বিজ্ঞান ব্লগ

ফটোগ্রাফি সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক খুঁটিনাটিঃ সুন্দর ছবির ভেতরের কথা

বর্তমানে ফটোগ্রাফি শব্দটি বহুল আলোচিত। আমাদের জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা ফটোগ্রাফির মাধ্যমে ধরে রাখতে পারি বহুদিন। ফটোগ্রাফি হলো একটি শিল্প যা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে হয়ে ওঠে জীবন্ত। কেউ কেউ শখের বশে আবার কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে ফটোগ্রাফি কে পেশা হিসেবে নিয়েছে। জীবিকার তাগিদেই করুক আর মনের তীব্র ইচ্ছা থেকেই করুক ফটোগ্রাফার দের মূল লক্ষ্য একটি সুন্দর স্থির চিত্র তুলে ধরা যেখানে থাকে নিজস্বতা। আসলে নিজের মেধা ও মননের সমৃদ্ধতা এবং কোনো ঘটনা দেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায় আলোকচিত্রে। তবে কখনও কি আমরা ভেবে দেখেছি ফটোগ্রাফির উৎপত্তি কিভাবে হলো?

ফটোগ্রাফি শব্দটি এসেছে দু’টি গ্রিক শব্দ ‘photos‘ এবং ‘graphos‘ থেকে যার সোজাসাপ্টা অর্থ করলে দাঁড়ায় light drawing বা আলো দ্বারা অঙ্কিত চিত্র।

ফটোগ্রাফির আবিষ্কারক : ফরাসি উদ্ভাবক Joseph Nicéphore Niépce (১৭৬৫-১৮৩৩) বিশ্বের প্রথম সফল ফটোগ্রাফার এবং তাকে ফটোগ্রাফি এর জনকও বলা হয়।

এখন এই আলোকচিত্রের সাথে বিজ্ঞানের কি সম্পর্ক  জেনে নেয়া যাক।একটি পরিপূর্ণ আলোকচিত্র হতে ঘটে তড়িৎচুম্বকীয় বিচ্ছুরণ। ভালো ছবির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে লেন্স। যার মাধ্যমে ছবি ধারণ করা হবে সেখানে থাকে ডিজিটাল সেন্সর।আমরা যে বস্তুর ছবি ধারণ করতে চাই সেই বস্তু থেকে আলোর যে প্রতিফলন ঘটে এই আলোর প্রতিফলন কে প্রকাশ করতে ব্যবহৃত হয় লেন্স। এছাড়া আছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন শাটার স্পিড, অ্যাপারচার, আইএসও ইত্যাদি।

 

ছবি যেভাবে গঠিত হয়: 

ক্যামেরার ভিতরে থাকে আলোক সংবেদী তল। আমরা যে বস্তুটির ছবি তুলতে চাই থেকে নিঃসৃত আলো লেন্স এর মাধ্যমে কেন্দ্রীভূত করার ফলে আলোক সংবেদী তলে একটি real image গঠিত হয়। এরপর বৈদ্যুতিক চিত্র অনুধাবক (image sensor)-এ চিত্রটির প্রতি পিক্সেল একটি বৈদ্যুতিক আয়ন হিসেবে জমা হয়। এরপর ঘটে একটি বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়া যার ফলে ছবিটি চলে যায় দ্বিমাত্রিক চিত্র ফাইলে। আলোকচিত্রগ্রাহী রঞ্জকস্তর (photographic emulsion)-এ তৈরি হয় সুপ্ত চিত্র /latent image(ফিল্মে) বা আরএডব্লিউ ফাইল(ডিজিটাল ক্যামেরায়) যার পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণে তৈরি হয় দৃশ্যমান চিত্র। শুধুমাত্র ছবি দৃশ্যমান করতে যতটুকু আলোর প্রয়োজন সেটুকু বাদে অন্য আলো ক্যামেরা থেকে বাদ দেওয়া হয়। যে বস্তুটির ছবি তোলা হবে তার ওপর আলো কিভাবে পড়ছে সেটি ছবিতে প্রকাশ পায়।

শুধু ক্যামেরাতে ক্লিক করলেই কি সুন্দর ছবি হয়ে যায়? নাহ্ এর পেছনে থাকে শ্রম, শিল্প আর ক্যামেরার ভেতরকার কারসাজি।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! 

HIV ভাইরাসের যাত্রাঃ শেষ হয়েও হইলো না শেষ

ডিস্লেক্সিয়া : শিখতে না পারা যখন লার্নিং ডিজঅর্ডার!

ইয়ারওর্য়াম: মস্তিষ্কে যখন সুর এর ঘূর্ণিঝড় !

