বিজ্ঞান ব্লগ

মনের অজানা রহস্যঃ হ্যালুসিনেশন! (পর্ব-১)

কানে শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে? অদ্ভুত কিছু দেখছেন যেটির প্রকৃতপক্ষে কোনো অস্তিত্ব নেই? কিন্তু আপনি সিজোফ্রেনিয়া কিংবা কোনো মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত নন! তাহলে এমনটি কেন ঘটছে? হ্যালুসিনেশন

হ্যালুসিনেশন (Hallucination) – যা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি শব্দ। হ্যালুসিনেশনের বাংলা আভিধানিক অর্থ হলো ‘মনভ্রান্তি/ভ্রম’।
সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে, ১৬৪৬ সালে একজন চিকিৎসক স্যার টমাস ব্রাউন (Thomas Browne) ল্যাটিন শব্দ ‘অ্যালুসিনারি (Alucinari)’ এর প্রবর্তন করেন যেটির অর্থ ‘মনের মধ্যে ঘুরপাক করা (wander in the mind)’; পরবর্তীতে এখান থেকেই Hallucination শব্দের উৎপত্তি।

“হ্যালুসিনেশন কি?”

– বাহ্যিক উদ্দীপনা (External Stimulus) ছাড়াই একধরনের উপলব্ধি যাকে বাস্তবে অনুভব করা যায়। সহজ বাংলা ভাষায় বলতে গেলে,  একধরনের অনুভূতি যেটি আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন কিন্তু বাস্তবে এটির কোনো অস্তিত্ব নেই; মূলত বাহ্যিক উদ্দীপনার অনুপস্থিতিই এমনটি ঘটে থাকে। 

 

 

কুইন্সল্যান্ড ব্রেইন ইন্সটিটিউটের একজন অধ্যাপক জন ম্যাকগ্রাথ (John McGrath) বলেন,”যারা দৈনন্দিন অনেক বেশি কাজ করেন তাদের মধ্যে হ্যালুসিনেশন হবার সম্ভাবনা বেশি।” তিনি আরও বলেন, সাধারনত ২০ জন মানুষের মধ্যে ১ জনের সাথে এমনটি ঘটে থাকে এবং তারা জাগ্রত অবস্থায়ই মাঝেমধ্যে কিছু দেখতে ও শুনতে পান। তবে হ্যালুসিনেশন কোনো অসুখ নয়; এটি মানুষের কাল্পনিক অভিজ্ঞতা থেকেই ঘটে। 

সাধারনত আমাদের মস্তিষ্ক বাহিরের জগতে সংঘটিত যেকোনো কিছু যেমন- বিভিন্ন ধরনের শব্দ, প্রতিচ্ছবি ইত্যাদির পার্থক্য করতে পারে এবং আমাদের মনে কি চলছে অর্থাৎ আমরা কি ভাবছি সেটিও মস্তিষ্ক বুঝতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনভ্রষ্ট হতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার একজন নিউরোফিজিওলজিস্ট বিশেষজ্ঞ ফ্ল্যাভি ওয়াটার্স (Flavie Waters) বলেন,” হ্যালুসিনেশন হওয়ার আরেকটি প্রধান তত্ত্ব হলো যখন মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব (Frontal lobe) ও সংবেদনশীল কর্টেক্স (Sensory Cortex) এর মধ্যকার ফাংশনে ত্রুটি দেখা যায় তখনই এমনটি ঘটে।”

 

এছাড়া, ইয়েল স্কুল অব মেডিসিন – এর একজন মনোবিজ্ঞানী ফিলিপ কর্লেট (Philip Corlett) ও তার সহকর্মী পাওয়ার্স (Powers) বলেন, মানুষের মস্তিষ্ক তার চারপাশে সংঘটিত সবকিছু বুঝতে পারে ও সংরক্ষণ করে রাখে। তাই, পুরাতন সংরক্ষিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে মস্তিষ্ক ‘ভবিষ্যৎদ্বানী কোডিং’ করে অর্থাৎ নতুন তথ্য নির্মিত করে ফেলে।

