বিজ্ঞান ব্লগ

প্রকৃতির দেবদূত প্রজাপতি: যা কিছু অজানা এবং অচেনা (২য় পর্ব)

‘প্রজাপতি’ শব্দটা শুনলে প্রথমেই আমাদের মাথায় রঙবেরঙের পাখাওয়ালা পতঙ্গের ছবি ভেসে ওঠে যারা কিনা মধু আহরণের উদ্দেশ্যে ক্ষণিকের জন্য কোনো ফুলের ওপরে বসে পরক্ষণেই উড়ে যায় এবং ফুলে ফুলে উড়েই এদের সময় কেটে যায়। হয়তো শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকার কারণে আমাদের অনেকেরই নানান রঙের প্রজাপতি দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি, তারপরেও একটু খেয়াল করলেই আমাদের চারপাশে অসংখ্য সুন্দর সুন্দর পাখাওয়ালা এসব পতঙ্গের দেখা মেলে, অনেক সময় আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের সামনেই এরা উড়ে চলে যায়!

যখনই আমরা কোনো প্রজাপতি দেখি, তখন আমাদের মনে অনেক ধরণের প্রশ্নেরই উদ্রেক ঘটে যেমন এদের ডানায় এরকম রঙের কারণ কি কিংবা এরা কি খায় কিংবা থাকে কোথায় ইত্যাদি! ঐ সময়ে আমাদের মনে এসব প্রশ্ন জাগলেও পরক্ষণেই ভুলে যাই কিংবা কম্পিউটারে বসে এসব জানতে যেয়ে ফেসবুকের রঙিন দুনিয়াতে হারিয়ে যেয়ে তা আর জানা হয়ে ওঠেনা !

প্রজাপতি হচ্ছে Lepidoptera বর্গের অন্তর্গত এক ধরণের পতঙ্গ পৃথিবীর বুকে যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। এই বর্গের অধীনে প্রধানত সাতটি পরিবার আছে এবং প্রতি পরিবারেই ভিন্ন ধরণের প্রজাপতির দেখা মেলে। এদের শরীর উজ্জ্বল রঙের এবং এরা দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রজাপতির বেশিরভাগ প্রজাতিই দিবাচর বলে এরা সহজেই নজর কাড়ে। এদের মাথায় প্রায় গোলাকার পুঞ্জাক্ষী রয়েছে। প্রজাপতির ১০ খন্ডে গঠিত দেহ আকৃতিতে অনেকটা বেলনের মত, শেষের ২-৩টি খন্ড যৌনাঙ্গে পরিণত হয়েছে।

প্রজাপতির গায়ে রংবেরঙের উৎস সম্পর্কে ১ম পর্বেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলাম, এছাড়াও ১ম পর্বে উত্তর আমেরিকার ৭০০টি প্রজাতির মধ্যে বহুল পরিচিত এবং আকর্ষণীয় ১৩টি প্রজাতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। এই দ্বিতীয় এবং শেষ পর্বেও আপনাদের আরো ১০টি প্রজাতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেব। তো চলুন পাঠক, আকর্ষণীয় আরো ১০টি প্রজাতি সম্বন্ধে জেনে নিই মজাদার কিছু তথ্য- 

১. Zebra Longwing (Heliconius charithonia)

এই সুন্দর প্রজাপতিটি মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে অধিক বিচরণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা এবং দক্ষিণ রাজ্যের টেক্সাসে এদের বিস্তৃতি লক্ষণীয়। তবে মাঝেমধ্যে মাইগ্রেশনের মাধ্যমে এরা দক্ষিণ হতে উত্তর অঞ্চলের দিকেও পরিভ্রমণ করে থাকে। এই প্রজাতির মধ্যে পূর্ণবয়স্করা প্রায় ৫০জন একইসাথে রাত্রিযাপন করে, আর পরদিন সকালে বিভিন্ন গাছপালায় মধু ভক্ষণের জন্যেও তারা একইসাথে বের হয়ে ছড়িয়ে যায়।

ক্যাটারপিলার বা শুঁয়োপোকা অবস্থায় থাকাকালীন এদের পিঠের ওপর কালো সরু দাগের সাথে সাদা আবরণ দেখা যায়। এছাড়া passionflower নামক এক প্রকার বিষাক্ত তরুলতার ডালপালা ভক্ষণ করায় অন্যান্য শিকারিদের থেকে রক্ষা পাবার জন্য এরা এক প্রকার কেমিকেল প্রোটেকশন পেয়ে থাকে।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!! 

