ভূমিকম্প সম্পর্কে কম-বেশি আমরা সকলেই জানি। ভূমিকম্প শব্দটি দেখলে বা শুনলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ধ্বংসযজ্ঞের মর্মান্তিক দৃশ্য। কিন্তু, ভূমিকম্প কি শুধুই ধ্বংস করে নাকি সৃষ্টিও করে?
ভূমিকম্প হলে ভূ-পৃষ্ঠ আকস্মিকভাবে কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্পের ফলে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তা হলো ভূমিধস, সুনামি, ভবন ধসে পড়া, আগুন লাগা, বিপুল পরিমাণে প্রাণহানি সহ আরও অনেক। তবে, ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয় নানা ধরণের ভূ-প্রকৃতির। ভূমিকম্প সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে।
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠনঃ
পৃথিবীর অভ্যন্তরকে রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভক্ত করলে পাওয়া যায় তিনটি স্তর। এগুলো হলোঃ
১। ক্রাস্ট
২। ম্যান্টল
৩। কোর
আবার, পৃথিবীর অভ্যন্তরকে ভৌতিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বিভক্ত করলে পাওয়া যায় পাঁচটি স্তর। এগুলো হলোঃ
১। লিথোস্ফেয়ার
২। অ্যাস্থেনোস্ফেয়ার
৩। মেসোস্ফেয়ার
৪। আউটার কোর
৫। ইনার কোর
ভূ-পৃষ্ঠ বা পৃথিবীর সর্ববহিস্থ স্তরটি হলো ক্রাস্ট। ক্রাস্ট একটি সলিড বা কঠিন স্তর। এটির পুরুত্ব গড়ে ২০ কি.মি. এবং অভ্যন্তরে বিস্তৃতি প্রায় ৭০ কি.মি.। এরপর আসে ম্যান্টল, এটির বিস্তার ভূ-অভ্যন্তরের ২৯০০ কি.মি. পর্যন্ত। ম্যান্টল হলো লিকুইড বা তরল স্তর। ম্যান্টলের পরেই আসে কোর বা পৃথিবীর কেন্দ্র। কোর ভূ-অভ্যন্তরে প্রায় ২৩০০ কি.মি. বিস্তৃত স্তর।
লিথোস্ফেয়ার বা পাথুরে স্তর হলো ক্রাস্ট এবং ম্যান্টলের উপরিভাগ বা আপারম্যান্টলের কঠিন অংশ নিয়ে গঠিত স্তর। এই স্তরটি ভূতাত্ত্বিকভাবে সবচেয়ে সক্রিয়। লিথোস্ফেয়ারকে ঘিরেই সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি সহ বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার এবং ভূ-প্রকৃতির।
লিথোস্ফেয়ারের পর আসে যথাক্রমে অ্যাস্থেনোস্ফেয়ার, মেসোস্ফেয়ার, আউটার কোর এবং ইনার কোর। অ্যাস্থেনোস্ফেয়ার হলো মূলত ম্যান্টলের একটি অংশ। এটি তরল এবং উইক হওয়ায় একে প্লাস্টিক লেয়ারও বলা হয়। মেসোস্ফেয়ার হলো ম্যান্টলের নিম্নাংশ যা অ্যাস্থেনোস্ফেয়ারের চেয়ে কিছুটা শক্তিশালী। ভৌতিক বিশ্লেষণে কোরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে – আউটার কোর এবং ইনার কোর। এই দুটির প্রথমটি অর্থাৎ, আউটার কোর হলো লিকুইড লেয়ার বা তরল স্তর। দ্বিতীয়টি হলো সলিড বা কঠিন স্তর।
টেকটনিক প্লেট বা লিথোস্ফেরিক প্লেটঃ পৃথিবীর উপরিভাগ অর্থাৎ, লিথোস্ফেয়ার কয়েকটি অংশে বিভক্ত। এই প্রতিটি অংশকে একেকটি টেকটনিক প্লেট বা লিথোস্ফেরিক প্লেট বলে। পৃথিবীকে মোট ১৫ টি টেকটনিক প্লেটে বিভক্ত।
সবগুলো প্লেটই গতিশীল। প্লেটগুলো ৫-১০ সে.মি./বছর হারে গতিশীল। প্লেটগুলো একে অপরের সাথে এদের বাউন্ডারিতে বিভিন্নভাবে ক্রিয়া করে। ক্রিয়াকলাপের উপর ভিত্তি করে প্লেট বাউন্ডারিগুলোকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো-
১। ডাইভারজেন্ট বাউন্ডারিঃ
