বিজ্ঞান ব্লগ

টেরেন্স টাও- এই প্রজন্মের সেরা গণিতবীদের গল্প!

গণিতের জগতে পিথাগোরাস, নিউটন কিংবা লামির নাম কমবেশি আমরা সবাই শুনলেও টেরেন্স টাও-এর নাম শুনেছেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কাছে তিনি গণিতের এক জাদুকর। তার আইকিউ ২৩০ যা আইনস্টাইন কিংবা নিউটনের থেকে বেশি তো বটেই, পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি আইকিউর অধিকারী। গণিতকে ভালোবেসে নিজের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান বানানো এই গণিতবীদকে অনেকে এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গণিতবীদ বলে আখ্যা দেন।

টেরেন্স টাও এর জন্ম ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে। তার পিতা-মাতা ছিলেন হংকং এর আদি বাসিন্দা। ১৯৭২ সালে তারা স্থায়ী ভাবে পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। টেরেন্স টাও এর পিতা ছিলেন একজন পুষ্টিবিদ এবং মা ছিলেন হাইস্কুলের গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। ৩ ভাই এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট টেরেন্স টাও এর মধ্যে তার মা-বাবার সকল ভালো বৈশিষ্ট্য গুলো লক্ষ্য করা যায় ছোট বেলা থেকেই। টাও এর বয়স যখন দুই তখনই তারা বাবা-মা বুঝে যায় তাদের ছেলে অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা। তার বয়স যখন ২ বছর তখনই সে তার থেকে বড় অন্য বাচ্চাদেরকে উচ্চারণ করা শেখানো শুরু করে। পাশাপাশি সাধারণ যোগ-বিয়োগও আয়ত্ব করে ফেলে।

টেরেন্স-টাও-গণিতবীদযখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় সে এগুলো শিখলো কীভাবে? সে জবাব দেয়, “আমি এগুলো টিভিতে কার্টুন দেখে শিখেছি।”

মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি অ্যাডিলেডের ব্লাকউড হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে যান। তার প্রতিভার জন্য খুব দ্রত তিনি সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এই বয়সেই ক্যালকুলাসের মত জটিল জিনিস আয়ত্ব করে ফেলেন। জন হপকিন্সের ‘স্টাডি অফ এক্সেপশোনাল টেলেন্ট‘ প্রোগ্রামের ইতিহাসে তিনি মাত্র দুই জন ব্যক্তির মধ্যে একজন যিনি স্যাট এক্সামের গণিত অংশে ৭০০ বা এর থেকে বেশি নম্বর পেয়েছেন। এই পরীক্ষায় তিনি গণিত অংশে ৭৬০ পয়েন্ট অর্জন করেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এই সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৮। শুধু তাই নয় মাত্র ৯ বছর বয়সেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের গণিতের কোর্স করা শুরু করেন।

১০ বছর বয়সে তিনি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেন। এর থেকে কম বয়সে আর কেউ কখনও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়নি। তিনি যথাক্রনে ১৯৮৬, ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালে ব্রোঞ্জ, সিলভার এবং গোল্ড মেডেল লাভ করেন। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম বয়সে এই ৩টি মেডেল অর্জনের কৃতিত্ব তার দখলেই রয়েছে। তিনি যখন গোল্ড মেডেল জিতেছিলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৩।

তার বয়স যখন ১১ তখন তিনি অ্যাডিলেডের ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করা শুরু করেন। পাশাপাশি তার হাইস্কুলের সাধারণ ক্লাসগুলোতেও অংশ নিতে থাকেন।

মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি তার জীবনের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন৷ এরপরে যথাক্রমে ১৯৯১ এবং ১৯৯২ সালে তিনি ফ্লিন্ডার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্সের ডিগ্রি অর্জন করেন। তার এই অসামান্য প্রতিভার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণ পদক লাভ করেন। পাশাপাশি তাকে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ প্রদান করা হয়। এই দুইটি অর্জনের কারণে তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান।

মাত্র ২১ বছর বয়সে টাও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এরপর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্ত হন। ২৪ বছর বয়সেই তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইউসিএলএ) ফুল-টাইম প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত হন। এত কম বয়সে এই সুযোগ আর কেউ পাননি। বর্তমানে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হিসেবেই কর্মরত রয়েছেন।

গণিতের জগতে টাও বিখ্যাত হয়ে আছেন তার এবং ব্রিটিশ গণিতবীদ বেন যে গ্রিনের যৌথভাবে গ্রিন-টাও থিওরাম প্রমাণের জন্য। তিনি তার জীবনকালে অসংখ্য পুরষ্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন৷ তিনি দ্যা রয়াল সোসাইটি, অস্ট্রেলিয়ান অ্যাকাডেমী অফ সায়েন্স, দ্যা ন্যাশনাল অ্যাকাডেমী অফ সায়েন্স, আমেরিকাম অ্যাকাডেমী অফ আর্টস এন্ড সায়েন্স, আমেরিকার ফিলোসোফি সোসাইটি এবং আমেরিকান ম্যাথামেথিকাল সোসাইটির সদস্য।

মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে তিনি গণিতের নোবেল খ‍্যাত ফিল্ডস মেডেল (Fields Medal) অর্জন করেন। এর পাশাপাশি তিনি ক্লে রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড, ম্যাকআর্থার অ্যাওয়ার্ড এবং ব্রেকথ্রু প্রাইজ ইন ম্যাথামেটিকসের মত মোট ২৬টি পুরষ্কার অর্জন করেছেন।
২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী এই প্রফেসর ৩৫০ টি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ এবং ১৭ টি বই প্রকাশ করেছেন। তার গবেষণায় হারমোনিক বিশ্লেষণ, আংশিক ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ, বীজগণিত সংমিশ্রণ, গাণিতিক সংমিশ্রণ, জ্যামিতিক সংমিশ্রণ, সম্ভাব্যতা তত্ত্ব, সংকুচিত সেন্সিং এবং বিশ্লেষণাত্মক সংখ্যা তত্ত্ব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

৪৬ বছর বয়সী টেরেন্স টাও এর কাছ থেকে আমাদের এখনও অনেক কিছু পাওয়ার আছে। জীবনের বাকি সময়টায় গণিতের আরো জটিল জটিল বিষয়গুলোকে সমাধান করে গণিত জগতকে তিনি আরো সমৃদ্ধ করে তুলবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

Exit mobile version