বিজ্ঞান ব্লগ

জ্বলন্ত অগ্নিস্রোতের উপর প্রাণীকুলের বসবাস

বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের একটি ক্ষুদ্র অংশ আমাদের এই সৌরজগৎ ‘মিল্কি ওয়ে’। এই সৌরজগৎ এর একটি গ্রহ আমাদের পৃথিবী। এটি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মধ্যে এখনো পর্যন্ত খুজে পাওয়া এক মাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের স্পন্দন রয়েছে। একটা সুন্দর বায়ুমন্ডল, বৃহৎ জলরাশি, বৈচিত্রময় প্রকৃতির সাথে মিশে আছে হাজার হাজার প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু কখনো কি আমরা ভেবে দেখেছি এই বৃহৎ পৃথিবীর অভ্যন্তরে কি আছে? কেনোই বা আমরা পৃথিবী পৃষ্টে বসবাস করছি?
পৃথিবী পৃষ্টে শক্ত মাটির উপর আমরা বসবাস করলেও আমাদের পায়ের নিচে মাটির অভ্যন্তরে আছে প্রবাহমান অগ্নিস্রোত। সেই অগ্নিস্রোতের টগবগে আগুনের উত্তাপ এতটাই বেশি যে তার সংস্পর্শে আসলে চোখের পলকে ছাইয়ে রূপান্তরিত হবে সব কিছু। এখন কি মনে প্রশ্ন জাগে না যে পৃথিবীর অভ্যন্তরে অগ্নিস্রোত প্রবাহমান হলে আমারা কিভাবে পৃথিবী পৃষ্টে বসবাস করছি?
তার আগে আমাদের জানতে হবে পৃথিবীর গঠন সম্পর্কে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর অভ্যন্তরকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছে।
১. বাদামী বর্ণের ক্রাস্ট বা ভূত্বকঃ
সমুদ্র পৃষ্ট থেকে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রায় ৭০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত অংশকে বলা হয় ভূত্বক। মাটি, পানি, পাথর, সাগর, মহাদেশ, পাহাড়-পর্বত সমস্ত কিছুই এই ভূত্বকের অংশ। মুলত এই ক্ষুদ্র অংশ ভূত্বকের কারনেই পৃথিবী নামক গ্রহে প্রাণের স্পন্দণ এখনো টিকে রয়েছে।

খাবার উপযোগী পানি সরবরাহের জন্য আমরা নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করি। প্রথমে শক্ত মাটি, তারপরে নরম মাটি, বালি মাটি, পাথুরে মাটি এসব ভেদ করে মিষ্টি পানির একটা বৃহৎ উঃস থেকে পানি উত্তোলন করা হয়।

কিন্তু সাধারনভাবে এই বালি মাটির পরে পানি উত্তোলেন জন্য আর খনণ করা সম্ভব হয় না। কারন শক্ত পাথর ভেদ করে যাওয়া নিতান্তই সহজ কাজ নয়। এই পাথুরে স্তরটাই এক প্রকার ব্লক হিসেবে কাজ করে। মাত্র এই ৭০ কি.মি. বিস্তৃত অংশই পৃথিবী নামক গ্রহে সবুজ বৈচিত্রের মধ্যে প্রানের উৎসের মুল কারন।

মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে পড়ন্ত সকল বস্তু-উল্কাপাত,ধূমকেতু,অগ্নিগোলক এবং অন্যান্য বস্তু সম্পর্কে জানতে ক্লিক করো এখানে

২. লাল বর্ণের ম্যান্টলঃ
ভূত্বকের পরবর্তি অংশ থেকেই মুলত অগ্নি যাত্রা শুরু। ভূত্বকের শেষ অংশ থেকে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রায় ২৯০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এই অঞ্চলটির নাম ম্যান্টল। যার তাপমাত্রা ২০০° সেন্টিগ্রেড থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০০০° সেন্টিগ্রেড। নিশ্চই বুঝতে পারছেন কতটাই উত্তপ্ত এই অঞ্চল।

যেখানে পৃথিবী পৃষ্টে ১০০° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ভালো ভাবে মাংস সিদ্ধ হয়ে যায়, সেখানে ম্যান্টলের তাপমাত্রা ৪০০০° সেন্টিগ্রেড। ভেবে দেখুন এই তাপমাত্রার সংষ্পর্শে গেলে কি অবস্থা হবে।
এ যেন একটা আগুনের সমুদ্র। যেখানে জলরাশির মত অগ্নিস্রোত প্রবাহমান।

তবে ম্যান্টলের উপরের অংশের তুলনায় ক্রমশ নিচের দিকে আঠাল। তবুও প্রবাহমান এই অগ্নি সমুদ্র নিতান্তই অনিয়মিত। তবে এখানেই শেষ নয়,
৩. মজ্জা বা কোরঃ
এই মজ্জা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। কমলা রঙের বহিঃস্থ মজ্জা এবং সূর্যের ন্যায় হলুদ রঙের অন্তঃস্থ মজ্জা। ম্যান্টলের শেষ অংশ থেকে অভ্যন্তরে প্রায় ২৩০০ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটি হলো বহিঃস্থ মজ্জা, যার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৫০০০° সেন্টিগ্রেড।

আর এই বহিঃস্থ মজ্জার শেষ অংশ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত প্রায় ১২২০ কি.মি. বিস্তৃত অঞ্চলটি হলো অন্তঃস্ত মজ্জা, যার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৬০০০° সেন্টিগ্রেড। এই তাপমাত্রা সূর্যের বহিঃস্থ তাপমাত্রার সমান। যে কারনে সূর্যের ন্যায় অন্তঃস্ত মজ্জার রঙ হলদেটে ভাব দেখায়।

যেখানে পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ কোটি কি.মি. দুরে অবস্থিত সূর্যের দিকে আমরা খালি চোখে তাকাতে পারি না, এমনকি গ্রীষ্মের দিনে বাহিরে হাটতে গেলেও প্রচন্ড তাপে শরীর জ্বলে যাওয়ার অনুভব হয়, সেখানে সূর্যের কাছে যাওয়া মানেই নিমিশেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া।

সূর্যের এই বহিঃস্থ তাপমাত্রার সমান আমাদের পৃথিবীর কেন্দ্রের তাপমাত্রা। তাহলে নিশ্চই বুঝতে পারছেন আমাদের এই বৈচিত্র্যময় সুন্দর পৃথিবীর অভ্যন্তর কতটাই উত্তপ্ত? আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভার টগবগে স্রোতের সংস্পর্শে সব কিছু ছাঁই হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর অভ্যন্তরের অবস্থা কতটা ভয়ংকর?

অভ্যন্তরে এতো ভয়ংকর অগ্নি গোলক থাকা সত্ত্বেও পৃথিবী পৃষ্টে মনোমুগ্ধকর বৈচিত্র্যের মাঝে হাজার হাজার প্রাণী ছুটে চলেছে অনবরত জিবনধারায়। ডায়নোচরের বিনাসকালের অগ্নিবলয় পার করে, বরফ যুগের আস্তরন ভেদ করে এখনো টিকে আছে আমাদের এই সুন্দর সবুজ পৃথিবী। আর এভাবেই বিবর্তন চলতে থাকবে পৃথিবীর অন্তিমকাল পর্যন্ত।

Emdadul Haque Emu
University of Barishal
Exit mobile version