দুটি প্লেট পরস্পর বিপরীত দিকে ক্রিয়াশীল হলে সৃষ্টি হয় ডাইভারজেন্ট বাউন্ডারি। এধরণের বাউন্ডারিতে ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি দুটিই সংঘটিত হতে পারে। প্লেট দুটি বিপরীত দিকে ক্রিয়াশীল হওয়ার কারণে এধরণের বাউন্ডারিতে সমুদ্র সৃষ্টি হয়ে থাকে।
২। কনভারজেন্ট বাউন্ডারিঃ
দুটি প্লেট যদি পরস্পর একই দিকে ক্রিয়াশীল হয় তাহলে সৃষ্টি হয় কনভারজেন্ট বাউন্ডারি। এই বাউন্ডারিগুলোতে ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি সংঘটিত হতে পারে। দুটি প্লেট একই দিকে ক্রিয়াশীল হওয়ায় একটি প্লেট অন্যটির নীচে চলমান থাকে ফলে এধরণের বাউন্ডারিতে পর্বতমালা সৃষ্টি হয়।
৩। ট্রান্সফর্ম বাউন্ডারিঃ
দুটি প্লেট যদি পাশাপাশি অবস্থান করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘর্ষণের সৃষ্টি করে তাহলে তখন তা
কে ট্রান্সফর্ম বাউন্ডারি বলে। এধরণের বাউন্ডারিতে সাধারণত ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিঃ ভূমিকম্প মূলত উপরোক্ত তিন ধরণের প্লেট বাউন্ডারিতে সংঘটিত হয়ে থাকে।
টেকটোনিক প্লেটে ভূমিকম্প উৎপত্তির ধারণাটি ইলাস্টিক-রিবাউন্ড তত্ত্ব হিসাবে পরিচিত। অধ্যাপক এইচ.এফ. রেডের মতে, পৃথিবীর উপকরণগুলি স্থিতিস্থাপক হওয়ায় স্থায়ীভাবে বিকৃত না হয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে চাপ সহ্য করতে পারে, তবে যদি দীর্ঘকাল ধরে এই চাপ বা স্ট্রেস অব্যাহত থাকে বা এটি যদি প্রস্থে বৃদ্ধি পায় তবে শিলাগুলি প্রথমে স্থায়ীভাবে বিকৃত হবে এবং ফাটল সৃষ্টি হবে। যখন ফাটল সৃষ্টি হয় তখন দুপাশের শিলাগুলি তাদের স্থিতিস্থাপক ধর্মের কারণে তাদের মূল আকারে ফিরে আসে এবং শক্তির মুক্তি ঘটে। এই প্রত্যাবর্তন এবং আকস্মিকভাবে শক্তি মুক্তির কারণে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
প্রতিটি ভূমিকম্পেরই কেন্দ্র বা উৎপত্তি স্থল থাকে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা এপিসেন্টার থেকে ঢেউ-এর ন্যায় তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে এবং চারপাশ প্রকম্পিত করে তোলে। এই তরঙ্গগুলোকে বলা হয় “সিসমিক ওয়েভ”। সিসমিক ওয়েভ তিন ধরণের হয়। এরা হলো-
১। প্রাইমারি বা পি ওয়েভঃ প্রাইমারি বা পি ওয়েভ হলো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ। এটি কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয় মাধ্যমে চলতে পারে। এরা কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং উচ্চ কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট।
২। সেকেন্ডারি বা এস ওয়েভঃ সেকেন্ডারি বা এস ওয়েভ হলো অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। এটি শুধুমাত্র কঠিন মাধ্যমে চলতে পারে। এরাও কম তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং উচ্চ কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট।
৩। লাভ বা এল ওয়েভঃ লাভ বা এল ওয়েভ হলো মূলত তির্যক কম্পন। একে পৃষ্ঠ তরঙ্গও বলা হয়। এরা উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং নিম্ন কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট। ভূমিকম্পের তরঙ্গগুলির মধ্যে এল ওয়েভ সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক।
