বিজ্ঞান ব্লগ

সোনালী আঁশের গৌরব ফিরিয়ে দিতে মহানায়ক-একজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী

বছর দুয়েক আগের কোনো এক সকালে বায়োলজি কোচিংয়ে স্যার Biotechnology চ্যাপ্টারটা পড়াচ্ছিলেন। আমি ঘুম ঘুম চোখে শুনে যাচ্ছিলাম হঠাৎ স্যার বললো একজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর কথা যিনি তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে সোনালী আঁশের জিনোম সিকোয়েন্সিং উন্মোচন করেছেন, যেটা সারা বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানী বহু বছর চেষ্টা করেও পারেন নি। তো আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম আর মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম।

ওনার সম্পর্কে জেনে মনে হয়েছিল, ইশশ! যদি ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম! কিন্তু পরক্ষণেই যখন জানতে পারলাম তিনি আমাদের মাঝে আর নেই তখন ই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দেখা করতে না পারার আফসোস টা তো থেকেই যাবে তবে ভাবলাম যদি এই গুনী বিজ্ঞানীকে নিয়ে একটা ব্লগ লিখতে পারি কিছুটা হলেও আত্মিক প্রশান্তি পাবো।

এতোক্ষণে নামটা বলতেই ভুলে গেছি তবে অনেকেই হয়তো বুঝতে পেরেছেন কার কথা বলতে চাচ্ছি। হ্যাঁ, জিনতত্ববিদ ড. মাকসুদুল আলম স্যার।

১৯৫৪ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর দলিলউদ্দিন আহমেদ ও লিরিয়ান আহমেদ দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম গ্রহন করেন মাকসুদুল আলম। হয়ত সকল বাবা মায়ের মতো তাদের ও ইচ্ছা ছিলো চার ছেলে ও চার মেয়েকে সুন্দর ভাবে প্রতিপালন করা। তবে মাঝে হারাতে হলো তাঁর বাবা কে।

১৯৭১ সালে মাকসুদুল আলম এর বাবা (যিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান একজন কর্মকর্তা) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শহীদ হন। তখন পুরো দায়িত্ব চলে আসে তার মায়ের কাঁধে। তাঁর মা লিরিয়ান আহমেদ শিক্ষকতা করার মাধ্যমে তার সন্তানদের শিক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেন।

ডক্টর মাকসুদুল আলম গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর তিনি স্নাতক সম্পন্ন করার জন্য বৃত্তি নিয়ে চলে যান দেশের বাইরে। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এবার চলে যান জার্মানি তে। সেখানকার ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট থেকে আবারও পিএইচডি সম্পন্ন করেন তবে সেটা প্রানরসায়নে

পারিবারিক জীবন:

রাশিয়ার মস্কোতে পিএইচডি করাকালীন তাঁর পরিচয় হয় Irina Antolievana নামক একজন মেডিকেলে পড়ুয়া‌ শিক্ষার্থীর সাথে । পরবর্তীতে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির Liliana Maqsudulovana নামের একজন কন্যা সন্তান রয়েছে। তবে ১৯৯৭ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি ২০০৯ সালে বিয়ে করেন রাফিয়া হাসিনা কে যিনি তাঁর জীবনে যতটুকু সম্ভব অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

তাদের মেয়ে Jehsan। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি দুই মেয়ের কাছে ছিলেন আদর্শ পিতা‌ ও স্ত্রীর কাছে ছিলেন আদর্শ স্বামী। তিনি অবসর সময়ে ফটোগ্রাফি, রান্না, ভ্রমন করতে ভালোবাসতেন।

ড. মাকসুদুল আলমের সংস্পর্শে যারাই এসেছে সবাই বলেছে তাঁর হৃদয় ছিলো‌ সুবিশাল এবং তিনি তাঁর সাধ্যমত আশেপাশের মানুষের সাহায্য করতে চাইতেন।

উদ্ভিদের জীবন রহস্য নিয়ে ভাবনার প্রারম্ভিক সময়কাল:

শৈশব থেকেই বৃক্ষের প্রতি তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পরিবর্তন, আবহাওয়ার সাথে সম্পৃক্ততা এসব নিয়ে তার ভাবনার সীমা ছিল না। জেনে অবাক হবেন, তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন কেরানীগঞ্জে তার বাবার ক্রয় কৃত একটি জমিতে যেতেন শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ দেখতে এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে।

