বিজ্ঞান ব্লগ

ফসিল নিয়ে নানান কথা:অজানা বয়স বের করার রহস্য

কখনো ভাবতে অবাক লাগে না প্রত্নতত্ত্ববিদরা যে এত এত প্রাচীনকালের পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করা ডাইনোসরের ফসিল মাটি থেকে উদ্ধার করে এরপরই ফটাফট তাদের বয়স কত মানে তারা কত বছর আগে পৃথিবীতে ছিল তা বের করে দেয়, তারা এগুলো কিভাবে করে? মানলাম তারা তাদের ফসিল উদ্ধার করে তারপর মিউজিয়ামে রাখে এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু এরপরই তারা যে সেই সব কঙ্কাল বা ফসিলগুলো কত বছর আগে পৃথিবীতে জীবিত অবস্থায় তা বের করে দেয় এটা একটু বেশি মনে হচ্ছে না?

হ্যাঁ মানছি ছোটবেলা আমারও মনে হতো এসব। এরপর…. আমার এক বড় ভাই আমাকে এর পিছনের বিজ্ঞান বলে আমার ভুল ভাঙাল।

তো আমি আমার বড় ভাইয়ের থেকে তো জানলাম। 

এবার আমি যাবো বড় ভাইয়ের জায়গায় তোমরা যাবা আমার জায়গায়। আমি তোমাকে শুনাবো আর কি কিভাবে তুমি ফসিলের বয়স নির্ণয় করবে?

প্রথমেই আমি ফসিল সম্পর্কে কিছু কথা বলি। প্রাণীর মৃতদেহ থেকে ফসিল তৈরি হয়। কোন প্রাণী বা গাছ যখন মারা যায় তখন সেই প্রাণীর মৃতদেহ দীর্ঘদিন ধরে ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে মাটির সাথে মিশতে শুরু করে। প্রাণীর দেহের নরম অংশগুলো যেমন মাংসে দ্রুত পচন ধরে। কিন্তু হাড় বা খোলসের মতো শক্ত জিনিসগুলো এতো দ্রুত পচন ধরে না। মাঝে মাঝে এইসব হাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মাটির বিভিন্ন পদার্থ যেমনঃ ক্যালসিয়াম প্রবেশ করে হাড়গুলোকে আরো মজবুত করে তোলে যার ফলে এইসব টিকে থাকে হাজার হাজার বছর। এই হাড়গুলো তখন ফসিলে পরিণত হয়। 

সাধারণত প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে এসকল ফসিল উদ্ধার করে তো ধরে নিলাম আমি আমার বাসার পিছনে বাগানের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে ফসিল উদ্ধার করতে চাই (😋 খুশির ঠেলায় আর কি)।  তো আমি মস্ত বড় ডাইনোসরের ফসিল বেরও করলাম। এবার হয়তো ভাববে আমি এবার বিখ্যাত হব কিন্তু দাড়াও আমরা বাঙালি তো আমরা আগে অনেক কিছু জোড়া তালি করে বিশ্ব বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করেছি।

তাই স্বভাবতই আমার এই ডাইনোসরের ফসিলের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না তাই আমি সোজাপথে না গিয়ে একটু বাঁকা পথে গিয়ে আগের বয়স নির্ণয় করব তারপর সবাইকে দেখাবো এবার সবাই বিশ্বাস করবে। বলে তো দিলাম বয়স নির্ণয় করবো কিন্তু এটাতে অনেক টাফ কাজ। কিন্তু আমিও হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নই আমিও শুরু করে দিলাম।

তো আমার কাছে এখন দুটো পদ্ধতি আছে এই বয়স নির্ণয় করার জন্য।১) শিলাখণ্ডের গঠন দেখে ২) কার্বন ডেটিং করে।

প্রথমে বলেছি শিলাখণ্ডের গঠন দেখে ফসিলের বয়স নির্ণয়ের কথা।

আমি মাটির যে স্তরে ফসিল পেয়েছি সেই স্তরের শিলাখণ্ডের গঠনের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করে নেন ফসিলটা কত বছর আগের হতে পারে। আমাদের পৃথিবীর এই শিলাস্তর হচ্ছে আসলে একটা অ্যালবামের মতো। মাটি খুঁড়ে একটার পর একটা স্তরে যাওয়া, আর অ্যালবামে পাতার পর পাতা পুরাতন ফটো ওল্টানো একই ব্যাপার।

কি বিশ্বাস হচ্ছে না! বিজ্ঞানীরা এই পাতা বা মাটি ও শিলার স্তরকে কয়েকটা প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। এই সবগুলো স্তরের মধ্যে কয়েকটা হলো- Paleozoic, Mesozoic, and Cenozoic স্তর। এই অ্যালবামের পাতা উল্টে আমি অর্থাৎ তিনটা শিলাস্তর ধরেই  ৫০০ মিলিয়ন বছর আগের পৃথিবীতে চলে যেতে পারি!

