বিজ্ঞান ব্লগ

ফিরে দেখা বৈরুত বিস্ফোরণ: অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের রসায়ন

৪ ঠা আগস্ট,২০২০। লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। রাজধানী বৈরুত থেকে অদূরে পোর্ট এলাকায় রাসায়নিক গুদামে বিস্ফোরণে মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে সেই বিস্ফোরণের স্ংবাদ পৌছে যায় মুহূর্তেই। গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায় ঘটনার আকস্মিকতায়। হাজার হাজার লেবানিজের কান্না আর স্বজন হারানোর বেদনায় ভারি হয়ে উঠে বৈরুতের বাতাস। 

বিস্ফোরণ তৎক্ষণাৎ প্রাণ হারায় ২২০ জন, প্রায় ৫ হাজারেও বেশি মানুষ আহত এবং ৩ লক্ষের বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। বিস্ফোরণে আশেপাশে ৩ কি.মি এলাকা জুড়ে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক শত ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, এমনকি বৈরুত বন্দরে থাকা বাংলাদেশের নৌ বাহিনীর জাহাজ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সুদূর সাইপ্রাস থেকেও এই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল।

২০২০ এ ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার একটি এই রাসায়নিক বিস্ফোরণ, যা বহু বছর লেবানিজদের তাড়িয়ে বেড়াবে।

কেন ঘটলো এমন বিস্ফোরণ?

বৈরুত বন্দরে মজুতকৃত ২,৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকেই এই অগ্নিকান্ডের উৎপত্তি ।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট একটি শ্বেত, স্ফটিকাকার পদার্থ। এর রাসায়নিক ফরমুলা NH4NO3হাইগ্রোস্কোপিক,নন হাইড্রেট এই পদার্থের অনেক ব্যবহারের একটি হচ্ছে নাইট্রোজেন সার এবং অস্ত্র তৈরিতে। ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০ মিলিয়ন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সারা বিশ্বে উৎপাদিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এর যথাযথ সংরক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটির কারনেই বছর বছর এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্ম, যার ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার প্রাণ অকালেই ঝরে যাচ্ছে।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের রসায়নের দিকে তাহলে একটু নজর দেওয়া যাক এবার।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট দানা দেখতে বিডের মতো,অনেকটা কুকিং সল্টের মতো, কিনতে সস্তা। অদাহ্য হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং মজুতে বিশেষ যত্নশীলতা প্রয়োজন। বৈরুতের হ্যাঙ্গারে টন টন অ্যামোনিয়াম  নাইট্রেট মজুত ছিল ৬ বছর যাবৎ । বছর বছর বাতাসের আদ্রতা শোষণ করে এই বিশাল পাইল হয়েছে প্রস্তর কঠিন। NH4+ এবং NO3 এই দুই আয়নের সমন্বয়ে ঘটিত এই লবণে নাইট্রোজেন পরমাণুর দুই ধরনের জারন মান থাকে, যথাক্রমে -3 এবং +5। কোন কারনে অধিক শক্তি পেলে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অণুতে এক প্রকার অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় । বৈরুতের বিস্ফোরণে আশেপাশে কোথাও অগ্নিকান্ডের সূচনা ঘটে, যা দ্রুত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের গুদামের সংস্পর্শে চলে আসে। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিস্ফোরণসহ বিয়োজন বিক্রিয়া সংঘটিত হতে প্রায় ৪০০ ফারেনহাইট তাপমাত্রা এর  প্রয়োজন। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বস্তার সঙ্গে থাকা কার্ডবোর্ড, কাগজের মতো কার্বন সমৃদ্ধ উপাদানের সংস্পর্শে এসে এই তাপশক্তি অর্জিত হতে পারে। এই বিশাল তাপশক্তি গুদামের গুমোট পরিবেশে সঞ্চিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে সাহায্য করেছে।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! 

সময় সম্প্রসারণ:ভবিষ্যৎ পৃথিবী ভ্রমণের মাধ্যম।

HIV ভাইরাসের যাত্রাঃ শেষ হয়েও হইলো না শেষ

রায়চৌধুরী ইকুয়েশনঃ সিঙ্গুলারিটির সমাধানে এক বাঙ্গালি বিজ্ঞানী

ফলশ্রুতিতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিয়োজিত হয়ে নাইট্রোজেন গ্যাস ,বাষ্প এবং অক্সিজেনের সাথে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড তৈরি করে । অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের অ্যামোনিয়াম মূলক বিজারক এবং নাইট্রেট মূলক জারক হিসাবে কাজ করে । সম্পূর্ণ বিক্রিয়াটি একটি তাপ উৎপাদি বিক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রচুর শক্তি প্রকৃতিতে উন্মুক্ত হচ্ছে।

অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এর বিস্ফোরণের ফলে একটি বিশাল ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি হয়। বিস্ফোরণ কালে মজুদকৃত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিয়োজনে সৃষ্ট গ্যাসের থেকে এই কুণ্ডলীর সৃষ্টি ।

NH4NO3 → N2O + 2H2O , স্বাভাবিক অবস্থায়

2NH4NO3 → 2N2 + O2 + 4H2O, উচ্চ তাপমাত্রায় ।

 এই অনিয়ন্ত্রিত বিয়োজন বিক্রিয়ায় প্রারম্ভে একটি প্রেশার ওয়েভ তৈরি হয়। বিক্রিয়া দুই ধাপে শুরু হয়, প্রথমত ডিফ্লাগ্রেশন, প্রতিটি অণুতে শব্দের চেয়ে কম বেগে স্রোতের মতো বিয়োজন বিক্রিয়া অগ্রসর হতে থাকে । শক্তির পরিমাণ বাড়তে থাকলে, একসময় ডেটোনেশনে রূপ লাভ করে, বেগ শব্দের বেগকে অতিক্রম করে এবং বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে পার্শ্ববর্তী বায়ুমণ্ডলে একটি নিম্ন চাপ তৈরি হয় যাতে করে বায়ুতে থাকা পানির বাষ্প ঘনীভূত হতে শুরু করে। এই কারণে সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পাওয়া গেছে। বায়ুচাপ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে ঘনীভূত পানি আবার বাষ্পে রূপ লাভ করে। সৃষ্ট প্রেশার ওয়েভের তীব্রতা এই অগ্নিকান্ডকে বিস্তারে সহায়তা করেছে।

লাল ধোঁয়ার যে কুণ্ডলী দেখতে পাওয়া গেছে তা মূলত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের। আলোর প্রতিসরণ জনিত কারনে এই কুণ্ডলীর এমন রঙ অরুণাভ দেখতে পাওয়া গেছে।

রাসায়নিক দ্রব্য মজুদের নির্দিষ্ট নীতিমালা পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যমান। এত পরিমাণ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বছরের পর বছর এভাবে পোর্টে ফেলে রাখা স্পষ্টত নীতিমালার লঙ্ঘন। জনবসতির আশেপাশে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুদ সব দেশেই নিষিদ্ধ থাকলেও এক্ষত্রে তা মানা হয়নি।

 

বৈরুতের এই ঘটনা এবারই প্রথম না এবং নিশ্চিতভাবেই শেষ নয়। নিমতলি এবং চকবাজার এর অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শত শত মানুষের জীবন হয়েছে বিপন্ন । রাসায়নিক উপাদানের নিরাপদ মজুদে আইন থাকলেও নেই তার প্রয়োগ আর তাই এই ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা থেকেই যাচ্ছে। বৈরুতের এই ঘটনা বিশ্ববাসীর জন্য একটি বার্তা। 

তথ্যস্বীকারঃ CEN , Nature, Wired 

Exit mobile version