“ডিস্লেক্সিয়া” (Dyslexia) – টার্মটির সাথে হয়তো আমরা খুব বেশি পরিচিত নই এবং না হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয় !
ছোটবেলায় যখন স্কুলে যেতাম তখন অনেক সহপাঠীদের মধ্যেই কিছু সমস্যা দেখতে পেতাম অর্থাৎ তারা বাকিদের মতো স্বাভাবিক আচরণ করত না। তখন বড়রা কিংবা ওদের অভিভাবকগণ বিষয়টি ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারতেন না, এমনকি আজকালও এটি সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই বললেই চলে। তাছাড়া আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক শিশুকেই দেখি যাদের আচরণ অর্থাৎ পড়াশোনার প্যাটার্ন বাকিদের থেকে একটু আলাদা এবং তাদের এই সমস্যাটা আমরা প্রায়ই বুঝে উঠতে পারিনা।
তবে ডিস্লেক্সিয়া (Dyslexia) কি?
– এটি একটি লার্নিং ডিজঅর্ডার (Learning Disorder) এবং রিডিং ডিজএবিলিটি (Reading Disability) হিসেবেও পরিচিত। মানুষের মস্তিষ্কের যেই অংশ ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং করে সেই অংশে ডিস্লেক্সিয়া প্রভাব ফেলে। অনেক বাচ্চাদের মধ্যে দেখা যায় তারা ঠিকমতো শব্দ বানান করতে পারে না, এমনকি বানান করলেও সেটা বারবার শেখানোর পরও ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। “Dyslexia is a specific that is neurobiological in origin”– ডিস্লেক্সিয়াকে অনেকে গুরুতর সহকারে দেখেন না যার ফলে একটি বাচ্চার সারাজীবনেই র ডিস্লেক্সিয়ার প্রভাব দেখা যায় এবং এর প্রভাব মৃদু থেকে তীব্র হতে পারে।
কিন্তু ডিস্লেক্সিয়া কেন হয় অর্থাৎ এমন কি কিছু আছে যা এর পেছনে দায়ী?
-ডিস্লেক্সিয়া মূলত বংশগত কারণে হয়ে থাকে তথা পরিবারের কারও মধ্যে যদি পূর্বে ডিস্লেক্সিয়া থাকে তবে সেটি পরবর্তী প্রজন্মেও হতে পারে, যা নির্দিষ্ট কিছু জিনের জন্য দায়ী। আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, মস্তিষ্কের যে নির্দিষ্ট অংশ শব্দ প্রক্রিয়াজাত তথা প্রসেস করে সেই অংশে ত্রুটি থাকলেও ডিস্লেক্সিয়া হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এটি শ্রবণ বা দর্শন সংক্রান্ত সমস্যা নয় বরং এক ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা।
ডিস্লেক্সিয়া বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। তন্মধ্যে এখন পর্যন্ত শনাক্তকৃত কিছু ডিস্লেক্সিয়া হলো :
- প্রাইমারি ডিস্লেক্সিয়া (Primary Dyslexia) :ডিস্লেক্সিয়া এর মধ্যে এটি সবচেয়ে সাধারণ। মস্তিষ্কের বামপাশের সেরেব্রাল কর্টেক্সের কোনোরূপ অকার্যকারিতা তথা ডিসফাংশনের কারণে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। যারা প্রাইমারি ডিস্লেক্সিয়াতে ভোগে তাদেরকে জীবনে অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে যারা ইন্টারভেনশন পায় তারা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারে। তবে কয়েকজনের সারা জীবন কষ্ট করতে হয়।
- সেকেন্ডারি ডিস্লেক্সিয়া (Secondary Dyslexia) : ফিটাস বৃদ্ধির পাশাপাশি মস্তিষ্কের বৃদ্ধিতে কোনো প্রকার বাধার সৃষ্টি হলে সেই শিশুদের মধ্যে এ ধরণের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সেকেন্ডারি ডিস্লেক্সিয়ার অবসান ঘটে । তবে ছেলে শিশুদের মধ্যে সেকেন্ডারি ডিস্লেক্সিয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
