বিজ্ঞান ব্লগ

জাদুঘর-এর সেকাল-একাল: ইতিহাস সংরক্ষণের জাদুকর

ছোটবেলায় যখন জাদুঘর কথা শুনতাম তখন অনেকেরই মাথায় আসতো “এখানে কি জাদু দেখানো হবে? জাদু শেখানো হবে?” “জাদুর জিনিস দেখাবে মনে হয়!” “এইখানে বোধ হয় শুধু জাদু করা হয়”। তো জাদুঘর আর যাই  হোক না কেন, আমাদের অবাক করতে কিন্তু জাদুঘরের জুড়ি মেলা ভার। আমাদের জ্ঞানপিপাসা মেটানোর এই খোরাক নিয়ে একটু জেনে আসা যাক। জাদুঘরের ইতিহাস, অদ্ভুত কিছু জাদুঘর ও বর্তমানের জনপ্রিয় কিছু সাইন্স- মিউজিয়াম নিয়ে এবারের লেখা।

জাদুঘরের সেকাল:

জাদুঘর তো ইতিহাসের অনেক কিছুই তুলে ধরে। কিন্তু জাদুঘরের ইতিহাস, জাদুঘর কীভাবে গড়ে উঠেছে তা জানেন কি?

জাদুঘরের ইতিহাস আসলে হুট করে গড়ে উঠেনি। আর পূর্বের জাদুঘরগুলো বর্তমানের মত ছিল না। প্রারম্ভিক সময়ে শুধু ধনী ব্যক্তি অথবা তাদের পরিবারের বিরল ও দুষ্প্রাপ্য বস্তু প্রদর্শিত হতো। তখন এ গুলোকে আশ্চর্যকক্ষ/ কৌতুহল কেবিনেট নামকরণ করা হয়েছিল। ২৫০০ বছর পূর্বে ব্যাবিলিয়ান রাজকুমারী সৃষ্টি করেছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘর। বর্তমান বিশ্বের সব প্রাচীন জাদুঘরগুলো নির্মিত হয়েছিল ইতালিতে রেনেসাঁর সময়ে। বিশ্বের প্রাচীনতম সংগ্রহশালা “ক্যাপিটোলিন মিউজিয়াম” এর সূচনা হয় ১৪৭১ সালে। বর্তমান বিশ্বে যতসব জাদুঘর আছে তা প্রাচীন জাদুঘরের সোনালী ফসল বলা চলে।

জাদুঘর শব্দ ও ধারণার উৎপত্তি:

গ্রীক লেখক পেসেনিয়াস-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, এক সংগীতজ্ঞ মউসিয়াসের নামানুসারে এক পাহাড়ের নাম হয় মউসিয়ন (‘Mouseion‘)। ঐতিহাসিকদের মতে, এই মউসিয়ন শব্দ থেকে Museum বা জাদুঘর শব্দের উৎপত্তি। বাংলায় জাদুঘর শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল মিউজিয়াম (Museum)। মিউজিয়াম শব্দের মূল উৎস হল প্রাচীন গ্রিক শব্দ Mouseion যার অর্থ হল গ্রিক পুরাণের শিল্পকলার পৃষ্ঠপােষক মিউজদের মন্দির।Science Bee Daily Science

জাদুঘরের বিকাশ:

সুপ্রাচীন অতীতে মেসােপটেমিয়া ও এথেন্স জাদুঘরের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা গেছে। বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের জাদুঘর গড়ে উঠেছে। ICOM (International Council of Museums)-এর মতে বর্তমানে বিশ্বের ২০২টি দেশে প্রায় ৫৫,০০০-এরও বেশি জাদুঘর গড়ে উঠেছে।

পঞ্চদশ শতকের পূর্বে:
অতীতে ধনী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক উদ্যোগে অথবা কোনাে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জাদুঘরগুলি গড়ে উঠত। এই সমস্ত জাদুঘরগুলিতে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না, কেবলমাত্র বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গই এগুলিতে প্রবেশাধিকার পেতেন। বিশ্বের প্রাচীনতম জাদুঘরটি হল মেসােপটেমিয়ার এননিগালডি-নান্না-র জাদুঘর (Ennigaldi Nanna’s Museum)। এ ছাড়াও পরবর্তী সময়ের উল্লেখযােগ্য জাদুঘরটি হল দার্শনিক প্লেটোর ব্যক্তিগত উদ্যোগে গঠিত এথেন্সের জাদুঘর। পঞ্চদশ শতকের পূর্বেকার সর্বাধিক জনপ্রিয় জাদুঘরটি ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার জাদুঘর।

