বিজ্ঞান ব্লগ

শিশুতোষ বিজ্ঞানে জাফর ইকবাল স্যার এবং তার প্যাটেন্টগুলো

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অন্যতম পথিকৃত মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি একাধারে লেখক, পদার্থবিদ এবং শিক্ষাবিদ। এছাড়া তিনি জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক এবং কলাম লেখক। সহজ সরল ভাষায় সাদাসিধে কথা বলার জন্যও তিনি সুপরিচিত। তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত করা হয়েছে। তিনি সর্বশেষ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন। 

আজ বাংলাদেশের কল্পবিজ্ঞানের সম্রাট ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ৬৯তম জন্মদিন আজ।

একটি জরিপের তথ্য অনুসারে, তিনি লেখক হিসেবে বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে; জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৫০ জনের মধ্যে ২৩৫ জনই (৫২.২২%) তার পক্ষে মত দিয়েছিলেন।
জাফর ইকবালের ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুক্তিযুদ্ধা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। পিতার পুলিশের চাকরির সুবাদে তার ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আগে ছিল বাবুল।
তার পিতা লেখালেখির চর্চা করতেন এবং পরিবারের এই সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়ায় জাফর ইকবাল খুব অল্প বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন। এটিকে তিনি তার সহজ ভাষায় লিখতে পারার গুণের কারণ বলে মনে করেন। সাত বছর বয়সে তিনি তার প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন।

ফয়জুর রহমান আহমেদ একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন যিনি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন।১৯৭১ সালের ৫ মে পাকিস্তানী আর্মি এক নদীর ধারে তার পিতাকে গুলি করে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া জাফর ইকবালকে পিতার কবর খুঁড়ে তার মাকে স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারটি বিশ্বাস করাতে হয়েছিল।

নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ তার বড় ভাই, হুমায়ূন আহমেদ লেখক ও মুভি নির্মাতা ছিলেন। অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন তিনি। এর মধ্যে হিমু এবং মিসির আলী সিরিজের বই গুলো তরুন সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। ১৯ জুলাই ২০১২ তে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। রম্য ম্যাগাজিন উন্মাদের সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট, সাহিত্যিক আহসান হাবিব তার ছোট ভাই। জাফর ইকবালের তিন বোন । তাঁরা হলেন, সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ, রোকসানা আহমেদ।

 

১৯৭৮ সালে আমেরিকায় থাকাকালীন সময়ে লেখক তারই সহপাঠী ইয়াসমিন হকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ইয়াসমিন হক বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করছেন।

 

মজাদার বিবাহিত জীবন:

জাফর ইকবাল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারই সহপাঠী ইয়াসমিন হকের সাথে। লেখকের বিয়ে নিয়ে একটা মজার ঘটনা হলো-

 

লেখকের বাবা ভবিষ্যত বলার বিষয় নিয়ে খুব উৎসাহিত ছিলেন, তাই ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও নানা রকম বই থাকতো বাড়িতে।যেহেতু বাড়িতে বই পত্র আছে তাই লেখকরা সকল ভাই বোন কম বেশি হাত দেখতে শিখে গেছেন। ভার্সিটি তে উঠতে উঠতে লেখকের খুব নামডাক হয়ে গিয়েছিল হাত দেখার জন্য।তাই তিনি প্রত্যেকের হাত দেখার জন্য এক প্যাকেট গোল্ড ফ্ল্যাক সিগারেট নির্ধারন করে দিয়েছিলেন।মোটা মুটি সবাই এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসে হাত দেখিয়েছিল।

শুধু একটা মেয়েই বাকি ছিল। সেও একদিন গোল্ড ফ্ল্যাক সিগারেট নিয়ে হাত দেখাতে চলে আসলো। লেখক তাকে বলেছিল, অনেক ধনীর সাথে তাঁর বিয়ে হবে।কিছুদিন পরেই লেখকের সঙ্গে তার (ইয়াসমিন হক)বিয়ে হয়।বিয়ের রাতে লেখকের সহধর্মিনী লেখকের শার্টের কলার ধরে বলেছিল,”আমার নাকি খুব বড় লোকের সাথে বিয়ে হবে?” বিয়ের খরচের জন্য লেখক তার সহধর্মিনীর থেকেই কিছু টাকা ধার করেছিলেন। এরপর থেকে লেখক আর হাত দেখেননি কারো।