- ট্রমা আইকিউ ডিস্লেক্সিয়া (Trauma IQ Dyslexia) : মস্তিষ্কের যেই অংশ পড়াশোনা ও লিখালিখির সাথে সম্পৃক্ত তথা নিয়ন্ত্রণ করে সেই অংশে কোনোরূপ আঘাত (Injury) ও ট্রমার কারনে এরূপ ডিস্লেক্সিয়া হতে পারে।
অন্যান্য ডিস্লেক্সিয়াগুলো হলো :
- ভিজ্যুয়াল ডিস্লেক্সিয়া (Visual Dyslexia) : এটি “Visual Processing Disorder” এর সাথে সম্পৃক্ত, যেখানে ব্যক্তি বা শিশু ঠিকমতো দর্শন সংকেত পায় না।
- অডিটরি ডিস্লেক্সিয়া (Auditory Dyslexia) : “Visual Processing Disorder” এর মতো এটিও “Audio Processing Disorder” এর সাথে সম্পৃক্ত।
- ডিসগ্রাফিয়া (Dysgraphia) : যখন কোনো শিশু ঠিকমতো পেন্সিল ধরে রাখতে পারে না ও লেখায় সমস্যা দেখা দেয় এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে যদি বাধার সম্মুখীন হতে হয় তবে সেটি ডিসগ্রাফিয়া হিসেবে পরিচিত।
ডিস্লেক্সিয়ার লক্ষণ : সাধারণত স্কুলে থাকাকালীন সময়ে ক্লাসের শিক্ষকরা ডিস্লেক্সিয়ার শিশুকে শনাক্ত করতে পারবেন না। তবে তারা কিছু লক্ষণ বুঝতে পারবেন, যার ফলে তারা অভিভাবকদের পরামর্শ দিতে পারবেন। ডিস্লেক্সিয়ার লক্ষণগুলো হলো :
১. দেরিতে ভাষা শেখা
২. বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ সমস্যা
৩. নতুন নতুন শব্দ খুব সহজে শিখতে না পারা
৪. রিডিং পড়া, বানান করা কিংবা লিখায় সমস্যার সৃষ্টি হওয়া
৫. কোনো কোনো বাচ্চার ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা কোন কিছুই মনে রাখতে পারে না যদিও সেটা তাদের প্রিয় জিনিস বা ভিডিও গেম এর সাথে সম্পৃক্ত হয়
৬. মাঝে মাঝে ডান হাত কিংবা বাম হাত দিয়েও লেখার সমস্যা দেখা যায়
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!
চোখের পাতা লাফানো : কি বলছে চিকিৎসাশাস্ত্র ? |
ডিস্লেক্সিয়ার কারনে অনেক শিশুদের শ্রবণ সংক্রান্ত কিছু সমস্যা (Auditory Problems) হতে পারে। যেমন-
১. সাধারণত একটি শিশু যখন কোনো কিছু শুনবে তখন সেটি মনে রাখতে পারবে না অথবা বুঝতে সমস্যা হবে
২. কোনো শব্দ বা বাক্য শুনলে সেটি পুণরায় উচ্চারণ করতে সমস্যা হবে
৩. কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বাচ্চারা যখন কোনো কিছু শোনার পর সেটি উচ্চারণ করতে পারবে না, তখন তারা ডিপ্রেশনে থাকবে এবং কোনো কিছুই মন দিয়ে করতে পারবে না। এছাড়া, বাচ্চারা স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত কার্যাবলীর সাথে দূরে সরে যেতে চাইবে এবং ঠিকমতো পড়াশোনা ও খেলাধুলা করতে চাইবে না। তাদের সব কিছুতেই এক ধরনের একঘেয়েমিতা কাজ করবে
৪. কোনো কিছুর প্রতি আবেগী হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও অনেক দেখা যায়
অতঃপর কোনো বাচ্চার মধ্যে ডিস্লেক্সিয়ার প্রবণতা বা লক্ষণগুলো দেখা দিলে শীঘ্রই কোনো চিকিৎসক বা সাইকোলজিস্ট এর পরামর্শ নেওয়া উচিত নতুবা বাচ্চার মধ্যে যে সমস্যাগুলো দেখা যাবে তা সারাজীবনই থেকে যাবে, যা ভবিষ্যতে সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়াতে পারে। অথবা যেসব বাচ্চাদের মধ্যে ডিস্লেক্সিয়া দেখা যায় তারা মানসিকভাবে অনেক ঝুকির শিকার হতে পারে এবং তাদের মধ্যে হাইপারএকটিভিটি ডিজঅর্ডার (ADHD) দেখা যায়।
যাই হোক, ডিস্লেক্সিয়া ভয়ের কিছু নয়। সময়মত যদি বাচ্চারা চিকিৎসা পায় তবে এটি নিরাময় করা সম্ভব। তাই ডিস্লেক্সিয়ার বাচ্চাদেরকে অবজ্ঞা বা অবহেলার চোখে না দেখে তাদের সমস্যাগুলো বুঝে উঠার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ে তারা যেন এর থেকে পরিত্রাণ পায় – এটিই যেন কাম্য !