বিজ্ঞান ব্লগ

ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী: প্রকৌশল জগতের এক নক্ষত্র

একটি দেশকে কাঠামোগত ভাবে সংস্কার করতে পুরকৌশল কাজ করে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। বাংলাদেশের পুরকৌশল জগতের একজন কিংবদন্তীর সাথে আপনাদের আজ পরিচয় করাবো। সম্প্রতি তাঁর নামে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল ভবনের নামকরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। অনেকেই হয়তো এতক্ষণে আন্দাজ করে ফেলেছেন কার কথা বলছি!

তাহলে আর হেঁয়ালি না করে বলেই ফেলি। বলছিলাম বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী-র কথা। তিনি একধারে কাজ করে গেছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, তথ্য প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে।

জীবনের প্রথমার্ধ ও শিক্ষাজীবন:

১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেটে, আবিদ রেজা চৌধুরী এবং হায়াতুন নেছা চৌধুরীর তৃতীয় সন্তান জামিলুর রেজা চৌধুরীর জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার প্রকৌশলী হিসেবে চাকরির সুবাদে তার শৈশবকালের সময়টা কেটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। শিক্ষাজীবনের শুরুর অংশটা কাটিয়েছেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। পরবর্তীতে, ঢাকায় এসে তিনি নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

১৯৫৭ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর ১৯৫৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন ।‌ পরবর্তীতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি হন তৎকালীন আহ্সানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন এবং ফলাফল প্রকাশের দিনই বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে তার হাতে চক-ডাস্টার ধরিয়ে দেন ক্লাস নেয়ার জন্য। সে বছরেই প্রভাষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়।

১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বার্মা ওয়েল বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে। তার মাস্টার্স অফ সায়েন্স করার বিষয় ছিলো অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং। কম্পিউটার এর সাহায্যে “কংক্রিট বিমে ফাটল”-এর ডিজাইন করা ছিলো থিসিসের টপিক। ১৯৬৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং গবেষণার বিষয় ছিলো Shear Wall and Structural Analysis of High Rise Building.

তাঁর জীবনের কিছু অনুপ্রেরণা মূলক ঘটনা:

ছোটবেলা থেকেই তিনি সংখ্যা নিয়ে ভাবতে অনেক পছন্দ করতেন, বিশেষ করে কোন একটা সংখ্যাকে গানিতিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতেন। তার এ ভাবনার আরম্ভ হয়েছিলো একটি ঘটনার মাধ্যমে। ১৯৫৩ সালে যখন তিনি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিস হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, তখন একজন গণিতের শিক্ষক তাকে একটি সমীকরণ সমাধান করতে বলেন। সমস্যা টি ছিলো,

“দুটি সংখ্যার গুণফলকে অপর দুটি সংখ্যার বর্গের বিয়োগফল হিসেবে প্রকাশ করার পদ্ধতির বিষয়ে।”

শিক্ষক ভেবেছিলেন তিনি সহজেই সমাধান বের করতে পারবেন। তবে, অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ায় সেই শিক্ষক মনে কিছুটা কষ্ট নিয়েই অংকটি করে দেন। সেখান থেকেই তাঁর সংখ্যা নিয়ে ভাবার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গিয়েছিল। তিনি ঐ গণিতের শিক্ষককে জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের একজন বলে গণ্য করেন।

এছাড়াও, তার পরিবারে গণিত নিয়ে আলোচনা হতো। স্কুল জীবন থেকেই তিনি বাবা, ভাই-বোন দের সাথে খাবার টেবিলে বসে গণিতের নাড়ী নক্ষত্র নিয়ে তুমুল আলোচনার অংশীদার হতেন।

তবে, তাঁর জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সংখ্যা বিশ্লেষণ এর পেছনে দাঁড়িয়ে গেলো আরেকটি কারণ। তিনি বড় বড় মানের মৌলিক সংখ্যা খুঁজে বের করতে চাইতেন। প্রযুক্তির এই যুগে কম্পিউটার যোগাযোগ ব্যবস্থা, তথ্য আদান-প্রদান, সাইবার জগতের নিরাপত্তা ইত্যাদির পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে ক্রিপটোগ্রাফি বা এনক্রিপশন পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়াটিতে “Encryption key” হিসেবে কাজ করে বড় বড় মানের মৌলিক সংখ্যা। তাই, নিরাপদ সাইবার জগত তৈরিতে সবচেয়ে বড় ও জটিল মৌলিক সংখ্যা খুঁজে বের করা তার কাছে বেশ জরুরী ব্যাপার বলে মনে হতো।

ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন ধাঁধা, Mind games সমাধান করতে ভালোবাসতেন।

আরেকটি অবাক করার বিষয় হলো, তিনি ১৯৫০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত যারা ম্যাট্রিকে সারা প্রদেশে প্রথম স্থান অর্জনকারীদের নাম, স্কুলের নাম, পরবর্তীতে কোথায় চাকরি করেছেন এসব মুখস্থ বলতে পারতেন। প্রখর স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে অনেক পুরনো ঘটনা তিনি সুস্পষ্ট ভাবে মনে ধারন করতে পারতেন।

