আমরা অনেক সময় খবরের কাগজ বা টিভিতে দেখতে পাই যে, মা-বাবার দ্বারা তাদের সদ্যজাত বা কম বয়সী শিশুর খুন হয়। গ্রাম এলাকায় এর পেছনের কারণ হিসেবে বলা হয় জিনে ধরা বা পারিবারিক কলহ ইত্যাদি কিন্তু 80% কেস খতিয়ে দেখলে যে কারণ পাওয়া যাবে তা হচ্ছে প্রসোবোত্তর বিষন্নতা। এই সিন্ড্রোমটি অনেকটা নিরবঘাতক এবং অধিকাংশ মানুষেরই অজানা।
প্রসোবত্তর বিষন্নতার কারণঃ
নতুন মা বা বাবা উভয়ই এই সিন্ড্রোমটির স্বীকার হতে পারে,তবে মায়েদের ক্ষেত্রেই আক্রান্তের হার বেশি। মূলত, বাচ্চা গর্ভে ধারণ থেকে শুরু করে প্রসব পর্যন্ত প্রায় এক বছর মায়েরা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে বাচ্চার সাথে যুক্ত থাকে এটাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার কারণ। প্রসবোত্তর বিষন্নতার কারণ শারিরীক, মানসিক, জিনগত, সামাজিক নানা সমস্যার সমন্বয়। এছাড়াও হরমোনাল পরিবর্তন এবং অনিদ্রা বিষন্নতার সৃষ্টি করতে পারে।
মায়েদের ক্ষেত্রে, শিশুর জন্মের এক সপ্তাহ থেকে এক মাসের মধ্যে এবং বাবাদের ক্ষেত্রে, প্রসবের ৩-৬ মাসের মধ্যে এই মুড ডিসঅর্ডারটির সূচনা হয়। পূর্বের প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা, পরিবারের মানসিক বিষন্নতার ইতিহাস, মানসিক চাপ, শিশু জন্মের সময় জটিলতা, সহায়তার অভাব অথবা ঔষধ ব্যবহার জনিত ব্যাধি ইত্যাদি কারণেও বিষন্নতাটির সৃষ্টি হতে পারে। যদিও প্রসোবত্তর বিষন্নতার মূল কারণ এখনোও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। নতুন মা যখন ডিপ্রেশনে ভোগে তখন বাবারও হতাশায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
লক্ষণঃ-
একজনের লক্ষণের উপর ভিত্তি করে তার বিষন্নতা হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা হয়। যদিও বেশিরভাগ মহিলাই প্রসবের পরে কিছু সময়ের জন্য উদ্বেগ বা অস্বস্তি অনুভব করেন, যদি লক্ষণগুলি গুরুতর হয় এবং দু সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকে তখন তাকে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতা বলে সন্দেহ করা যায়।
আবেগপ্রবণ
- স্থায়ী বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতা বা “খালি” লাগা
- প্রচন্ড মানসিক দোলাচল
- হতাশা, বিরক্ত হওয়া, অস্থিরতা, রাগ
- হতাশা বা অসহায় বোধ করার অনুভূতি
- দোষী মনে হওয়া, লজ্জায় থাকা, অপদার্থ মনে হওয়া
- নিজের প্রতি শ্রদ্ধা কম হওয়া
- হতবুদ্ধি অবস্থা, শূন্যতা, অবসাদ
- সান্ত্বনা গ্রহণ করতে না পারা
- শিশুর সঙ্গে বন্ধনে সমস্যা
- শিশুর যত্ন নিতে অপর্যাপ্ত বোধ করা
- স্বাভাবিক কাজে অনাগ্রহ বা পরিতোষের অভাব
- ক্ষমতার অভাব
- যৌন ইচ্ছার অভাব
- ক্ষুধাবোধে পরিবর্তন
- অবসাদ, শক্তি এবং প্রেরণা কমে যাওয়া
- নিজস্ব যত্নে অবহেলা করা
- সামাজিক দিক থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া
- অনিদ্রা বা অত্যধিক ঘুম
চেতনা
- সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং পরিষ্কারভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস,
- মনোযোগের অভাব এবং স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া,
- শিশুর যত্ন নিতে অপারগ মনে করা বা শিশুকে ভয় করা,
- নিজের, শিশুর বা সঙ্গীর ক্ষতি সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে থাকা।
শিশুর উপর প্রভাবঃ
প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা, স্বাভাবিক মা-শিশু বন্ধনে প্রভাব ফেলতে পারে এবং শিশুর উন্নয়নে স্বল্প মেয়াদী বা দীর্ঘস্থায়ী বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতার ফলে সন্তানের দেখাশোনার প্রতি অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। এই দেখাশোনায় অসঙ্গতি সন্তানের খাওয়ার সময়ে, ঘুমের সময়ে, এবং স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখার সময়ে লক্ষ্য করা যায়।প্রসবোত্তর হতাশায় আক্রান্ত মায়েদের বাচ্চাদের ঘুম এবং খাওয়া, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাঁদা এবং ভাষার বিকাশে বিলম্ব হওয়ার সমস্যা বেশি থাকে।