১ টা ছবিটা দিচ্ছি এবার সেটা দেখি। 

এখানে তিনটা স্তর দেখছি। এর মধ্যে সবচেয়ে নিচে আছে Paleozoic স্তর। তার মানে এই তিনটা স্তরের মধ্যে Paleozoic স্তরটা সবচেয়ে পুরনো। এর মাধ্যমেই আমি ৫০০ মিলিয়ন বছর আগের পৃথিবী কেমন ছিল মোটামুটি জানতে পারি। আমি যদি কোনোভাবে ঐ স্তরে ফসিল খুঁজে পাই তবে সেগুলো হবে- সরীসৃপ, উভচর, মাছ এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এই স্তরের ফসিলগুলো ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে বিরাজমান ছিল। তবে দুঃখের বিষয় এই স্তরে কোনো ডাইনোসর পাব না। কারণ ডাইনোসরেরা তখনো আসেনি পৃথিবীতে। আমি এর উপরের স্তরে অর্থাৎ Mesozoic স্তরে ডাইনোসর পাব।

এই স্তর হলো ২৫০ মিলিয়ন বছরের পুরনো। তার মানে বলা যায় ডাইনোসররা এসেছিলো প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে। তবে এই স্তরে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী খুঁজে পাবেন না। তাদের পাব এর উপরের স্তর, Cenozoic স্তর। আমরা এখন এই স্তরের উপরেই বাস করছি। এই স্তরের বয়স মাত্র ৬৫ মিলিয়ন বছর।

যাই হোক এভাবে নিচের দিক হতে শুরু করে উপরে যেতে যেতে দেখতে পাব আমাদের পৃথিবীর স্মৃতিময় অ্যালবাম। বুঝতে পারব কার কত বয়স। এ থেকে বুঝা যায় কীভাবে পৃথিবী তার সন্তানদের সাথে সাথে নিজেও বিবর্তিত হয়েছে সময়ের স্রোত ধরে।

অনেক তো বললাম ভাবছি এই পদ্ধতিতে বয়স নির্ণয় করে আমি বিখ্যাত হব, ওয়ার্ল্ড ফেমাস হবো কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা আছে। সেটা হলো এই পদ্ধতিতে একটা অনুমান ভিত্তিক বয়স বের করা হয় কিন্তু ফসিল এর প্রকৃত বয়স বের করা যায় না। যেহেতু প্রথম পদ্ধতি দিয়ে আমি প্রকৃত বয়স বের করতে পারলাম না তাই আমাকে এখন ধরতে হবে দ্বিতীয় পদ্ধতি। কার্বন ডেটিং পদ্ধতি। এটা একটু জটিল তাই সবাই একটু মন দিয়ে পড়ি।

এই কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে বয়স নির্ণয় করা যায়। যা একটা নিখুঁত পদ্ধতি। 

এই কার্বন ডেটিং কি তা সম্পর্কে জানতে আগে কার্বনের পারমানবিক গঠন সম্পর্কে জেনে নেই। আমরা জানি, সকল পদার্থ মূলত ৩টি মৌলিক কণা দ্বারা গঠিত – ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। একেকটি মৌলের প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রন সংখ্যা একেক রকম। যেমন কার্বনের প্রোটন সংখ্যা ৬ আর নাইট্রোজেনের প্রোটন সংখ্যা ৭। আমরা প্রকৃতিতে যে কার্বনের সাথে পরিচিত তা মূলত কার্বন-১২।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! 

