বিজ্ঞান ব্লগ

মনের অজানা রহস্যঃ হ্যালুসিনেশন! (পর্ব-২)

পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে হ্যালুসিনেট হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। তন্মধ্যে অধিকাংশ মানুষই হ্যালুসিনেশন ঘটার কারনগুলো জানে না।

আচ্ছা হ্যালুসিনেশন কি?

পর্ব-১ এ আমরা জেনেছি যে হ্যালুসিনেশন হলো বাহ্যিক উদ্দীপনা (External Stimulus) ছাড়াই একধরনের উপলব্ধি যাকে বাস্তবে অনুভব করা যায়। সহজ বাংলা ভাষায় বলতে গেলে, হ্যালুসিনেশন একধরনের অনুভূতি যা আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন কিন্তু বাস্তবে এটির কোনো অস্তিত্ব নেই; মূলত বাহ্যিক উদ্দীপনার অনুপস্থিতেই এমনটি ঘটে থাকে। তবে আপনারা কি জানেন হ্যালুসিনেশন কতপ্রকারের হতে পারে এবং কতভাবে ঘটতে পারে? – হ্যালুসিনেশন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে কিংবা বিভিন্নভাবে সংঘটিত হতে পারে যা ইন্দ্রিয়কে প্রভাবিত করে। যার ফলে কখনো কখনো একাধিক সংবেদনশীল হ্যালুসিনেশনের সৃষ্টি হয় এবং ফলস্বরূপ আপনি অদ্ভুত অনেক কিছুই অনুভব করতে পারেন। যেমনঃ

• ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশনঃ এক্ষেত্রে আপনি চাক্ষুষ কিছু উপলব্ধি করতে পারবেন। এছাড়াও আপনি কোনো মানুষের উপস্থিতি বা আলোর ঝলকও দেখতে পারেন যা বাস্তবে অনুপস্থিত।

 

 

• অডিটরি হ্যালুসিনেশনঃ এই ধরনের হ্যালুসিনেশন মূলত প্যারাকিউজিয়া (Paracusia) নামেও পরিচিত। এক্ষেত্রে কোনো শ্রবণ উদ্দীপক ছাড়াই আপনি যেকোনো ধরনের শব্দ শুনতে পারবেন।

• অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশনঃ Phantosmia বা অলফ্যাক্টরি হ্যালুসিনেশন ঘ্রাণের সাথে সম্পর্কিত। এই ধরনের হ্যালুসিনেশনে কোনো গন্ধ/ঘ্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই।

• গ্যাস্টেটরি হ্যালুসিনেশনঃ গ্যাস্টেটরি হ্যালুসিনেশন(স্বাদের হ্যালুসিনেশন) হলো বাহ্যিক উদ্দীপক ছাড়াই স্বাদের অনুভূতি প্রত্যক্ষণ। এই ধরনের হ্যালুসিনেশন সাধারণত অদ্ভুত এবং অপ্রীতিকর হয়, ফোকাল এপিলেপ্সির(মৃগীরোগ বিশেষ) সমস্যাগ্রস্ত মানুষদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। বিশেষত টেম্পোরাল লোবের এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হয়।

এছাড়া আরও অনেক প্রকারের হ্যালুসিনেশন আছে তা হলো- Tactile, Proprioceptive, Equilibrioceptive, Nociceptive, Thermoceptive, Chronoceptive ইত্যাদি।

 

হ্যালুসিনেশন কেন সংঘটিত হয়?– আমরা অনেকেই ভেবে থাকি হ্যালুসিনেশন মানসিক রোগের দরুন ঘটে। কিন্তু হ্যালুসিনেশন বিভিন্ন প্রভাবকের দরুন অর্থাৎ বিভিন্ন কারনে ঘটতে পারে।

• স্কিৎসোফ্রেনিয়া/সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia): প্রথমত বলে নিচ্ছি স্কিৎসোফ্রেনিয়া কি?- এটি একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা যা ব্যক্তির চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা, আবেগ পরিচালনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধাপ্রদান করে বা কনফিউশানের সৃষ্টি করে। যেসব ব্যক্তি স্কিৎসোফ্রেনিয়া তে ভোগেন তাদের মধ্যে শতকরা ৬০-৯০ ভাগ অদ্ভুত কন্ঠস্বর শুনতে পান এবং তাদেরই মধ্যে ৭০ ভাগ মানুষ ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশনের শিকার হয়ে থাকেন।