মিলিয়ন বছরের ঘুমন্ত জীবের পুনরুত্থান

কোয়ারেন্টাইনে স্যার আইজ্যাক নিউটনের যতো আবিষ্কার

২. Northern Pearly-Eye (Enodia anthedon)

এ প্রজাপতিটি বিভিন্ন গাছের গুড়িতে পাওয়া যায় বলে, অনেক বিশেষজ্ঞই ধারণা করেন কেমোফ্লেজ নেবার জন্যই এর গায়ের রং বুঝি ঠিক একারনে অনেকটা বাদামি রঙের। আর তাই কাঠের গুড়ি বা জঙ্গলে উড়ন্ত এ ধরনের বড় প্রজাপতি খুঁজে পাওয়া তুলনামূলকভাবে কঠিন এবং যদি পোকাটি ফ্যাকাশে বাদামি রঙের হয় তবে ডানাগুলির সাথে দৃশ্যমান গোলাকার “চোখের মত দাগ” ভালোভাবেই ফুটে ওঠে এবং গাছের কাণ্ডে উল্লম্বভাবে অবতরণ করার দরুন এদের শনাক্ত করা তখনই সম্ভবপর হয়। সাধারণত উত্তর আমেরিকায় এই প্রজাতি অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। 

৩. Common Wood Nymph (Cercyonis pegala)

এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একটি প্রজাপতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপি অঞ্চলের প্রায় সর্বত্রই এদের দেখতে পাওয়া যায়। তবে মজার ব্যাপার, ভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা একই প্রজাতি যদি আপনি পর্যবেক্ষণ করেন, তবে নিশ্চিত থাকুন আপনি পুরোই ধোয়াশার মধ্যে পড়ে যাবেন। কেননা একই প্রজাতির হলেও এদের মধ্যে পরিবর্তনশীল অনেক পার্থক্য রয়েছে।

আমেরিকার পূর্ব অঞ্চলে থাকা এই প্রজাতির ডানাগুলো সাধারণত বড় হয়। তাছাড়া ডানায় গোলাকার চোখের মত দাগের সাথে উজ্জ্বল হলুদ রঙের ছোপ ছোপ দাগও থাকে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে থাকা প্রজাতিতে ডানায় গোলাকার চোখের দাগগুলো ক্ষুদ্র আকারে থাকে এবং এর সাথে কোনো হলুদ রঙের স্পট থাকেনা, তবে এরা আকারে পূর্বাঞ্চলের প্রজাতির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে থাকে। এরা সাধারণত ঘাস লতাপাতা ভক্ষণ করেই জীবিকা নির্বাহ করে।

৪. California Sister (Adelpha californica)

দেখতে আশ্চর্য রকমের সুন্দর এই প্রজাপতি, ক্যালিফোর্নিয়ায় বাস করা এই প্রজাতির আকার অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় খানিকটা বড়। অত্যন্ত দ্রুত চলাচল করতে পারা এই প্রজাপতি Northern Pearly-Eye প্রজাতির মতোই মৃত প্রাণী হতে রক্ত শোষণ করে বেঁচে থাকে, এছাড়া কাদার মধ্যে থাকতে এবং কাদা হতে জল শোষণ করতে এরা অধিক পছন্দ করে।

৫. Milbert’s Tortoiseshell (Aglais milberti)

৭০০টি প্রজাতির মধ্যে অনেক রেয়ার প্রজাতি রয়েছে যা আমি এখানে ইনক্লুড করিনি। তবে এই প্রজাতিটি রেয়ার হলেও দেখতে ভারী সুন্দর এবং একে শনাক্ত করাও অনেকটা কষ্টসাধ্য। অনেকেই ধারণা করেন পুরো উত্তর আমেরিকায় Milbert’s Tortoiseshell এর মত সুন্দর প্রজাপতি আর দ্বিতীয়টি নেই। গায়ের গাঢ় রং এবং ডানার বাহারি বর্ণের সমাহার দেখে আসলেই প্রজাপতি প্রেমীদের কাছে বিস্মিত হওয়া সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

