বিজ্ঞান ব্লগ

মা দিবসের প্রবর্তক এ্যানা জারভিস-ই পরবর্তীতে মা দিবস বন্ধের জন্য লড়েছেন

মা দিবস চালু করার এক বছর পরের ঘটনা এটি। এ্যানা জারভিস ফিলাডেলফিয়ার ওয়ানাম্যাকার এর একটি দোকানে বসে তার খাওয়া সারছিলেন। হঠাত করে তার চোখ পড়লো দোকানের ঝোলানো ম্যনু কার্ডের উপর সেখানে একটা বিশেষ পদ ছিল, Mother’s Day salad. তিনি খাবারটি অর্ডার করলেন কিন্তু যখন সেটি আসলো তিনি হঠাত করে উঠে দাড়ালেন, খাবারটি মেঝেতে ছুড়ে ফেললেন এবং এর টাকা দিয়ে সেই জায়াগা থেকে বের হয়ে চলে আসলেন।জারভিস আসলে তারই প্রচলন করা ছুটির দিনের বহুব্যবহার নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলেন না এবং একটা বিশ্বাস তাকে গুড়িয়ে দিচ্ছিলো যে, বর্তমানে মা দিবসের যা হচ্ছে তা শুধুই বাণিজ্যিকীকরণ।

আমেরিকা গৃহযুদ্ধকালে,এ্যানার মা এ্যান জার্ভিস যুদ্ধে উভয়পক্ষের আহতদের সেবা এবং সাহায্য করেছেন। তিনি একই সাথে ইউনিয়ন এবং কনফেডারেট দলের মা’দের নিয়ে শান্তির জন্য চালু করেছিলেন Mother’s Friendship Day। কিন্তু যখন এ্যান জার্ভিস মারা যান, তার কন্যা খুব ভেঙে পড়েন। তিনি তার মায়ের নামে পাঠানো অসংখ্য চিঠি আর শোক বার্তা পড়তে থাকেন গভীর মনোযোগের সাথে, প্রতিটি শব্দ আলাদা করে ফেলেন যা তার মায়ের মহানুভবতা এবং দয়ার প্রকাশ হয়ে তার সামনে এসেছিল। সেই মূহুর্তে তার মাথায় একটা দিবস চালু  করার চিন্তা আসে যা তার মায়ের মত সকল মায়ের মাতৃত্ব এবং(তার) মায়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখবে।

অবশেষে ১০ই মে, ১৯০৮ সালে আসলো সেই শুভক্ষণ যখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটন এলাকায় যেখানে এ্যান জার্ভিস রবিবারের স্কুল পরিচালনা করতেন এবং ফিলাডেলফিয়ার ওয়ানাম্যাকার অডিটরিয়াম এ অনুষ্ঠিত হয় প্রথম মা দিবসের অনুষ্ঠান। সঙ্গত কারণে এ্যানা ভার্জিনিয়ার অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি, কিন্তু পাঠিয়েছিলেন ৫০০ সাদা কারনেশন ফুল, যা তার মায়ের খুব প্রিয় ছিল। এই ফুল মাথায় দিয়ে সেই স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা উপস্থিত হয়ে তাদের মা কে সম্মান জানিয়েছিল,এই ফুল আসলে মাতৃত্বের পবিত্রতাকেই তুলে ধরে।

আবেগ চাই, ব্যবসা নয়……

জার্ভিস খুব শীঘ্রই এই দিনের সাথে জড়িত অর্থনৈতিক দিকটার ব্যাপারে বিরক্ত হয়ে গেলেন। তিনি চেয়েছিলেন মা দিবস হবে, “ একটি আবেগের দিন,লাভ করার দিন নয়”। ১৯২০ সালের দিকে তিনি লোকজনকে মা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন দামী উপহার সামগ্রী এবং প্রচুর ফুল কিনতে নিরুতসাহিত করতে থাকেন। একইসাথে তিনি তার পূর্বের আর্থিক সমর্থক যেমন ফুল ব্যবসায়ী, কার্ড ব্যবসায়ী এর বিরুদ্ধে চলে গেলেন।তিনি এদের বিরুদ্ধে বললেন, “জলদস্যু, ডাকাত, দূর্বিত্ত যারা এই রকম পবিত্র, সুন্দর আর অভিজাত দিনের ভেতর নিজেদের লোভ কে চরিতার্থ করা ছাড়া কিছুই করছে না”!

এগুলো পড়েছেন?