• পারকিনসন রোগ ও লেওয়ি বডি ডিমেনশিয়া (Parkinson’s disease and Lewy body dementia) : পারকিনসন রোগ হলো এক ধরনের নিউরো-ডিজেনারেটিভ বা স্নায়ুবিক রোগ। আর লেওয়ি বডি ডিমেনশিয়া হলো এক ধরনের স্মৃতিভ্রংশ রোগ যা প্রকৃতপক্ষে স্নায়ুকোষে এক ধরনের জমাটবদ্ধ প্রোটিনের কারনে ঘটে। পারকিনসন রোগ মূলত লেওয়ি বডি ডিমেনশিয়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত কারন উভয় রোগের ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনের একই ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। এক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনের উপসর্গগুলো দৃশ্যপটের যেকোনো স্থানে সন্ধ্যার সময় ঘটতে পারে।

• মাইগ্রেন কোমা (Migraine Coma) : যখন কোনো ব্যক্তি কোমা দশা থেকে সুস্থতা অর্জন করেন তখন তার মধ্যে এক ধরনের হ্যালুসিনেশনের অভিজ্ঞতা ঘটে থাকে। তবে ব্যক্তি পুরোপুরি জাগ্রত থাকা অবস্থায়ও হ্যালুসিনেশন ঘটতে পারে।
• চার্লস বনেট সিন্ড্রোম (Charles Bonnet Syndrome) : পর্ব-১ এ আমি হয়তো চার্লস বনেট সিন্ড্রোম এর কথা উল্লেখ করেছিলাম কিন্তু বিস্তারিতভাবে বলা হয়নি। আংশিক বা গুরুতর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দ্বারা ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশনের অভিজ্ঞতাকে চার্লস বনেট সিন্ড্রোম বলা হয়। এ ধরনের হ্যালুসিনেশন যেকোনো সময়ই ঘটতে পারে।