“দ্য নোভা ইফেক্ট”:একটি ছোট কাজ থেকে যখন বিশাল প্রতিক্রিয়া

আপনি কি নার্সেসিস্ট? : চলুন দেখে আসি গভীরে

অর্থাৎ এই কার্বনে ৬টি প্রোটন ও ৬টি নিউট্রন থাকে। কিন্তু প্রকৃতিতে এমন কার্বন অণুও আছে যেখানে নিউট্রনের সংখ্যা হলো ৮টি। এই কার্বন অণুগুলোকে বলা হয় কার্বন-১৪। কার্বন-১৪ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এরা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাধ্যমে কার্বন-১৪ অণু থেকে প্রোটনের সংখ্যা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং একসময় কার্বন-১৪ অণু নাইট্রোজেন পরমাণুতে পরিণত হয়। অর্থাৎ কোন বস্তুতে কিছু পরিমান কার্বন-১৪ অণু থাকলে ধীরে ধীরে সেই বস্তুর কার্বন-১৪ এর পরিমাণ কমতে থাকবে।

প্রতিটি প্রাণীর শরীরেই কার্বন থাকে। প্রকৃতি থেকে উদ্ভিদ সরাসরি কার্বন -ডাই অক্সাইড গ্রহনের মাধ্যমে কার্বন গ্রহন করে আর সেই প্রাণীরা সেই উদ্ভিদ খেয়ে প্রকৃতির কার্বন গ্রহণ করে। গৃহীত এই কার্বনের বেশিরভাগ অংশই কার্বন-১২ তবে এতে কিছু পরিমান কার্বন-১৪ ও থাকে। তাই প্রাণীর ফসিলে থাকা কার্বনের মাঝে কার্বন-১৪ ও উপস্থিত থাকে।

বিজ্ঞানীরা যখন কোন ফসিল পান তখন সেই ফসিলে কি পরিমান কার্বন-১২ আর কি পরিমান কার্বন-১৪ আছে তা পরীক্ষা করে বের করেন। আগে বেটা কাউন্টিংয়ের মাধ্যমেই কার্বন-১৪ এর পরিমাণ নির্ণয় করা হত। তবে বর্তমানে এক্সেলেটর মাস স্পেক্ট্রোমিটারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ফসিলের কার্বন-১৪ ও কার্বন-১২ এর অনুপাত নির্ণয় করেন।

যেহেতু কার্বন-১৪ এর পরিমান সারাক্ষণ কমতে থাকে তাই যে ফসিলে কার্বন-১৪ এর অনুপাত কম সেই ফসিলের বয়স বেশি। কার্বন-১৪ এর অর্ধায়ু প্রায় ৫৭৩০ বছর। অর্থাৎ কিছু পরিমান কার্বন-১৪ নেওয়া হলে সেই কার্বন-১৪ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অর্ধেকে পরিনত হতে সময় নিবে প্রায় ৫৭৩০ বছর। যে সময়ে কোন তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মোট পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাকে ঐ পদার্থের অর্ধায়ু বলে।

আমরা যখন মারা যাই, তখন কার্বন-১২ এবং কার্বন-১৪ সমান অনুপাতে থাকে। কিন্তু পরে কার্বন-১৪ ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। আর কার্বন-১২ তার আগের পরিমাণেই স্থির থাকে। আমি যদি কোনো ফসিলে এই কার্বন-১২ ও কার্বন-১৪ এর অনুপাত বের করে ফেলতে পারেন, তবে আমি ফসিলটার বয়স জেনে যাবেন। এর জন্যে একটা সূত্র আছে। 

t = [ ln (Nf/No) / (-0.693) ] x t1/2,

এখানে,ln = Natural logarithm,Nf/No = Percentage of Carbon-14,t1/2 = Half-life of Carbon-14 = 5730 yrs 

এখন ধরুন আপনি একটা ফসিল পেলেন যেটায় কার্বন-১৪ আছে ১০%। তাহলে ঐ ফসিলের বয়স হবে-

t = [ ln (0.10) / (-0.693) ] x 5,730 yearst = [ (-2.303) / (-0.693) ] x 5,730 yearst = [ 3.323 ] x 5,730 yearst = 19,040 years old অর্থাৎ ১৯,০৪০ বছরের পুরনো সেই ফসিল!

দেখলা কত সোজা জাস্ট সূত্রে কয়টা মান বসিয়ে দিলেই ফসিল এর বয়স কত তা নির্ণয় করা যায়।

এখনতো আমার বিখ্যাত হতে সমস্যা নাই…

 

তথ্যসূত্রঃ

১। https://en.wikipedia.org/wiki/Geologic_time_scale২। http://www.prehistoricplanet.com/news/index.php?id=48৩। http://science.howstuffworks.com/environmental/earth/geology/carbon-142.htm

৪|https://en.m.wikipedia.org/wiki/Radiocarbon_dating

৫|https://en.m.wikipedia.org/wiki/Carbon-14

Exit mobile version