বিজ্ঞান ব্লগ

ব্যাকটেরিয়াতত্ত্বের স্বর্ণযুগ : রবার্ট কচ এর গল্প (১ম পর্ব)

১৯ শতকের ডিপথেরিয়া, যক্ষ্মা, কলেরা সংক্রমণের মত প্রাণঘাতী রোগের যখন কোনো সুরাহা করা যাচ্ছিল না, তখন সেই অন্ধকারের মধ্যে আলো নিয়ে আসেন বিজ্ঞানী রবার্ট কচ 

জার্মানির ক্লসথাল শহরের রূপোর খনিতে কর্মরত এক প্রকৌশলীর ঘরে ১৮৪৩ সালের ১১ জানুয়ারিতে, ১৩ ভাই বোনের মধ্যে ৩য় এই বিশ্বখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানীর জন্ম মাত্র পাঁচ বছর বয়সে নিজে নিজে পত্রিকা পড়া শিখে তাক লাগিয়েছিলেন সবাইকে

বাবা প্রকৌশলী হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞান গণিতের প্রতি কোন আকর্ষণ না থাকায় হেনরিক হারমান রবার্ট কচ, কাকার সাথে দেশ ভ্রমণের সময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসেন এবং সেখান থেকেই তার ন্যাচার স্টাডিজ এর ওপর এক ভালোবাসা সৃষ্টি হয় এবং এরই জের ধরে ১৮৬২ সালের ৪ঠা এপ্রিল বিদ্যালয় জীবন শেষ করে চলে আসেন গ্যাটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে (University of Göttingen) ন্যাচার স্টাডিজএর জন্য। কর্মজীবনের চাহিদায় গ্যাটিনজেন ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনাকালীন মেডিসিনের উপর তার কর্মজীবন শুরু করেন কিন্তু ন্যাচারাল সাইন্স এর প্রতি তার একধরনের ঝোঁক কাজ করত যা তার কর্মজীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছে। 

 জ্যাকব হেনলে, জর্জ মাইসনার, ফেড্রিক ভোলার উইলহেম ক্রাউসে তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা শাস্ত্রে অধ্যায়ন করার সময় জরায়ুর স্নায়বিক কার্যক্রম গবেষণার পুরস্কৃত হয়ে জার্মানির চিকিৎসাশাস্ত্রের আরেক মহারথীরুডল্ফ ভারচা্ওএর সান্নিধ্যে আসেন।

 ১৮৬৭ সালের ১০ জানুয়ারিতে কুমে এক্সট্রিমা লাইডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে বার্লিনে যান দর্শন বা স্টাডি ভিজিটের জন্য সহকারি চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবনে পদার্পণ করার এক বছর পর বাল্যবন্ধু এমি ফ্রাটজ্কে বিয়ে করেনবিবাহের ১৪ মাসপর একমাত্র কন্যা সন্তান ঘর আলো করে আসার খুশিতে এমি, রবার্টকে তার জীবনের প্রথম অণুবীক্ষণযন্ত্রটি উপহার দেন।

কিছুকাল বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেন এবং একই সাথে বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার’ নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন উক্ত বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার পরীক্ষায় পাশ করে ১৮৭০ সালে ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে যোগদান করেন চিকিৎসক হিসেবে এবং যুদ্ধ শেষে ১৮৭২ সালে বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার হিসেবে পুজেন প্রদেশের (বর্তমানে পোল্যান্ড) উইলস্টেন শহরে আসেন

 সাল ১৮৭৫ জার্মানিতে বড় বড় গবেষণাগারে জীবাণু নিয়ে কাজ চলছিল সে সময় পুরোদমে  সেই‌ কাজ পর্যবেক্ষণের দায়িত্বের কয়েকজন বিজ্ঞানীর মধ্যে লুই পাস্তুর , জোসেফ লিস্টার কচের অ্যানাটমির শিক্ষক জ্যাকব ছিলেন

লুই পাস্তুর আবিষ্কার করেন জীবাণুর কারণে পচন ধরে। 

জোসেফ লিস্টার অস্ত্রপচারে ব্যবহৃত যন্ত্র জীবাণুমুক্ত করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন

 জ্যাকব হেলেনের মতেজীবাণু সংক্রমণের কারনে রোগ হয়”

 কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে জীবাণুতত্ত্ব তখনো একটি অনিশ্চয়তা। বিভাগের দায়িত্ব পালন করার সময় উইলস্টেন শহরে ব্যাধি অ্যানথ্রাক্সে আগমন ঘটে মাত্র চার বছরে ৫৬০০০ গবাদিপশু ৫২৮ জন মানুষ মারা যায় এই ব্যাধিতে।

 ব্যাধি নিয়ে গবেষণার জন্য কচ সুস্থ গিনিপিগ, পাখি, কুকুর, ইঁদুর খরগোশের উপর পরীক্ষা করতে থাকেন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত সুস্থ প্রাণীর দেহে প্রবেশ করিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তিনি সুস্থ প্রাণীর রক্তে এক ধরণের লম্বাটে জীবাণুর উপস্থিতি দেখতে পান যাকে অ্যানথ্রাক্স রোগের জীবাণু হিসেবে উল্ল্যেখ করলেন কেননা আক্রান্ত রোগীর রক্তে সেই একই ধরনের জীবাণু বর্তমান।

তিনি আরও লক্ষ্য করলেন যে, আরও লম্বা হয়ে বিভক্ত হওয়ার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করা এই জীবাণু আক্রান্ত রক্ত থেকে বাইরে রেখে দিলে এটি অন্য সুস্থ দেহকে আক্রমণ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে তবে, কিভাবে মাটির ওপর হাজার হাজার বছর ধরে বেচে থাকে এবং লম্বা হওয়ার মাধ্যমে এর বংশবৃদ্ধি করে ?