পঞ্চদশ শতকের পরে:
পঞ্চদশ শতকের পর থেকে‌ সর্বসাধারণের প্রদর্শনযােগ্য প্রথম জাদুঘরটি গড়ে ওঠে ইটালির রােমে, যার নাম ক্যাপিটোলাইন মিউজিয়াম (১৪৭১ খ্রি.)। পােপ দ্বিতীয় জুলিয়াস-এর উদ্যোগে গঠিত হয় ভ্যাটিকান মিউজিয়াম (১৫০৬ খ্রি.)। পরে একে একে গড়ে ওঠে লন্ডনের রয়েল আরমারিজ এবং দ্য অ্যাসমােলিয়ান মিউজিয়াম, সুইজারল্যান্ডের আমেরব্যাখ ক্যাবিনেট, সেন্ট পিটার্সবার্গের কুন্সটকামেরা, ভিয়েনার বেলভেডার প্যালেস, আমেরিকার চার্লসটন মিউজিয়াম প্রভৃতি। এরপর অষ্টাদশ শতকে জাদুঘরের বিস্তৃতি লাভ করে।

অষ্টাদশ শতকের এই সময়কালে একে একে প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে ব্রিটিশ মিউজিয়াম (১৭৫৩ খ্রি.), ইটালির ফ্লোরেন্সের উফফিজি গ্যালারি (১৭৬৫ খ্রি.), ফ্রান্সের প্যারিসের লুভর মিউজিয়াম (১৭৯৩ খ্রি.)।

উনবিংশ ও বিংশ শতকে আমেরিকার ইয়েল কলেজের আর্ট গ্যালারি (১৮৩২ খ্রি.), সুইডেনের আর্মি মিউজিয়াম (১৮৬৭ খ্রি.), দ্য আর্ট ইন্সটিটিউট অব শিকাগাে (১৮৮৩ খ্রি.), দ্য ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অব আর্ট প্রভৃতি গড়ে উঠে।

এখন, আমাদের অনেকের বদ্ধ ধারণা, যে জাদুঘর মানেই অতীত নিদর্শন। হ্যাঁ কথাটা অনেকাংশে সত্য হলেও পুরোপুরি নয়। সংরক্ষণ ও সংগ্রহের ভিত্তিতে জাদুঘরের বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমনঃ

১. সাধারণ জাদুঘর: যেই সাধারণ সংগ্রহশালার ধারণা থেকে জাদুঘরের উৎপত্তি, বর্তমান সাধারণ জাদুঘর সেই কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। এরও কিছু ভাগ রয়েছে–

২. কলা জাদুঘর: বর্তমান সময়ে কলাশিল্প পড়াশোনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ালেও আগে কিন্তু তেমন ছিলো না। এর মধ্যে যেসব জাদুঘরের পরিচিতি মেলে-

৩. ঐতিহাসিক জাদুঘর: ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে এসব জাদুঘর গড়ে উঠে, যেমন ইতিহাসের কোনো যুদ্ধ, বা বিপর্যয় ইত্যাদি।

৪. বিজ্ঞান বিষয়ক জাদুঘর: বিজ্ঞান অস্বীকার করা মানে আদিকালে অবস্থান করা, আর বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে এসব জাদুঘরের জুড়ি নেই।

জাদুঘরের এত সব ভাগ থাকলেও কিছু অদ্ভুত জাদুঘর এর দেখাও মেলে ইতিহাসে। তার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ দেওয়া হলো-

মেগুরো প্যারাসাইটোলজিক্যাল মিউজিয়াম, টোকিও:

নানান পরজীবী প্রাণী, জীবাণু ও কীটাণু দিয়ে সাজানো এই মিউজিয়াম এর অবস্থান মেগুরো ওয়ার্ড, টোকিওতে। ১৯৫৩ সালে ডক্টর সাতোরু কামেগাই এটি চালু করেন। এখানে ৬০,০০০ এরও বেশি পরজীবী প্রাণী এবং এ বিষয়ক ৫০,০০০ এর মতো রিসার্চ পেপার ও ৫০০০ বই রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিপ্টোজুওলজি মিউজিয়াম, পোর্টল্যান্ডঃ

যুক্তরাষ্ট্রের মেইন, পোর্টল্যান্ডে অবস্থিত এই জাদুঘরটি। ‘ক্রিপ্টোজুওলজি’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হলো গুপ্ত প্রাণী নিয়ে গবেষণা। রূপকথা, কল্পকাহিনী বা সাহিত্যে আমরা যেসব প্রাণী দেখতে পাই বা জানতে পারি সেগুলোর কোনটিই বাস্তবে নেই, আর জাদুঘরটি কাজ করে যাচ্ছে এমনই সব প্রাণীদের নিয়ে।

সালিনা টার্ডা মিউজিয়াম, রোমানিয়া:

মূলত এই জাদুঘরটি ছিলো একটি লবণের খনি। ১১-১৩ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই খনিটির খনন কাজ আরম্ভ হয়েছিলো। চাইলে এখানে আপনি উপভোগ করতে পারবেন আলো-আঁধারির এক রোমাঞ্চকর পরিবেশে নৌকাভ্রমণও। পুরো জাদুঘরে কাঠের কাঠামোর সৌন্দর্য ও অপূর্ব আলোকসজ্জা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে! বিজ্ঞানীদের মতে এখানকার পরিবেশ স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।

কানকুন মেরিন পার্ক/ কানকুন আন্ডারওয়াটার মিউজিয়াম, মেক্সিকো:

নাম হিসেবে পার্ক  শব্দে চিনলেও আসলে এটি জাদুঘর। সমুদ্রপৃষ্ঠের  ৯.৮- ১৯.৬ ফিট গভীরে  ৫০০টি ভাস্কর্যে নানা মানুষের প্রতিমূর্তি নিয়ে সাজানো এই জাদুঘরটি। মেক্সিকোর ক্যারিবিয়ান সমুদ্র সৈকতের কাছে এই ভাস্কর্যগুলোর অধিকাংশই তৈরি করেছেন Jason deCaires Taylor, এবং আরও রয়েছে ৫ জন মেক্সিকান ভাষ্কর্যবিদ। কোরাল রিফ বাঁচাতে ডিরেক্টর Jaime Gonzalez ও Jason deCaires Taylor এই জাদুঘরটি তৈরির উদ্যোগ নেন।

এবার বর্তমান সময়ের শীর্ষ কিছু সাইন্স-মিউজিয়াম এর উদাহরণ দেওয়া যাক-

১. The Natural History Museum, London:

বিশ্বের সেরা বিজ্ঞান জাদুঘরগুলির মধ্যে একটি। নাম থেকেই বোঝা যায় এই জাদুঘরের সংগ্রহের বিষয় হল প্রাকৃতিক ইতিহাস যেমন- প্রাণী, উদ্ভিদ, মানব জীববিজ্ঞান, খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুঘরগুলির মধ্যে একটি।

২. The Exploratorium, San Fransisco:

সম্পূর্ণ শিক্ষামূলক গবেষণা আর প্রদর্শনীতে পূর্ণ এই জাদুঘরটি কিন্তু আর পাঁচটা জাদুঘর থেকে আলাদা সত্ত্বা ধারণ করেছে। এর প্রধান মিশন হল তরুণ বিজ্ঞানীদের দেখানো যে বিজ্ঞান কতটা উত্তেজনাপূর্ণ আর আকর্ষণীয় হতে পারে। “আমাদের ভিশন এমন একটি পৃথিবী থাকবে যেখানে মানুষ নিজে চিন্তা করবে এবং আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রশ্ন করতে পারবে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে এবং তাদের চারপাশের বিশ্বকে জানতে পারবে।”

৩. সুইজারল্যান্ডের সুইস মিউজিয়াম অব ট্রান্সপোর্ট:

বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে পরিপূর্ণ সুইস মিউজিয়াম অব ট্রান্সপোর্ট (Verkehrshaus der Schweiz) সুইজারল্যান্ডের লুসার্নে অবস্থিত। বেশিরভাগ প্রদর্শনী  1900 এর দশকের গোড়ার দিক থেকে সুইস গাড়ির মডেল হলেও এতে প্লেন, ট্রেন, দোকান এবং কিছু যোগাযোগ প্রযুক্তি রয়েছে। জাদুঘরটি 1959 সালে স্থাপিত হয় এবং দ্রুত সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় জাদুঘরে পরিণত হয়। কিন্তু এটা শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জাদুঘর যে তা কিন্তু একদমই নয় – এখানে শিল্পী হ্যান্স এরনির কাজের একটি বিশাল সংগ্রহও রয়েছে।

৪. The National Air and Space Museum, Washington D.C.:

ওয়াশিংটন ডিসির “ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম” স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের অংশ এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞান জাদুঘর। এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা এভিয়েশন এবং হিউম্যান ফ্লাইট হিস্ট্রি মিউজিয়াম। জাদুঘরের প্রদর্শনীগুলি আপনাকে একটি ভ্রমণের ভিজ্যুয়াল ফিস্টে নিয়ে যায়। আপনি যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিশেষ করে এভিয়েশন পছন্দ করেন, তাহলে এটি আপনার জন্য একটি  অন্যতম ভ্রমণস্থান হতে পারে।

৫. Te Papa Museum, Wellington, New Zealand:

ওয়েলিংটনের তে পাপা মিউজিয়াম নিউজিল্যান্ডের জাতীয় জাদুঘর। “তে পাপা” নামটি “মাওরি” ভাষা থেকে আগত। জাতীয় জাদুঘর এবং জাতীয় শিল্প গ্যালারির সাথে একীভূত হওয়ার পর 1998 সালে জাদুঘরটি তার দরজা খুলে দেয়। এর প্রদর্শনীগুলি একচেটিয়াভাবে বৈজ্ঞানিক নয়, তবে এতে জীবাশ্ম, প্রত্নতত্ত্ব, উদ্ভিদের নমুনা, পাখির নমুনা এবং উভচর, সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিস্তর সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়াও এটি শিল্পকলা, ইতিহাস, তাওঙ্গা মাওরি এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় সংস্কৃতি প্রদর্শন করে।

জ্ঞান অন্বেষণ কিংবা বিনোদন- যেকোনো কিছুতেই জাদুঘরের অবদান অনন্য। তাইতো জাদুঘর- ইতিহাস সংরক্ষণের এক অনন্য জাদুকর।

লিখেছে: টিম সেঁজুতি সাহা, ক্যাম্পাস এম্বাসেডর ব্যাচ-২, সায়েন্স বী।

Exit mobile version