বিজ্ঞান ব্লগ

প্লাস্টিক রিসাইকেল আর ব্যবহারের আদ্যপান্ত!

যদি প্লাস্টিকের বোতল বা পাত্র ভালোভাবে খেয়াল করে থাকেন তাহলে বোতলের গায়ে খোদাই করা তীর চিহ্ন দিয়ে তৈরি ত্রিভুজ হয়ত নিশ্চয়ই দেখেছেন। যদি আরো ভালোভাবে খেয়াল করে থাকেন তাহলে ঐ খোদাই করা ত্রিভুজের মধ্যে একটা সংখ্যা দেখে থাকবেন। তাহলে নিশ্চয় মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, সংখ্যা থাকার কারণটা কী?

এর পিছনে একটা অনেক বড় কারণ আছে এবং কারণটা গুরুতর!

প্রত্যেকটা ত্রিভুজের মধ্যে এক থেকে সাত পর্যন্ত সংখ্যা থাকে। মূলত প্লাস্টিকের ধরণ বোঝাতে ঐ সংখ্যাগুলো ব্যবহৃত হয়। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ঐ প্লাস্টিকের পণ্যটা রিসাইকেল করা যাবে কিনা এবং পুনরায় ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটা বোঝানো হয়। এমন অসংখ্য প্লাস্টিক আছে যেগুলো রিসাইকেল অর্থাৎ পুনর্ব্যবহার করা যায় না। এই সংখ্যাগুলো যারা রিসাইকেল করে তাদেরকে প্লাস্টিকের ধরণ বুঝতে সাহায্য করে। প্লাস্টিকের পাত্র গুলোতে আরো অন্যান্য সংখ্যা থাকতে পারে, তবে এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ত্রিভুজের মধ্যে থাকা সংখ্যাই গ্রহনযোগ্য। আবার ত্রিভুজের নিচে কখনো কখনো PET, HDPE ইত্যাদি লেখা থাকে। এগুলো আসলে ঐ প্লাস্টিকের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ।

 

এখন আপনি বলতে পারেন প্লাস্টিক তো প্লাস্টিকই,‌ এর মধ্যে আবার ভিন্নতা কিসের? প্লাস্টিকে থাকা কণা বা কণার সেটগুলোর পার্থক্যের কারণে এমন ভিন্নতা দেখা যায়। প্রত্যেকটা প্লাস্টিক পৃথক পৃথক অসংখ্য কণা দিয়ে তৈরি। রিসাইকেল করা হলেও কণাগুলো একসাথে মিশে না। একারণেই প্লাস্টিকের কণার ধরণ অনুযায়ী সেগুলোকে পৃথকভাবে দেখা হয়। আজকে আমরা জানব প্লাস্টিকের এই সাতটা ধরণের শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে অর্থাৎ কোনটা রিসাইকেল করা যাবে কি যাবেনা সে সম্পর্কে।

প্লাস্টিক রিসাইকেল

1 PETE – Polyethylene Terephthalate (পলিইথিলিন টেরেপথলেট): পানির বোতলে, সফট ড্রিংকস এর বোতলে বা কখনো কখনো প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয়। এগুলো মাত্র একবারই ব্যবহার করা যায়। একাধিকবার ব্যবহার করলে ব্যাক্টেরিয়া আক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া পলিইথিল টেরেপথলেট থেকে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ ক্ষরিত হতে পারে। আর এই প্লাস্টিক পরিষ্কার করার জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক এর প্রয়োজন হয়। 

তবে PETE প্লাস্টিক রিসাইকেল করা যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ২৫% PETE প্লাস্টিক-ই রিসাইকেল করা হয়। এগুলোকে প্রথমে গুড়ো করা হয় তারপর সেটা থেকে আবার নতুন PET প্লাস্টিক তৈরি হয়।

 

অর্থাৎ এটি রিসাইকেল করা যাবে কিন্তু পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না। রিসাইকেল বলতে পুরনো প্লাস্টিককে নতুন প্লাস্টিকে রূপান্তর করা এবং পুনরায় ব্যবহার বলতে পুরনো প্লাস্টিক একাধিকবার ব্যবহার বোঝানো হয়েছে।

এই ব্লগগুলি অবশ্যই পড়বেন !! 

মা দিবসের প্রবর্তক এ্যানা জারভিস-ই পরবর্তীতে মা দিবস বন্ধের জন্য লড়েছেন

ডক্টর সেঁজুতি সাহা : এক অনবদ্য কৃতি বিজ্ঞানী

2HDPE – High-Density Polyethylene (হাই ডেনসিটি পলিইথিলিন): দুধ; তেল; ডিটারজেন্ট এর জার, খেলনা এবং কখনো কখনো প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়। এটা সবচেয়ে বেশি রিসাইকেল করা হয়। আর বলা যেতে পারে এটি সবচেয়ে নিরাপদ প্লাস্টিক। এটা পুনরায় ব্যবহারের জন্য রিসাইকেল করা অনেক সহজ এবং সাশ্রয়ী।

এটা পুনরায় ব্যবহার এবং রিসাইকেল করা যাবে। তবে এটা একাধিকবার ব্যবহার না করে এটাকে কেটেকুটে অন্য কিছু তৈরি করে ব্যবহার করা টা-ই ভালো।

3 PVC – Polyvinyl Chloride (পলিভিনাইল ক্লোরাইড): এটা নরম এবং নমনীয় প্লাস্টিক। খাবার মোড়ক করতে, বাচ্চাদের খেলনা তৈরি করতে, পাইপ তৈরি করতে এমনকি তারের কভার হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়। এটা যেহেতু সূর্যালোকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, তাই জানালার ফ্রেম তৈরিতেও এটি ব্যবহার করা হয়।

