মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কতটুকু? আচ্ছা সৌরজগৎ সম্পর্কেই বা আমরা কতটুকু জানি? আসলে মহাবিশ্ব এতটা বিশাল আর দ্রুত প্রসারণশীল যে এর সম্পর্কে অনেক কিছুই আজও আমাদের জ্ঞানের সীমানার বাইরে। কিন্তু তাই বলে গবেষণা তো আর থেমে থাকবে না।
আচ্ছা তোমাদের একটি চমকপ্রদ খবর দেওয়া যাক। ছোট বেলা থেকেই আমরা শিখে এসেছি যে সৌরজগতের সকল গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরছে। কিন্তু আমি যদি বলি এতোদিন আমরা যা পড়ে এসেছি তা টেকনিকালি ভুল? কী অবাক হচ্ছো? অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলেও ঘটনাটি সত্যি। একে বেরিসেন্টার থিওরি বলা হয়৷
তাহলে কথা হচ্ছে আমাদের স্কুল,কলেজে ভুল কেনো শেখায়? আসলে ভুল শেখায় না। আমাদের যাতে গভীরে যেয়ে বিষয়গুলো বোঝা না লাগে সেজন্যই বলা হয় সৌরজগতের সকল গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে ঘোরে৷ তাহলে চল বিস্তারিত ভাবে জেনে নি বেরিসেন্টারটা আসলে কী।
বেরি সেন্টার কে তুমি ভারকেন্দ্রের ( Center of mass ) সাথে তুলনা করতে পারো।ভারকেন্দ্র আসলে কী? যেই বিন্দুতে বস্তুর সমগ্র ভর কেন্দ্রীভূত থাকে সেটিই ভারকেন্দ্র বা “Center of mass” । সহজে বললে একটি বস্তুকে যদি আমরা আঙুলের ওপর নিয়ে ভারসাম্য পূর্ণ অবস্থায় রাখতে চাই তাহলে যে বিন্দুতে আঙুলটি রাখতে হবে সেটিই হল ভারকেন্দ্র।
প্রত্যেক বস্তুরই কিন্তু ভারকেন্দ্র রয়েছে। সেটি একটি বই হোক বা একটি কলম।একটা উদাহরণ দিলে আশা করি তোমরা বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারবে। একটি স্কেলের ক্ষেত্রে ভারকেন্দ্র কোথায় থাকবে? একটি স্কেলের দিকে যদি ভালো করে লক্ষ্য করা হয় তাহলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে স্কেলটির মাঝ বরাবর যদি আমার আঙ্গুল দিয়ে ধরি তাহলে অবশ্যই সেটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকবে।
কিন্তু সব সময় কি এরকম ভাবে ভারকেন্দ্র থাকে? আসলে তা কিন্তু নয়।এটি নির্ভর করে বস্তুর ভর কিভাবে বিন্যস্ত আছে তার ওপর। একটি হাতুড়ির কথা ধরা যাক। তাহলে বিষয়টি আরো ভালোভাবে বুঝতে পারবে। একটি হাতুড়ির ক্ষেত্রে সামনের ডগাটির ভর তার সম্পূর্ণ ভরের প্রায় ৮০%।
এটি অত্যন্ত বেশি, যার ফলে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখতে আমাদের আঙুলটি এবার কোথায় নিয়ে যেতে হবে? অবশ্যই হাতুড়ির ভারী অংশটির কাছে। তা না হলে বস্তুটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকবে না বরং এটি একদিকে হেলে পড়বে।
সুতরাং, এটিকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রাখতে হলে যেখানে ভর কেন্দ্রীভূত রয়েছে সেই জায়গায় আঙুল দিয়ে ধরতে হবে তাহলেই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকবে।
তাহলে গ্রহগুলোর ক্ষেত্রে ভারকেন্দ্র কিভাবে কাজ করে? এই ক্ষেত্রে যে তথ্যটি আমলে আমলে নেয়া হয় সেটি হচ্ছে বেরিসেন্টার (এটা নিয়েই এই বেরিসেন্টার থিওরি)। তাহলে বিষয়টি আসলে কী? মনে কর পৃথিবী এবং সূর্য। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে আমরা এটাই জানি। কিন্তু তুমি যদি এখন ভারকেন্দ্রের বিষয়টি লক্ষ্য করেন তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরছে না বরং এরা উভয়েই একটি কমন পয়েন্টকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরছে৷ পৃথিবী সূর্যের তুলনায় অনেকগুণ ছোট এবং পৃথিবীর ভর সূর্য অপেক্ষা অনেক কম। পৃথিবীর ভর যেখানে 5.9722×10^24 কেজি সেখানে সূর্যর ভর 1.9891×10^30 কেজি। অর্থাৎ সূর্য পৃথিবীর থেকে ৩৩৩০০০গুন ভারী।