এই তরঙ্গগুলো ব্যবহার করে রিকটার ম্যাগ্নিচিউড স্কেল -এর মাধ্যমে ভূমিকম্প পরিমাপ করা হয়। রিকটার ম্যাগ্নিচিউড স্কেলের সর্বনিম্ন ম্যাগ্নিচিউড হলো ০ এবং সর্বোচ্চ ম্যাগ্নিচিউড হলো ৯। বেশিরভাগ ভূমিকম্প ৪ ম্যাগ্নিচিউডের নিচে হয়ে থাকে। কিন্তু, এর বেশি হলে অর্থাৎ ৬ ম্যাগ্নিচিউড পর্যন্ত মাঝারি আকারের ধরা হয়। ৬ এর বেশি হলে তখন তাকে শক্তিশালী এবং ৮ এর উপরে হলে তাকে প্রলয়ঙ্কারি ভূমিকম্প বলা হয়।
ভূ-প্রকৃতির সৃষ্টিঃ ভূমিকম্পের ফলে বিভিন্ন ধরনের ভূ-প্রকৃতির সৃষ্টি হতে পারে।
ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরি একে অপরের ওতপ্রোতভাবে জরিত। এই সম্পর্কের কারণ হলো এরা উভয়ই টেকটনিক প্লেট বাউন্ডারিতে সংঘটিত হয়ে থাকে। আবার আগ্নেয়গিরির কারণেও ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবী ছিল একটি জ্বলন্ত অগ্নিগোলক। কালক্রমে পৃথিবী আজ সবুজ-শ্যামল বসবাসযোগ্য গ্রহে পরিণত হয়েছে। এর কারণ অনবরত ভূমিকম্প এবং অগ্নুৎপাত হওয়া। অনবরত ভূমিকম্প এবং অগ্নুৎপাতের ফলে পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে গলিত ম্যাগমার উদ্গিরন ঘটেছে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে উদ্গিরিত ম্যাগমা ঠাণ্ডা হয়ে আগ্নেয় শিলায় পরিণত হয়েছে। আগ্নেয় শিলা হলো ক্রাস্টের অন্যতম মূল উপাদান। আবার এই শিলা বিভিন্নভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তৈরি হয়েছে মাটি। এভাবে সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর উপরিভাগ বা “ক্রাস্ট”। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট পর্বতমালা ক্রাস্টকে দৃঢ়তা দান করেছে।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!
ডিপ্রেশনঃ একটি মানসিক ব্যাধি; কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা (২য় পর্ব) Transfusion associated graft-versus-host disease : কি এবং কেন |
ভূমিকম্পের ফলে পাহাড়-পর্বত ছাড়াও দ্বীপ, টিলা, উপত্যকা, হ্রদ, উপসাগর এবং মহাসাগর সহ আরও অনেক ধরণের ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। যেমনঃ হিমালয়, মিয়ানমারের আরাকান যোমা উচ্চভূমি এবং বঙ্গোপসাগরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জও গঠিত হয়েছিল ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের মধ্যবর্তী মহাদেশীয় সংঘর্ষের ফলে।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এতে মানুষের কোন হাত নেই। কিন্তু, মানুষের কিছু কৃতকর্মের (যেমনঃ পাহাড় কাটা, পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা) ফলে কৃত্রিম ভূমিকম্পের সৃষ্টি হচ্ছে যার ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য তথা আমরা। আর জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ করার মাশুল এখন আমরা কড়ায় গণ্ডায় দিচ্ছি। প্রযুক্তির অপব্যবহার আমাদের প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তাই, এখনি সময় প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করে প্রাকৃতিক সহাবস্থানের।