 এই ধাধার উত্তর খুঁজতে, তিনি প্রাণী দেহের বাইরে কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া আচরণ পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি প্রাণী দেহের বাইরে একটি কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টি করেন এবং দেখতে পান যে,

প্রতিকূল পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া একটি স্পোর গঠন করে যা আলো তাপ বা অন্য কোন কিছুর প্রভাবে প্রভাবিত হয় না তবে অনুকূল পরিবেশে যেমনঃ রক্তে প্রবেশ করার পর, স্পোর ভেঙে  লম্বাটে হয়ে নতুন ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দেয়।

জীবাণু নিয়ে পূর্বেই ধারণা থাকলেও কচে-এ আবিষ্কৃত অ্যানথ্রাক্সই প্রথম কোন ব্যাকটেরিয়া যার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পাওয়া যায় ১৮৭৬ সালের বিখ্যাত বোটানিস্ট ফার্দিনান্দের জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে তখনকার সময়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্র আজকের মত আধুনিক না হওয়ায় অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে কাজ করাটাও কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল যেহেতু ব্যাকটেরিয়া স্বচ্ছ পিচ্ছিল ধরণের হয় এবং যন্ত্রে পর্যাপ্ত আলো না পৌঁছাবার কারণে, তিনি (কচ) অণুবীক্ষণযন্ত্র প্রকৌশলীদের সাথে যন্ত্রকে উন্নত‌‌ করার কাজ শুরু করেছিলেন। ব্যাকটেরিয়া বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকিয়ে নিলে এবং ইওসিন, ফিউসিন, ‌স্যাফ্রানিন মিথাইল ভায়োলেট এর মত রঞ্জক ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য জীবাণু আরো স্পষ্টভাবে দেখা যায়। 

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! 

কান্না করতে পারছেন না? কিভাবে সম্ভব ?

ভালবাসার ব্যবচ্ছেদ: মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার হরমোন

পাস্তুরঃ আধুনিক রোগপ্রতিরোধবিদ্যার জনক যে বিজ্ঞানী

মূলত তিনিই প্রথম চিকিৎসক হিসেবে তৈল নিষ্কাশন লেন্স ব্যবহার করেছিলেন। তার পাশাপাশি তিনি প্রথম কন্ডেন্সার ব্যবহার করেন ব্যাকটেরিয়ার ছবি প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে ১৮৭৭ সালে এই ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় পরবর্তী বছরগুলিতে কচ পশুপাখির সংক্রমণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন উন্নত অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে। অণুবীক্ষণযন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সেপটিসেমিয়া, গ্যাংগ্রিন ফোঁড়ার মত রোগ নিয়ে কাজ করার সময় বুঝতে পারেন যে, প্রত্যেক জীবাণু কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতিতে বিভক্তএবং তাদের আচরণ  রোগ ছড়ানোর ধরণ প্রায় একই রকমের তাই মাত্র একটি নির্দিষ্ট জীবাণু নিয়ে পড়াশোনা করলে প্রজাতির সকল জীবাণুর সম্পর্কে জানা যায়।

রহস্য ভরা দুনিয়ার একটার কিছুর নাম শুনলেই জিনিসের নাড়ি নক্ষত্র সব বের করা চাইই চাই : এমনটাই বলে তার মা, মানে আমার দিদি। বাচ্চা মানুষ, তবু এত জানার আগ্রহ মাঝে মাঝে আমিও প্রচুর বিরক্ত হই, তবুও কিছু বলি না কারণ তার মাধ্যমে আমি নিজেও যে অনেক কিছু জানতে পারি। আজকে দাঁতের ডাক্তার দেখাতে এসে সে একজন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত রোগীকে দেখেছে তখন থেকেই সে বিষয়টার পেছন লেগেছে যেমন : ঐটা কী রোগ, কিভাবে হয়, কীভাবে রোগটি নির্মূল হয় আর কত শত যে জিজ্ঞাসা তা আর নাই বলি। ডাক্তার বন্ধু জয়ের অবসর সময় থাকায় সে ওর প্রশ্নের জবাব দিতে থাকে। কিন্তু ওর আবার ডাক আসায় আমি পড়েছি বিপদে।

কেন না যাওয়ার সময় এই জ্ঞানী প্রানীকেবাকিটুক মামা বলবে” বলে চলে গিয়েছে

 খোকা : মামা বল না লুই আর কচের কেন বিবাদ হয়? কলেরা রোগও কী উনি নির্ণয় করেছিলেন?

 আমি : আগে বাসায় যাই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হই তারপর বলব। তার আগে কোনো কথা নয়, ওকে?

 খোকা : ওকে, কিন্তু বলবা।

আমি : ওকে

তথ্যসূত্রঃ সায়েন্স ডিরেক্ট , রোর 

Exit mobile version