কিছু বিরল ক্ষেত্রে, প্রায় ১ থেকে ২ (প্রতি ১,০০০ জনে) প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা দেখা দেয় প্রসব পরবর্তী মানসিক ব্যাধি হিসেবে। অথবা পূর্ববর্তী মানসিক হাসপাতালে ভর্তির ইতিহাস সহ মহিলাদের মধ্যে, শিশুহত্যা দেখা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় প্রতি ১,০০,০০০ শিশুজন্মের মধ্যে ৮ জন শিশুহত্যার ঘটনার একটি মূল কারণ হচ্ছে প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা।বাংলাদেশে এই জরিপ করা হয়নি এখনো কিন্তু জরিপ করা হলে শিশু হত্যার সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের থেকে মোটেও কম হবে না।
প্রসব পরবর্তী নবজাতক মায়েরা যে ৫ ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেনঃ
১. বেবি ব্লু (Baby Blue)
২. পোস্টপার্টাম সাইকোসিস (Postpartum Psychosis)
৩. পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression)
৪. পোস্টপার্টাম এনক্সাআইটি (Postpartum Anxiety)
৫. পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (Post-Traumatic Stress Disorder)
প্রসবোত্তর হতাশা প্রতিরোধ
আপনার যদি হতাশার ইতিহাস থাকে এবং আপনি গর্ভবতী হয়ে গেছেন বা আপনি যদি গর্ভবতী হওয়ার পরিকল্পনা করছেন তবে আপনার ডাক্তারকে জানান।
- গর্ভাবস্থায় আপনার ডাক্তার আপনাকে লক্ষণগুলির জন্য নিরীক্ষণ করতে পারেন। আপনি কাউন্সেলিং বা অন্যান্য থেরাপির মাধ্যমে হালকা হতাশার লক্ষণগুলি বের করতে পারবেন। আপনার গর্ভবতী হওয়ার পরেও আপনার ডাক্তার ওষুধ লিখে দিতে পারেন।
- আপনার সন্তানের জন্মের পরে, আপনার চিকিৎসক হতাশার লক্ষণগুলির জন্য প্রাথমিক প্রসবোত্তর চেকআপের পরামর্শ দিতে পারে। আপনি যত তাড়াতাড়ি আপনার বিষন্নতা নির্ণয় করবেন, তত জলদি চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন। আপনার যদি প্রসবোত্তর হতাশার ইতিহাস থাকে তবে আপনার চিকিৎসক শিশু হওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন।
এখানের কয়েকটি টিপস যা আপনাকে সহায়তা করতে পারে:
- নিজের এবং শিশুর জন্য আপনার প্রত্যাশা সম্পর্কে বাস্তববাদী হন।
- অনুশীলন করুন, আপনার চিকিৎসকের বিধিনিষেধ মেনে চলুন; হাঁটুন, এবং ছুটির দিন ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
- অ্যালকোহল এবং ক্যাফিন ছাড়ুন।
- আপনার সঙ্গীর সাথে সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলুন – একে অপরের জন্য সময় তৈরি করুন।
- পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখুন – নিজেকে বিচ্ছিন্ন করবেন না।
- আপনার বাড়িতে দর্শকদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করুন।
- আপনার বাচ্চা যখন ঘুমায় তখন ঘুমোন বা বিশ্রাম করুন।
প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা কোনো লজ্জাজনক পরিস্থিতি নয়, ক্ষেত্র বিশেষে এটি মারাত্মক হতে পারে। আপনার ঘরের পাশেই আপনি সাহায্য পেতে পারেন। সাহস করে এগিয়ে আসুন আপনাকে সাহায্যের জন্য অনেকে আছেন আপনাকে সাহায্যের জন্য উন্মুখ। প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা যেহেতু ছেলেদেরও হয় তাই তাদেরও এই বিষয়টি নিয়ে জানতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য কোনো লজ্জাজনক অধ্যায় নয়, বরং আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়। আসুন আমরা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হই।
তথ্যসূত্রঃইন্টারনেট ( উইকিপিডিয়া, মায়ো ক্লিনিক)