পৃথিবী এবং সূর্যর ক্ষেত্রে তাই এদেরকে ভারসাম্যে রাখতে হলে কী করতে হবে? এই ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে ভারকেন্দ্র রয়েছে সূর্যের মধ্যে, কারণ সূর্য পৃথিবীর তুলনায় অনেক গুণ ভারী। এইক্ষেত্রে এদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় রেখে ঘুরাতে হলে অবশ্যই একটি কেন্দ্রের দরকার পড়বে এবং সে কারণে কেন্দ্রটি সূর্যের মধ্যে হবে।
কিন্তু সব সময় কি এমন হয়? অবশ্যই না এর ব্যতিক্রম লক্ষণীয়। যেমন বৃহস্পতি গ্রহ এবং সূর্যর বিষয়টি লক্ষ্য করলে আমরা বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবো। বৃহস্পতি গ্রহ সূর্যের থেকে অত্যন্ত ছোট এবং এর ভর অনেক কম কিন্তু এর ভর কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতন নয়।পৃথিবী অপেক্ষায় ৩৪২ গুণ বেশি ভর রয়েছে জুপিটারের।
যা অনেক বেশি এবং সূর্যের সাথে ভারসাম্য রাখার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি লক্ষণীয় হবে। এই ক্ষেত্রে একটি মজার ঘটনা ঘটে। জুপিটারের ভর এতটাই যে এই ক্ষেত্রে ভারকেন্দ্র সূর্য থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। সেটি এখন সূর্যের বাইরে বলে অভূতপূর্ব দৃশ্যের আবির্ভাব হয়। যেখানে আমরা দেখতে পাই সূর্য এবং বৃহস্পতি একটি কমন পয়েন্টকে কেন্দ্র করে ঘুরছে যা সূর্যের বাইরে।
আরো কিছু উদাহরণ দিলে বিষয়টি তোমার কাছে আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠবে। পৃথিবী এবং চাঁদ এর কথা ভাবা যাক। আপাতদৃষ্টিতে চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু আসলে এটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। বরং পৃথিবী এবং চাঁদ একটি কমন পয়েন্টকে কেন্দ্র করে ঘোরে যেখানে ভারসাম্য বজায় থাকে অর্থাৎ সমস্ত ভর যেখানে কেন্দ্রীভূত থাকে। এটাও বেরিসেন্টার থিওরি-এর উদাহরণ।
মূলত চাঁদ অপেক্ষা অনেক বেশি ভারী হওয়ার কারণে কেন্দ্রটি পৃথিবীর মধ্যে অবস্থান করে। আরো পরিষ্কার ভাবে বললে এর অবস্থান পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ৪৬৭৫কি.মি দূরে। যার কারণে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে কিন্তু আসলে তা নয়। বরং উভয়েই একটি নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
সৌরজগতের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিভাবে দাঁড়াবে তাহলে? এখানে সৌরজগতের সকল গ্রহ, উপগ্রহ এবং অন্যান্য বস্তুগুলোর ভর যেখানে কেন্দ্রীভূত থাকবে সেটিই কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ কমন সেন্টার ভরের ওপর নির্ভর করে।
কিন্তু সব সময় কিন্তু এক জায়গায় ভারকেন্দ্র থাকে না। গ্রহগুলির অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে কিন্তু ভারকেন্দ্র পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। এই মহাবিশ্বের সব জায়গায় কিন্তু আইন প্রচলিত হতে দেখা যায়। অর্থাৎ এই মহাবিশ্বের সমগ্র ভর যেখানে কেন্দ্রীভূত আছে সেই বিন্দুকে কেন্দ্র করেই কিন্তু সমগ্র মহাবিশ্ব ঘুরছে।
আশা করি আজকের এই তথ্যগুলো দ্বারা তোমরা উপকৃত হয়েছ। এবং স্কুল কলেজে পড়ে আসা একটি ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হয়েছ।
Sources:
1.https://en.m.wikipedia.org/wiki/Barycenter
2.https://spaceplace.nasa.gov/barycenter/en/
3.https://science.howstuffworks.com/jupiter-orbit-sun-barycenter.htm
4.https://www.google.com/amp/s/www.independent.co.uk/news/science/jupiter-big-orbit-sun-mass-a7866586.html%3famp