৬. Red Admiral (Vanessa atalanta)

Red Admiral আরেক প্রজাতি যাকে দেখে কিছু এন্টমলোজিস্ট মনে করেন এটি Monarch প্রজাতির সংমিশ্রণ অর্থাৎ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই প্রজাতি প্রজাপতিদের বিবর্তনের একটি উৎকৃষ্ট ধারা বহন করে এসছে। এটি Monarch প্রজাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও এর ইউনিক গায়ের রং, ডানায় বর্ণের গঠনশৈলী মানুষকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। হয়ত কয়েক মিলিয়ন বছর পর এই প্রজাতি বিবর্তনের ধারা বজায় রেখে গায়ে আরো অনন্য রং ফুটিয়ে তুলবে বলে গবেষকরা ধারণা করছেন।

৭. The Buckeye (Junonia coenia)

প্রজাপতিটি এক ঝটকায় দেখে কি মনে হয়? খুব সুন্দর প্রজাপতি, তাই না? তবে দুঃখের ব্যাপার ছবিতে দেখা ব্যতীত সামনাসামনি কখনোই আপনি একে মন ভরে দেখতে পারবেন না। কেননা এরা এত দ্রুতই উড়ে যায় যে আপনি এর সৌন্দর্য দেখে বর্ণনা করবার সুযোগও পাবেন না। এ প্রজাতি পূর্ব থেকে উত্তর আমেরিকা জুড়েই সাধারণত অধিক দেখা যায়। এদের ডানার বর্ণ অনেকটা বড় চোখওয়ালা কোনো পাখি বা গিরগিটির মত দেখায় বলে হুট করে এটি ডানা মেলে ওড়া শুরু করলে একে দেখে অনেকেই ভড়কে যেতে পারেন। তবে পরবর্তীতে এর সৌন্দর্য দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য!

৮. Question Mark (Polygonia interrogationis)

এটি এক প্রকার অ্যাঙ্গেল বা কোণ আকারের প্রজাপতি যারা গ্রীষ্মের শেষের দিকেই অধিক বিচরণ করে। এর পিঠের দিক উজ্জ্বল কমলা রঙের এবং ডানার অংশটি কেমোফ্লেজ নেবার জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত বিধায় কোনো গাছের গুড়ি বা মৃত পাতার উপর এরা অনায়াসেই ছদ্মবেশ নিতে পারে। এর বডির নিচের দিকে সিলভার রঙের এক প্রকার আবরণ রয়েছে যা দেখতে অনেকটাই প্রশ্নবোধক চিহ্নের মত মনে হয় বিধায় এর নামকরণ Question Mark করা হয়েছে।

৯. Comma Butterfly (Polygonia c-album)

এই প্রজাপতিটি Question Mark প্রজাতির সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। এক কথায় বলতে গেলে এরা প্রায় দেখতে একইরকম, শুধু একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের বিপরীতে প্রজাতিটির নিম্নাংশে সিলভার কালারের কমা সদৃশ দাগ রয়েছে। এই প্রজাপতিটি যখন মরা কোনো পাতায় বা পুরনো কোনো রাস্তার মাঝে অবতরণ করে, তখন এর কেমোফ্লেজ একে খুঁজে পেতে পুরোই অসম্ভব করে তোলে। 

১০. Painted Lady (Vanessa cardui)

এ প্রজাতিটি সম্ভবত উত্তর আমেরিকার সর্বাধিক পরিচিত একটি প্রজাতি, কেননা একে ঐ অঞ্চলের প্রায় সবখানেই দেখা যায়। সাধারণত Monarch প্রজাতিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেক্সিকোয় অধিক পরিভ্রমণ করে বলে ঐ অঞ্চলগুলোতে এটি সর্বাধিক পরিচিত, তবে Painted Lady প্রজাতি বিশ্বের প্রায় যে কোনো অঞ্চলেই পাওয়া যায় বলে এটি পুরো বিশ্বজুড়েই বিখ্যাত। এছাড়া হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের এক প্রজাতির সাথে Painted Lady প্রজাতিটি অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ।

প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বে উল্লেখিত প্রজাতিগুলো সাধারণত উত্তর আমেরিকার খুবই কমন প্রজাতি এবং দেখতে ভারী সুন্দর বিধায় আরো প্রায় ৭০০টি প্রজাতির মধ্যে এদেরই বিস্তারিত বর্ণ্না উদ্ধৃত হয়েছে। এরা দেখতে যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি এদের চালচলন এবং বৈশিষ্ট্য গুলোও রোমাঞ্চকর। এজন্যেই তো প্রজাপতিকে বলা হয় সৌন্দর্য এবং পবিত্র প্রেমের প্রতীক! 

তথ্যসুত্রঃ owlcation, উইকি, রোরবাংলা

Exit mobile version