বিজ্ঞান ব্লগ

বিজ্ঞানী সত্যেন বোস : বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানীর অধরা নোবেল

ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নেওয়া অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এবং বিশ্বজোড়া খ্যাতি সম্পন্ন একজন বিজ্ঞানী সত্যেন বোস। তাঁর জন্ম ১৮৯৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। তিনি ছিলেন এই উপমহাদেশের একজন অন্যতম তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী।

সত্যেন বোসের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন আসে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে যৌথভাবে গবেষণা করবার সময়। সালটা ১৯২৪, সত্যেন বোসের তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  পদার্থবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক। তিনি প্ল্যাংকের কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ তত্ত্বকে নিউটোনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই প্রমাণে সক্ষম হন। তাঁর এই গবেষণা পত্রটি তিনি সেই সময়ের স্বনামধন্য জার্নালে প্রকাশের জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন, পাশ্চাত্যের কোন বিজ্ঞানী দ্বারা গবেষণা পত্রটি অনুমোদিত না হওয়ায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মতো একটি অখ্যাত স্থান থেকে আসায় এই গবেষণা পত্রটি প্রকাশ পায় নি। সত্যেন বোসের নিজের কাজের উপর ছিল অগাধ বিশ্বাস আর তাই তো তিনি পত্র প্রেরন করেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে।

তাঁর গবেষণা পত্রটি যাচাইয়ের অনুরোধ করেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের চোখে ধরা দেয় সত্যেন বোসের অসামান্য প্রতিভা আর তার অনুরোধে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর গবেষণা পত্রটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রখ্যাত জার্মান জার্নাল Zeitschrift für Physik প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।

তাঁর এই গবেষণা পত্রটি আইনস্টাইনের সাথে তাঁর যৌথ গবেষণার দ্বার উন্মোচিত করে দেয়। এই দুই অসামান্য মেধাবী পরবর্তীতে বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়ন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে সত্যেন বোসের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এক শ্রেণীর মৌলিক কণিকার নামকরণ করা হয় বোসন কণিকা। এই কণিকা বোস-আইন্সটাইন সংখ্যায়ন তত্ত্ব মেনে চলে।

এছাড়াও এই দুই যুগলের অন্যতম একটি কাজ বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনসেট

সত্যেন বোসের এর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও এই মহান বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার পাননি। যদিও তাঁর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বেশ কয়েক জন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন।

এখানে জেনে নেওয়া দরকার কোন ক্ষেত্রে একজন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন। অনেকগুলো শর্তের মধ্যে একটি রয়েছে, তাঁর তত্ত্ব স্বপক্ষে তাঁর জীবিত থাকাকালীন পরিক্ষালব্ধ প্রমাণ থাকতে হবে। তত্ত্বীয় পদার্থবিদরা তাঁদের সময়ের চাইতে অনেক অগ্রসর হয়ে থাকেন। যথেষ্ট প্রযুক্তির অভাবে তাঁদের অনেক হাইপোথিসিস প্রমাণের বাইরে থেকে যায়। সময়ের সাথে নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয় যা এসব হাইপোথিসিস কে প্রমাণ করে। আইনস্টাইনের উদাহরণ দেওয়া যাক। আপেক্ষিকতা দিয়ে এই মহান বিজ্ঞানীর সাথে আমাদের পরিচয় কিন্তু এই তত্ত্বের জন্য তিনি নোবেল পান নি।

নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে ব্যাপক বিতর্ক জন্ম দিয়েছিল। আপেক্ষিকতার পক্ষে যুক্তি থাকলেও ছিল না কোন পরিক্ষালব্ধ প্রমাণ। বিজ্ঞানী এডিংটন তাঁর পরীক্ষার মাধ্যমে তত্ত্বটি প্রমাণ করলেও তা সার্বজনীন স্বীকৃতি পায়নি। ১৯২২ সালে ফটোইলেক্ট্রন ইফেক্টের জন্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইন নোবেল পান। তাঁর জীবনকালে আপেক্ষিকতার পক্ষে সর্বজন গ্রাহ্য প্রমাণ পেলে তিনি অবশ্যই নিসন্দেহে দ্বিতীয়বারে নোবেল পুরস্কারের জন্য ভূষিত হতেন।

বিংশ শতাব্দীর মহাকাশবিজ্ঞানে আরেক নক্ষত্র স্টিফেন হকিং। তিনি বিখ্যাত ১৯৭৪ সালে তাঁর প্রদানকৃত হকিং র‍্যাডিয়েশন তত্ত্বের জন্য। পরিক্ষালব্ধ প্রমাণের অভাবে তাঁরও নোবেল অধরা থেকে যায়।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!

বাদুড়ঃ প্রাণীজগতের অন্যতম পরাশক্তিসম্পন্ন এক প্রজাতি!

ব্যাকটেরিয়াতত্ত্বের স্বর্ণযুগ : রবার্ট কচ এর গল্প (১ম পর্ব)

ডোরওয়ে ইফেক্টঃ দরজার সাথেই যখন স্মৃতির আয়ু !

আবার উল্টো উদাহরণ রয়েছে । বিজ্ঞানী পিটার হিগস এবং বিজ্ঞানী এংলারট ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান ৪৯ বছর আগে তাঁদের তত্ত্বের জন্য।

বিজ্ঞানী সত্যেন বোস এতটা ভাগ্যবান ছিলেন না, তবে তাঁর এবং বিজ্ঞানী আইন্সটাইনের বোস আইন্সটাইন কন্ডেনসেটের পরিক্ষালব্ধ প্রমাণ আসে বিজ্ঞানী এরিক কর্নেল এবং বিজ্ঞানী কার্ল উইম্যানের হাত ধরে। এই দুই বিজ্ঞানীর সাথে বিজ্ঞানী উলফগ্যাং কেটেরলে ২০০১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান।

তাঁদের পরীক্ষার জন্য লেজার কুলিং এবং ট্রাপিং প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়েছিল যা আবিষ্কারের জন্য ১৯৯৭ সালে নোবেল পুরষ্কার পান বিজ্ঞানী ফিলিপস,ক্লদ কোহেন এবং বিজ্ঞানী স্টিভেন চু। তার অনেক আগেই বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের মৃত্যু হয়।

তাই বলে কি বিজ্ঞানী সত্যেন বোস এর প্রাপ্তি কিছু মাত্র কমে যায়?  এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানী তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অমর হয়ে থাকবেন কোটি বাঙালির অন্তরে।

তথ্যসূত্রঃ ব্রিটানিকা, ইনসাইড সায়েন্স 

 

 

Exit mobile version