• ঔষধঘটিত হ্যালুসিনেশন (Drug Induced Hallucination) :
ঔষুধঘটিত হ্যালুসিনেশন ঘটার পিছনেও অনেকগুলো কারন রয়েছে। তবে প্রধান কতকগুলো কারন হলো হ্যালুসিনোজেন্স (Hallucinogens-এগুলো এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ বা ওষুধ যা মানসিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং এটি বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমনঃ স্কিৎসোফ্রেনিয়া কিংবা স্বপ্ন ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে জড়িত),
ডিসোসিয়েটিভস (Dissociatives-এটিও হ্যালুসিনোজেনের একটি শ্রেনী যা দৃষ্টি ও শব্দের অনুভূতিগুলো কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে;
মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশগুলো যখন নির্দিষ্ট পরিমান সিগন্যাল পায় না তখনই এমন ঘটে), ডেলিরিয়েন্টস (Deliriants)- সহ বিভিন্ন অ্যান্টিকোলিনারজিক ওষুধের কারনে হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে।
Anticholinergic- এক ধরনের পদার্থ যা সিন্যাপস এর নিউরোট্রান্সমিটার এসিটাইলকোলিনের (ACh) এর ক্রিয়াতে বিঘ্ন ঘটায়।
উপরোক্ত প্রভাবকগুলো ও নির্দিষ্ট কিছু উদ্দীপক (Stimulants) ভিজ্যুয়াল ও অডিটরি হ্যালুসিনেশনের জন্য দায়ী। তবে একটি কথা না বললেই নয় যেটি হলো – হ্যালুসিনেশন, স্যুডোহ্যালুসিনেশন (Pseudohallucination), প্যারিডিলিয়া এবং অডিটরি হ্যালুসিনেশন মূলত অপিওয়েড (Opioids) শ্রেনীর ওষুধের উপর নির্ভর করে এবং এর ফলেই হ্যালুসিনেশনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
একটি বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলতে চাই এবং সেটি হলো প্যারিডিলিয়া সম্পর্কে। প্যারিডিলিয়ার ক্ষেত্রে আপনার চোখের সামনে কোনো বস্তুর গঠন কিংবা মেঘের আকৃতি ভেসে আসবে। যেমন ধরুন, আপনার সামনে একটি দেয়াল আছে যেখানে বিভিন্ন ধরনের কালির দাগ বা অন্য কিছুর দাগ আছে এবং ঐ দাগগুলো থেকে কোনো প্রানীর আকৃতি, মানুষের গঠন কিংবা যেকোনো বস্তুর আকার আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠতে পারে। অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই?
কিংবা ঐ মুহূর্তে আপনি ভাববেন এটা কিভাবে হলো?
কি ঠিক বলছি তো!!! – এটিই হলো প্যারিডিলিয়া (Pareidolia)। উপরোক্ত কারনগুলো ছাড়াও আরও বিভিন্ন কারনে হ্যালুসিনেশন ঘটে যেমন- সংবেদনহীনতাজনিত হ্যালুসিনেশন, অভিজ্ঞতাজনিত হ্যালুসিনেশন, ফোকাল এপিলেপ্সি ইত্যাদি। (বিস্তারিত – উইকিপিডিয়া)
নিউরোঅ্যানাটমিঃ
হ্যালুসিনেশন যথাযথভাবে মস্তিষ্কের মুখ্য ও গৌন সংবেদনশীল কর্টেক্সগুলোর গাঠনিক ও ক্রিয়ামূলক অস্বাভাবিকতার সাথে সম্পর্কযুক্ত। সুপেরিয়র টেম্পোরাল জাইরাস বা মিডল টেম্পোরাল জাইরাস অঞ্চলে গ্রে ম্যাটার হ্রাসপ্রাপ্ত হলে অডিটরি হ্যালুসিনেশনের সম্মুখীন হতে হয় (আশা করছি মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটার সম্পর্কে আপনাদের পূর্বধারণা আছে তাই এই বিষয়ে আর বলতে চাচ্ছি না)।
Visual Region – এ গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটার এর অস্বাভাবিকতার ফলে ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন সংঘটিত হয় যেটি কিনা আবার Alzheimer’s Disease এর সাথে জড়িত।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, এটি দুর্বল সংবেদনশীল প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। থ্যালামোকর্টিক্যাল সার্কিটের বিঘ্নতার কারনে এরকম ঘটে। থ্যালামোকর্টিক্যাল সার্কিট হলো মস্তিষ্কের থ্যালামাস ও কর্টেক্সের নিউরনসমূহের এবং সেই পাশাপাশি ইন্টার নিউরনগুলোর প্রজেকশনের সমন্বয়। এই সার্কিট নির্দিষ্ট কিছু ইলেকট্রোফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম প্রদর্শন করে যা সংবেদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত।
কিন্তু মস্তিষ্কে এইরকম অস্বাভাবিক তথ্য কিভাবে প্রেরন হয় ?
তাই আমি আগেই বলেছি মস্তিষ্কে গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটার হ্রাসের ফলে তথ্য ঠিকভাবে প্রেরিত হতে পারে না। মনে করুন আপনার হাতের পাচঁ আঙ্গুলের জায়গায় চারটি আঙ্গুল আছে; একটি নেই!! তাহলে আপনি কি সবসময় পাচঁ আঙ্গুলের কাজগুলো চার আঙ্গুলের মাধ্যমে সম্পাদন করতে পারবেন? হয়তো না! কারন কোনো না কোনো কাজে ব্যাঘাত ঘটবেই। তেমনি হলো মস্তিষ্ক। গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটার যদি প্রয়োজনের তুলনায় হ্রাস পায় তখন তথ্যগুলোও অস্বাভাবিকভাবে প্রেরিত হবে অর্থাৎ তথ্য প্রেরনে বিঘ্ন ঘটবে।
হ্যালুসিনেশনের চিকিৎসা পদ্ধতিঃ
যদিও  কিছু রহস্য এখন পর্যন্ত অজানা হয়ে আছে তবুও বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন কিছু কিছু হ্যালুসিনেশন মানসিক অসুস্থতার কারনে ঘটে থাকে। এখন পর্যন্ত সবধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয় নি। তবে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। যখন লক্ষ্মণগুলো তীব্র হয় তখন Antipsychotic এবং Atypical antipsychotic ড্রাগ (ঔষধ) মূলত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু এই চিকিৎসা সবধরনের হ্যালুসিনেশনের জন্য উপযুক্ত নয়।যাই হোক, হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগস গুলো থেকে বিরত থাকা, স্ট্রেস লেভেল ম্যানেজিং, সুন্দরভাবে জীবনযাপন ও পরিমিত ঘুম হয়তো এক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনের ঝুকি কমাতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে এটিই বলব, ” হ্যালুসিনেশন থেকে ভীত হবার কোনো কারন নেই কিন্তু সঠিকভাবে জীবনযাপনের ফলে হ্যালুসিনেশনের ঝুকি অনেকাংশে হ্রাস পাবে”
Exit mobile version