তবে উদ্ভিদের জিন রহস্য এই ব্যাপারটি তার মাথায় আসে ঢেড়স থেকে। তাঁর বাবা জমিতে বন্যার পানি আসার আগে একবার এবং পানি চলে যাওয়ার পর আরেকবার ঢেঁড়স গাছ লাগান। এই দুই সময়ের ফলনের ওপর মাকসুদুল আলম বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করেন। কারন বন্যার পরবর্তী ঢেড়সগুলো ছিলো বিশাল আকৃতির। তখন তার মাথায় একটি ভাবনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তিনি ভাবলেন হয়ত মাটি, পানি ও বীজের সংমিশ্রণে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যার ফলেই এতটা পরিবর্তন। সেই থেকে তিনি এসব নিয়ে বেশ ভালোভাবে চিন্তা করতেন।

ড. মাকসুদুল আলম এর অনুপ্রেরণা ও অভিজ্ঞতা:

তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিলেন তখনকার প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ভ্লাদিমির পেত্রেভিচ মুলাচেভ। মস্কোতে পড়াশোনাকালীন তিনি এই বিজ্ঞানীর সাহচর্যে আসেন এবং জানতে পারেন কিভাবে প্রকৃতির অজানা রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করতে হয়।

জার্মানিতে থাকাকালীন তিনি কাজ করার সুযোগ ‌পেয়েছিলেন‌ বিভিন্ন প্রান রসায়নবিদ দের সাথে। এদের মধ্যে ডিয়েটার ওয়েস্টারহেল্ট তাঁকে শিখিয়েছিলেন কিভাবে পরীক্ষা করার মাধ্যমে অজানা বিষয়ের রহস্য উদঘাটন করতে হয় । জেরাল্ড হেজেলবাউ ও লিন্ডা রন্ডালের কাছে তিনি প্রকৃতির অভূতপূর্ব বিষয়গুলো প্রকাশ এর পদ্ধতি শিখতে পেরেছেন যার জন্য তিনি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে গেছেন।

১৯৮৮-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি রাশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেসের বায়োঅরগানিক কেমিস্ট্রি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষণা বিজ্ঞানী ছিলেন। তারপরে তিনি ১৯৯০-১৯৯২ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বায়োকেমিস্ট্রি এবং বায়োফিজিক্স বিভাগের একজন পরিদর্শন বিজ্ঞানী ছিলেন। জার্মানিতে পিএইচডি সম্পন্ন করে মাকসুদুল আলম University of Hawai’i এ মেরিন‌ বাই প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।


সেখানে কর্মরত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের দল গবেষণা করার জন্য পেয়ে যান অনুদান। এই গবেষণায় তিনি ও তাঁর সহকর্মী রেন্ডি লারসেন ২০০০ সালে মায়োগেবিন ধরনের নতুন এক প্রোটিন আবিষ্কার করে অনেক সাড়া ফেলেন। ১৯৯২ সালে, আলম হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে‌র মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেছিলেন। এরপর ১৯৯৭ সালে তাঁর পদোন্নতি হয়। ২০০১ সালে পুরো অধ্যাপক হয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন।

২০০৩ সালে, মাকসুদুল আলম হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে Genomics, Proteomics and Bioinformatics (ASGPB) এর অ্যাডভান্স স্টাডিজ চালু করেন। তখন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই বোর্ডের পরিচালক ছিলেন। তিনি ২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি সানস মালয়েশিয়ার সেন্টার ফর কেমিক্যাল বায়োলজির পরিচালক ছিলেন।

এসকল স্থানে গবেষণামূলক কাজ করেও‌ তাঁর মনে একটা অতৃপ্তি থেকেই গিয়েছিল। সেই অতৃপ্তির বিষয়টা না হয় পরের পর্বে বলি…

পরের পর্বে থাকবে এই বিজ্ঞানী ও তাঁর দলের পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং এর দুঃসাহসিক যাত্রার কাহিনী।

তথ‌্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, প্রথম আলো তে বিজ্ঞানীর নিজের লেখা নিবন্ধন।

 

Exit mobile version