শিক্ষা জীবন:
জাফর ইকবাল ১৯৬৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। তাঁর বিষয় ছিল – ‘Parity violation in Hydrogen Atom. সেখানে পিএইচডি করার পর বিখ্যাত ক্যালটেক থেকে তার ডক্টরেট-উত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন।
কর্মজীবন:

ড. জাফর ইকবাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন যথাক্রমে ১৯৭৫ ও ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৫ সালে অনার্স-এ দুই নম্বরের ব্যবধানে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৮২ তে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি সম্পন্ন করে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সাফল্যের সাথে ডক্টরেটোত্তর গবেষণা সম্পন্ন করেন।

১৯৮৮ তে তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) এ গবেষক হিসাবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৪ পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেন। ওই বছরেই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য মনোনীত হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।

স্বত্বসমূহ:
পেটেন্ট নং: 5550818, শিরোনাম: System for wavelength division multiplexing/asynchronous transfer mode switching for network communication
পেটেন্ট নং: 622611, শিরোনাম: Inter-ring cross-connect for survivable multi-wavelength optical communication networks।
পেটেন্ট নং: 5392154, শিরোনাম: Self-regulating multi-wavelength optical amplifier module for scalable lightwave communications systems
জার্নালে প্রকাশনা:
A Technique for Measuring Parity non Conservation in Hydrogenic Atom, E. G. Adelberger, T. A. Trainor, E. N. Fortson, T. E. Chupp, এম. জে. ইকবাল and H. E. Swanson, Nucl. Inst. Meth. 179 (১৯৮১) ১৮১।
Study of Prototype Xenon TPC, এম. জে. ইকবাল, B. G. O’Callaghan, F. Boehm, Nucl. Inst. Meth. A243 (১৯৮৬) ৪৫৯।
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত সনদ সমুহ:
10 Gb/s Direct Detection Lightwave Technology, এম. জে. ইকবাল, OFC ৯১, সান দিয়েগো- ১৯৯১।
10 Gbits/s DFB MODFET Transmitter OEICs for High-Speed Transmission and Optical Interconnects., T. P. Lee, Y. H. Lo, R. Bhat, P. Grabbe, M. Bagheri, এম. জে. ইকবাল, কার্যপ্রণালী। OEC ৯০, 13A2-6, চিবা, জাপান জুলাই ১৯৯০।
10 Gbits/s Direct Differential Phase Shift Keying Modulation and Direct Detection Experiment, R. S. Vodhanel, এম. জে. ইকবাল, J. L. Gimlett and L. Curtis, CLEO ’90, অ্যানাহেম, ক্যালিফোর্নিয়া, ১৯৯০।
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অবদানের নিবন্ধসমূহ:
A Xenon Time Projection Chamber for Double Beta Decay, এম. জে. ইকবাল ও অন্যান্য। ১৯৮৭ সালে টেলিকম সম্মেলনের কার্যপ্রণালি।
বইয়ের অনুচ্ছেদ:
A Xenon Time Projection Chamber for Double Beta Decay, F. Boehm and এম. জে. ইকবাল, Festival- Festschrift for Val Talegdi, Ed K. Winter, আমস্টারডাম, উত্তর হল্যান্ড, ১৯৮৮।
অভ্যন্তরীণ সঞ্চালনের জন্য প্রায়োগিক স্মারক:

10 Gb/s Optical Receiver using 978 om Diode Pumped Erbium Doped Fiber Preamplifier, এম. জে. ইকবাল, V. Shah, D. Daniel, L. Curtis, L. Curtis, J. L. Gimlett and R. I. Laming, TM ARH-016-877।

 

সাহিত্যিক মোহাম্মদ জাফর ইকবাল:

জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই লেখালেখি করেন। তার প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীমূলক গল্প কপোট্রনিক ভালোবাসা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা। এর উত্তর হিসেবে তিনি একই ধরণের বেশ কয়েকটি বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান।

তার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে এই গল্পগুলো নিয়ে কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বইটি পড়ে শহীদ-জননী জাহানারা ইমাম খুবই প্রশংসা করেন এবং এই ঘটনায় তিনি এ ধরণের আরও বই লিখতে উৎসাহিত হন। তার প্রথম দিকের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীগুলো পাঠকমহলে সমাদৃত হয়। সুদূর আমেরিকাতে বসে তিনি বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনা করেন। দেশে ফিরে এসেও তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী লিখে যাচ্ছেন, প্রতি বইমেলাতে তার নতুন সায়েন্স ফিকশান কেনার জন্যে পাঠকেরা ভীড় জমায়।

তিনি কিশোর উপন্যাসের লেখক হিসেবেও অত্যন্ত সফল। এই শাখাতেই তার প্রতিভা সর্বোচ্চ শিখর ছুঁয়েছে। তার লেখা অনেকগুলো কিশোর উপন্যাস বাংলা কিশোর-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তার একাধিক কিশোর উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

তার বৈশিষ্ট্যসূচক সহজ ভাষায় লেখা কলামগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক কালের কন্ঠ সহ একাধিক পত্রিকাতে সাদাসিধে কথা নামে নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। তাঁর লেখা কলামগুলোতে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনা এবং দেশপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর স্বাধীনতা-বিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি মত প্রকাশ এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধারক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবী ছাত্র সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে অবস্থান বিভিন্ন সময় প্রতিক্রিয়াশীলদের রোষানলে পড়েছে। বেশকিছু দিন উনি প্রিয়.কম-এ কলাম লিখেছেন।

 

বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড গড়ে তোলার পিছনে তাঁর অসামান্য অবদান রয়েছে। গণিত শিক্ষার উপর তিনি ও অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বেশ কয়েকটি বই রচনা করেছেন। এর মাঝে “নিউরনে অনুরণন” ও “নিউরনে আবারো অনুরণন” বই দুটি গণিতে আগ্রহীদের কাছে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
পুরস্কার ও সম্মননা:
লেখক হিসেবে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল অসংখ্য পুরষ্কার অর্জন করেন। বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০০৪ সালে সাহিত্যের অন্যতম শাখা সায়েন্স ফিকশনে অবদান রাখার জন্য পুরষ্কৃত হন। শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে ২০০৫ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার লাভ করেন। ২০০২ সালে কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক, খালেদা চৌধুরি সাহিত্য পদক, ২০০৩ সালেশেলটেক সাহিত্য পদক, ২০০৪ সালে ইউরো শিশুসাহিত্য পদকলাভ করেন। এছাড়াও ২০০৫ সালে তিনি আমেরিকা এল্যাইমনি এ্যসোসিয়েশন পদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালাইমনি এ্যাসোসিয়েশন পদক লাভ করেন।
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, মানবের মন আলোকিত করে সাহিত্য জগতকে নতুন নতুন চিন্তাধারা দিয়ে শুশোভিত করছে এমনই একটি নাম। ড জাফর ইকবালের জীবনী বিষয়ক এই আর্টিকেলে হয়ত লেখকের জীবনের সব কিছু আনা সম্ভব হয় নি।
অন্যের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে সময় নষ্ট না করে নিজেকে বরং উপযোগী করে তোল যাতে অন্যরা তোমার অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে।
-মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

এই গুণি লেখকের এ পর্যন্ত সায়েন্স ফিকশন, ভৌতিক রচনাবলি, শিশুতোষ রচনাবলি, ইতিহাস, কিশোর উপন্যাস, উপন্যাস, স্মৃতিচারণা, ছোটগল্পসহ দেড় শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। গণিত অলিম্পিয়াডসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি।

Exit mobile version