আলোকচিত্রটি কিভাবে পরিষ্কার, স্পষ্ট ও দৃষ্টিনন্দন করা যায় তা অনেকাংশে কয়েকটি কন্ট্রোল এর ওপর নির্ভরশীল-

১.ফোকাস:  সাধারণত ফোকাস বলতে বোঝায় ছবি তোলার জন্য নির্ধারিত বস্তুটির অবস্থান কেন্দ্রীকরণ। প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্পষ্ট ছবি তুলতে ফোকাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইন ফোকাস, আউট ফোকাস এগুলো হলো প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রন।

২.শাটার স্পীড : শাটারের গতির মাধ্যমে প্রতিটি এক্সপোজারে চিহ্নিত বস্তুটি কতক্ষণ আলোয় প্রকাশিত অবস্থায় থাকবে এবং নিক্ষিপ্ত আলোর পরিমাণ কতটুকু হবে সেটা নির্ধারণ করা হয়। দ্রুততর শাটার স্পিড এর মাধ্যমে ইমেজ ব্লারিং এর পরিমাণ হ্রাস করে পাওয়া যায় অধিক স্বচ্ছ ছবি।

৩.অ্যাপারচার : লেন্স এর মাধ্যমে প্রবেশকৃত আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এই অ্যাপারচার। এটি f-number প্রকাশ করে। ডেপথ অফ ফিল্ড ও ডিফ্র্যাকশন এর উপরও অ্যাপারচার প্রভাব বিস্তার করে। যখন আমরা একই সাথে উজ্জ্বল ও অন্ধকারের মধ্যে চলাফেরা করি আমাদের চোখের আইরিশ সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এ সময় চোখের পিউপিল এর আকার পরিবর্তিত হয়।তেমনি ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে অ্যাপারচার হলো লেন্সের পিউপিল।

৪.হোয়াইট ব্যালান্স: সঠিক হোয়াইট ব্যালেন্স এর মাধ্যমে ছবি প্রকৃত করে তোলা হয়। ফটোগ্রাফিতে আলো সম্পর্কে বুঝতে পারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।আলো বিভিন্ন উৎস থেকে আসতে পারে এবং আলোর বিভিন্ন রং বিদ্যমান যাকে বলা হয় কালার টেম্পারেচার। আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতার ফলে সকল আলো-ই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু ফটোগ্রাফিতে ছবির প্রাকৃতিক রং নির্ধারণ করতে হোয়াইট ব্যালেন্স এর চূড়ান্ত নান্দনিক প্রয়োগ ঘটাতে হয়। 

৫.আইএসও (ISO) : ফিল্ম ক্যামেরায় নির্বাচিত ফিল্মে থাকতো ফিল্ম স্পিড যা আধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরায় আইএসও স্পিড নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে এক্সপোজার ব্যবস্থাকে সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

৬.মিটারিং: আধুনিক ডিএসএলআর এ ‘metering mode‘ নামক অপশন আছে যা ‘camera metering’ , ‘exposure metering’ বা শুধু ‘metering’ নামেও‌ পরিচিত। শাটার স্পিড ও অ্যাপারচার কেমন হওয়া উচিত সেটা পরিমাপের নির্দেশনা দেয় মিটারিং। এর মাধ্যমে ফটোগ্রাফার ইচ্ছেমতো হাইলাইট ও শ্যাডো ব্যবহার করতে পারে। মিটারিং সাধারণত ISO ও ক্যামেরা দিয়ে আসা আলোর পরিমাণ এর ওপর নির্ভর করে।

ছবি আরো নান্দনিক করতে ফোকাল লেন্থ, টাইপ অফ লেন্স (Long focus, wide angle, Telephoto, Macro, Fisheye, Zoom) এসবও গুরুত্বপূর্ণ।

ভালো ছবি তুলতে শুধু থিওরিটিক্যাল জ্ঞান আর ক্যামেরা থাকলেই হবে না। অনেকে মোবাইলের সাহায্যেই অনেক সুন্দর ফটোগ্রাফি করতে পারে। অ্যাংগেল অফ ভিউ, ডেপথ অফ ফিল্ড, কম্পোজিশন এইসব খুব ভালোভাবে শেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এরজন্য প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে আর বিভিন্ন অ্যাংগেলে ছবি তুলতে হবে।

 ফটোগ্রাফি করতে হলেই যে এসব তথ্য জানতে হবে এমন নয়, কারো বিজ্ঞান এর প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকলেও ফটোগ্রাফি সমন্ধে জানতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানের ভৌত আলোকবিজ্ঞান এর সুন্দর ও প্রায়োগিক উদাহরণ হলো‌ ফটোগ্রাফি। তাই তাই ফটোগ্রাফি বিষয়ক খুঁটিনাটি জেনে আজই হয়ে ওঠো একজন বিজ্ঞানপ্রেমী দক্ষ ফটোগ্রাফার।

 

Exit mobile version