ইংল্যান্ডে পিএইচডি করার সময়টাতে, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী-কে কম্পিউটারে উঁচু উঁচু ইমারত নকশা করার কাজে বিভিন্ন সমীকরণ বের করতে হতো এবং হাজার হাজার লাইন প্রোগ্রাম এর মাধ্যমে সেগুলো সমাধান করতে হতো। দ্বিতীয় প্রজন্মের মেইন ফ্রেম কম্পিউটার ফেরান্টি পেগাসাস ছিলো তাঁর ব্যবহৃত প্রথম কম্পিউটার। সেখান থেকেই তিনি কম্পিউটারকে ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেই বিষয়ে নজর দেয়া শুরু করেন। ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে এসে প্রফেসর আবদুল মতিন পাটোয়ারীর সহায়তা নিয়ে বুয়েটে সর্বপ্রথম কম্পিউটার ভিত্তিক সিলেবাস প্রণয়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম বুয়েটের শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখানোর দায়িত্ব পান এবং টানা এক দশক তিনি এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

এই কিংবদন্তীর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যসমগ্র:

 

অর্জন ও সম্মাননা:

প্রকৌশলী হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য তিনি দেশ ও বিদেশ কর্তৃক নানা সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

 

প্রকাশনা:

দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান স্বরূপ তাঁর ৭০ টির অধিক গবেষণাপত্র ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রকাশনার মূল বিষয়বস্তু ছিলো সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, নিম্ন-খরচের আবাসন, ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি, ঘুর্নিঝড় মোকাবেলায় নির্মাণ, রেট্রফিটিং, তথ্য প্রযুক্তি নীতিমালা, ইত্যাদি।

পড়তে ভুলবেন না এই ব্লগগুলি!! 

ডক্টর সেঁজুতি সাহা : এক অনবদ্য কৃতি বিজ্ঞানী

Quantum Gravity বা কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষণ: আদ্যপান্ত

দাম্পত্য জীবন:

তাঁর সহধর্মিণীর নাম সেলিনা নওরোজ চৌধুরী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন। তাঁর দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে কারিশমা ফারহিন চৌধুরী বড় এবং তিনিও বাবার মতো পেশায় পুরকৌশলী এবং ছেলে কাশিফ রেজা চৌধুরী তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশলী।

প্রকৌশল জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র ২৮ এপ্রিল ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তিনি আজীবন আলো ছড়িয়ে যাবেন তাঁর বিশেষ ‌কর্মকান্ডের মাধ্যমে।

কিছু স্বীকৃতি যেখানে উচ্চারিত হবে এই গুনী প্রকৌশলীর নাম:

৩ মে, ২০২০ এ, বাংলাদেশ ব্লক চেইন অলিম্পিয়াড পুরস্কার’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী চ্যাম্পিয়ন্স অ্যাওয়ার্ড’ রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল ভবনের নামকরণ তাঁর নামে করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ২০২১ সালের এপ্রিলে।

 

তরুণদের উদ্দেশ্যে তাঁর কিছু কথা এবং একটি স্বপ্নপূরনের দায়িত্ব:

ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী-র একটি স্বপ্ন, ২০৩০ সালের ভেতরে কোনো একজন বাংলাদেশির বিজ্ঞানের শাখায়(পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন অথবা ফিজিওলজি/মেডিসিন) নোবেল পদক পাওয়া।‌ তাঁর এই স্বপ্নপূরনে আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাজ করে যেতে হবে। এই স্বপ্নের বাস্তবে রূপ প্রদানের মাধ্যমেই হবে তাঁর প্রতি সঠিক সম্মান প্রদর্শন।

তরুণদের উদ্দেশ্যে তাঁর দেওয়া একটি সুন্দর উপদেশ হলো, মানবকল্যাণে কাজ করার প্রয়াস। তাই, পরিবেশের সকল পর্যায়ের মানুষের সাথে মেশার জন্য এবং তাদের মনোভাব সম্পর্কে ধারণা নিতে বলেছেন তিনি। এছাড়াও, তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা এবং বিশেষ করে বই পড়ার প্রতি নজর দিতে বলেছেন। গোটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম, ইতিহাস, পরিবর্তনের রূপরেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করতে বলেছেন। এমনকি সারাবিশ্বের রাজনীতি সম্পর্কেও জানতে হবে। মোটকথা শুধুমাত্র পড়াশোনা হলেই হবে না, এর সাথে থাকতে হবে চতুর্দিক সম্পর্কে জ্ঞান। শেখার আগ্রহ এবং সব সময় সততার সাথে নিয়মিত নিজ অবস্থান থেকে অনুশীলনের মাধ্যমেই আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে বলে তিনি মনে করেন।

তাই, এখন থেকেই আমাদের উচিত তাঁর মতাদর্শ অনুসরণ করা এবং তাঁর অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণ করে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়া।

 

 

তথ্যসূত্র: ce.buet.ac.bd, প্রথম আলোর বিজ্ঞানচিন্তায় দেয়া সাক্ষাৎকার, উইকিপিডিয়া।

 

 

Exit mobile version