউরিটি থেকে এই গ্যাসলাইটিং এর প্রবণতা আসতে পারে। এমন একটা রিলেশন যেখানে সঙ্গীর উপর ভরসা না রাখতে পেরে তাকে মানসিক ভাবে অসুস্থ আর এককেন্দ্রিক করে দেওয়ার প্রবণতা থেকে গ্যাসলাইটিং এর আশ্রয় নেয় গ্যাসলাইটার।

পরিত্রাণের উপায়-

কিভাবে পরিত্রাণ পাবো তা এক চিন্তার বিষয়। কারণ যেভাবে আপনাকে প্রতিনিয়ত ভুল প্রমাণ করা হচ্ছে এতে আত্মবিশ্বাস হারানো স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান কাজ হলো সাইক্রিয়াটিস্ট এর সাহায্য নেওয়া। যার উপর সন্দেহ হয় তার সাথে নিজের কার্যকলাপের রেকর্ড রাখা। এতে করে আপনি যে সঠিক তার প্রমাণ পাওয়া যাবে, আর কোনোমতেই আত্মবিশ্বাস হারানো যাবে না। আর একই সাথে, আপনি বিষয়টি আপনার বিশ্বাস করেন এমন আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী কারো সাথেও শেয়ার করতে পারেন, সেক্ষেত্রে সেও আপনাকে সাহায্য করতে পারে এই গ্যাসলাইটিং থেকে।

Exit mobile version