পিভিসি কে ‘পয়জন প্লাস্টিক’ নামে ডাকা হয়। কারণ এটার জীবনচক্রে এটা থেকে অনেক বিষাক্ত পদার্থ ক্ষরিত হয়। সাধারণত সকল ক্ষেত্রে ভার্জিন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। বলতে গেলে এটি ১% এরও কম রিসাইকেল করা হয়। খাবার রাখতে বা বাচ্চাদের ব্যবহারের জন্য মোটেও এই প্লাস্টিক ব্যবহার ঠিক না।

4 LDPE – Low-Density Polyethylene (লো-ডেনসিটি পলিইথিলিন): কাপড়ের প্যাকেট, রুটি মোড়ক করার প্যাকেট, নরম বোতল ইত্যাদিতে এই প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়।

এটা অন্য প্লাস্টিকের তুলনায় মোটামুটি কম বিষাক্ত এবং এটি ব্যবহার করা মোটামুটি নিরাপদ। এটা সাধারণত রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার করা হয় না। তবে মাঝে মাঝে এটাকে রিসাইকেল করে প্লাস্টিকের টাইলস বা সাধারণ ব্যবহার্য জিনিস তৈরি করা হয়। যদিও এটি রিসাইকেল করলে HDPE এর মতো দৃঢ় প্লাস্টিক পাওয়া যায় না। আবার কোনো কিছুর মোড়ক হিসেবে এটিকে পুনরায় ব্যবহার করতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ৩% এর কম PP রিসাইকেল করা হয়।যদিও ইদানিং রিসাইকেলকারী দের কাছে এটি সবচেয়ে বেশি গ্রহনযোগ্য। এটি রিসাইকেল করে সাধারণত ব্যাটারি কেস, ডাস্টবিন, ট্রে ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

এটাকে পুনরায় ব্যবহারের জন্য নিরাপদ হিসেবে গন্য করা হয়। আর অবশ্যই রিসাইকেল করা যাবে।

6 PS – Polystyrene (পলিস্টেরিন): এটি সস্তা, হালকা ওজনের এবং বহুল ব্যবহৃত প্লাস্টিক। একবার ব্যবহারযোগ্য কাপ, ডিমের বাক্স ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া কোনো বক্সে থাকা জিনিসগুলোকে রক্ষা করতে যে ফোম তৈরি করা হয়, সেটাও এই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। এটা গাঠনিক ভাবে দূর্বল এবং সহজে ভাঙা যায়।

সাধারণত যখন মাইক্রোওয়েভে তাপ দেওয়া হয় তখন এটি থেকে স্টেরিন (একটা ক্যন্সার উৎপাদি পদার্থ) ক্ষরণ হতে পারে। এই প্লাস্টিকে উপস্থিত উপাদানগুলো মানুষের স্বাস্থ্য এবং প্রজননে ত্রুটিপূর্ণ ক্রিয়ার জন্য দায়ী।

এটা খুব একটা রিসাইকেল করা হয় না। সাধারণত রিসাইকেলকারীরা এগুলো গ্রহন করতে চায় না। যদিও এটি রিসাইকেল করা হয় না, তবে এটি অনেকসময় পুনরায় ব্যবহার করা হয়। সাধারণত শিপিং সার্ভিসগুলো এগুলো পুনরায় ব্যবহারের জন্য গ্রহন করে। তবে এটা ব্যবহার না করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।

7 – অন্যান্য: এই ক্যাটাগরিতে আছে পলিকার্বোনেট এবং “অন্যান্য” প্লাস্টিক। এটা পুনরায় ব্যবহার এবং রিসাইকেল এর জন্য গ্রহনযোগ্য না। বিপিএ দিয়ে তৈরি পলিকার্বোনেট কনটেইনার থেকে খাবার বা পানীয়ে বিপিএ ক্ষরণের সম্ভাবনা আছে। বিপিএ হলো জেনোএস্ট্রোজেন, যেটা হরমোন ক্ষরণে ব্যাঘাত ঘটায়। বাচ্চাদের বোতল, কাপ, গাড়ির যন্ত্রাংশ ইত্যাদি তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়।

পলিকার্বোনেট প্লাস্টিকের খাদ্যের পাত্রে বিপিএ থাকে। আর ঐ পাত্রগুলোতে ত্রিভুজের নিচে “PC” লেখা থাকে। যদি কিছু কিছু পাত্রে লেখা থাকে সেগুলো থেকে কোনো পদার্থ ক্ষরিত হয় না (Non-leaching), তবুও একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। ইদানিং কর্ণ স্টার্চ থেকে পলিকার্বোনেট এর বিকল্প প্লাস্টিক তৈরি হচ্ছে তবে সেগুলোতে “PLA” লেখা থাকে। 7 লেখা প্লাস্টিকগুলো পুনরায় ব্যবহার করা যায় না, যদি না সেটাতে “PLA” লেখা থাকে। যত সম্ভব তত বেশি এটি এড়িয়ে চলা উচিত। 1, 2 এবং 4 লেখা প্লাস্টিক গুলোতে বিপিএ থাকে না। PLA প্লাস্টিকগুলো রিসাইকেল বিনে না ফেলে মাটিতে ফেলে সারে পরিনত করাই ভালো যদি সেগুলো রিসাইকেল যোগ্য না হয়।

প্লাস্টিক কোম্পানিগুলো জনসাধারণের বোঝার সুবিধার্থে এই কোডগুলো প্লাস্টিক পণ্যের গায়ে লিখে রাখে। আমাদের সবারই উচিত কোড অনুযায়ী প্লাস্টিকের সঠিক ব্যবহার করা। আর যদি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ থেকে বাঁচতে চান, তবে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু ব্যবহার করাই সবচেয়ে ভালো।

Exit mobile version