কর্লেট বলেন, আমরা যখন চারপাশে ঘুরে বেড়াই তখন আমরা শুধুই চোখ, নাক, কান ইত্যাদি সংবেদনশীল অঙ্গের মাধ্যমেই অনুভব করি না বরং আমাদের মন চারপাশে উপস্থিত সবকিছুর উপর একটি মডেলও তৈরি করে ফেলে। কর্লেট এবং পাওয়ার্স আরও বলেন, “মাঝে মাঝে আমাদের মস্তিষ্ক আগে থেকেই অতিরিক্ত ভবিষ্যৎদ্বানী (Over predict) করে ফেলে। এটি এমন কিছুও অনুমান করে ফেলে যেটির কোনো অস্তিত্ব নেই এবং এই অনুমানটা এতটাই দৃঢ় যে আমরা সেই অস্তিত্বহীন জিনিসটিকে উপলব্ধি করতে পারি” – এটিই মূলত হ্যালুসিনেশন!! 

হ্যালুসিনেশনের কারনে ব্যক্তি মাঝে মাঝে যেমন অদ্ভুত কিছু দেখতে পায় তেমনি কোনো কন্ঠস্বর বা অন্যান্য শব্দ শুনতে পায়। এছাড়া ত্বকে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতির সৃষ্টি হয় এমনকি ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের ঘ্রাণ উপলব্ধি করে থাকে।

 

তবে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষ হ্যালুসিনেশনকে মানসিক বিকারগ্রস্ততার পর্যায়ে ভেবে থাকেন কিন্তু এটি ভুল ধারনা বটে। হ্যালুসিনেশন সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যাপার হলো এটি স্বপ্ন (dreaming), ছদ্মভ্রম (pseudohallucination), কোনো কিছুর প্রতিচ্ছবি (imagery), ইল্যুশন (illusion), ডিল্যুশন (delusion) ইত্যাদি টার্ম গুলো থেকে কিছুটা ভিন্ন।

এগুলো পড়েছেন তো ?

হিরোশিমা-নাগাসাকি’র দুঃখ: ম্যানহাটন প্রকল্প

গ্রীণহাউস ইফেক্ট ও বৈশ্বিক উষ্ণতা :আমরা কি সঠিক পথে?

অর্কিড নিয়ে যত কথা এবং অন্যান্য আলোচনা

হ্যালুসিনেশন সংঘটিত হওয়ার আরও কিছু কারন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সিজোফ্রেনিয়া তে ভুগলে, অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে এমনটি ঘটে থাকে। এছাড়া ব্রেইন ট্রমা, চার্লস বনেট সিন্ড্রোম (Charles Bonnet Syndrome), ডিলিরিয়াম/Delirium ( এই ধরনের সিন্ড্রোম মানুষের মনোযোগ, চেতনা ও জ্ঞানের পরিধিতে বিশৃঙ্খলা ঘটায়), ঘুমে ব্যাঘাত, ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডার, ব্রেইনের টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি ও টক্সিনসহ বেশ কিছু কারনের জন্য হ্যালুসিনেশন ঘটে। মূলত বিভিন্ন ধরনের রোগের উপসর্গ দেখা দিলে এবং সেই পাশাপাশি ওষুধ গ্রহণের ফলে কোনো ব্যক্তি হ্যালুসিনেট হতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে “হ্যালুসিনেশন কোনো মানসিক ব্যধি নয়; বরং এটি মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ারই একটি ফল।”

[পর্ব-২ তে থাকছে হ্যালুসিনেশনের প্রকারভেদ, হ্যালুসিনেশন হওয়ার বিভিন্ন কারন, প্যাথফিজিওলজি ও এর চিকিৎসা সম্পর্কিত কিছু তথ্য]

Exit mobile version