ফ্লোরাল ইনডাস্ট্রির ব্যবসার প্রতিবাদে তিনি প্রায় লাখ খানেক সিলুয়েড বাটন পাঠিয়েছিলেন মেয়েদের স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি জায়গায় কোন খরচ ছাড়াই। এর পেছনে উদ্দ্যেশ্য ছিল এগুলো যেন সাদা কারনেশন এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হতে পারে, তখনকার সময়ে মা দিবসে সাদা কারনেশন ফুল ব্যবহার একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছিলো। তিনি মামলা দায়ের করার হুমকি দিয়ে এবং মা দিবসের সাথে কারনেশনের যোগাযোগ ঠেকাতে একটি ট্রেডমার্ক লাগানোর সিধান্ত নেন (যদিও তা তিনি করেননি)। এতে ফ্লোরাল টেলিগ্রাফ এ্যাসোসিয়েসন তাকে কমিশন এর প্রস্তাব দেয়, যা মা দিবসের বিক্রি থেকে আসবে।

এটা তাকে উত্তেজিত করা ছাড়া কিছুই করেননি, এর বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ চলতেই থাকে। ১৯৩৪ সালে আমেরিকার পোস্টাল সার্ভিস মা দিবসকে সমান জানিয়ে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এখানে যে  ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছিল তা Whistler’s Mother নামে পরিচিত এবং এর শিল্পী ছিলেন জেমস হুইস্লার। ডাকটিকিট দেখে জার্ভিস খুব হতাশ হয়েছিলেন, কারণ সেখানে একটা ফুলদানি ভর্তি কারনেশন এর ছবি যোগ করা  হয়েছিল যা তার কাছে মনে হয়েছিল ফ্লোরাল ইনডাস্ট্রির বিজ্ঞাপন।

এ্যান জার্ভিসের কাছে আদর্শ মা দিবসের উদাহরণ ছিল মা এর সাথে সময় কাটানো বা তার জন্য নিজহাতে চিঠি লেখা। এজন্য কার্ড বিক্রেতারদের তিনি সমর্থন করতে পারেননি। তার কাছে মনে হয়েছিল,একটা প্রিন্ট করা কার্ড বা কৃত্রিম ভাবে ছাপানো একটা টেলগ্রাম প্রমাণ করে যে আপনি খুবই অলস মাকে সম্মান জানানোর জন্য যিনি রাত দিন পরিশ্রম করে আপনাকে বড় করে তুলছেন। তার বিশ্বাস ছিল, যেকোন মা তার নিজ সন্তানের হাতে লেখা হিজিবিজি কিছুই পছন্দ করবেন, কোন কৃত্রিম কোন কার্ডের থেকে (কথাটা সত্য কিন্তু)।

 এই ব্লগগুলোও পড়তে পারেন-

অমসৃণতার পথে ক্রমাগত যাত্রা………

জার্ভিস সেই সব চ্যারিটির বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিলেন যারা মা দিবসকে পুজি করে অর্থ সংগ্রহ করতো। তাকে আমেরিকান ওয়ার মাদার ফাউন্ডেশন মিটিং থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়, কারণ অভিযোগ ছিল তিনি কারনেশনের বিক্রি বন্ধ এবং জনশান্তি বিনষ্টের চেষ্টা করছেন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এর বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরতে পিছপা হননি, কারণ তিনি মনে করেছিলেন রুজভেল্ট মা দিবসকে ব্যবহার করে চ্যারিটির জন্য ফান্ড রাইসিং করছেন (আয়রনী পার্ট ওয়ান…রুজভেল্ট আসলে সেই সব চ্যারিটির জন্য ফান্ড তুলছিলেন যারা অধিক মাতৃ মৃত্যু এবং শিশু মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়ছিল যা একসময় জার্ভিসের মা করতেন)। 

শেষবার যখন তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়, তখন তিনি মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরছেন একটা পিটিশন নিয়ে, শুধু একটা স্বাক্ষর এর জন্য – মা দিবস যেন উঠিয়ে দেওয়া হয়। দরকার নেই তার মা দিবসের,যে আদর্শ নিয়ে তিনি প্রচলন করেছিলেন এ দিবসের,কোন এক দূর্বিপাকে তিনি এর ভেতর শুধু বাণিজ্যিকীকরণ, টাকা, লাভ ছাড়া কিছুই খুঁজে পেলেন না।

শেষ জীবনে তিনি জনজীবন থেকে নিজেকে একেবারেই বিছিন্ন করে ফেলেন। তার শেষ জীবন ছিল ঋণে জর্জরিত এবং কাটিয়েছিলেন  মার্শাল স্কয়ার স্যানেটেরিয়াম এ, যা এখন পেন্সিলভানিয়ার ওয়েস্ট চেস্টার এর একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া মানসিক হাসপাতাল। তিনি মারা যান ২৪ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে (আয়রণী পার্ট টু,তাকে কখনো বলা হয়নি তার চিকিৎসা খরচ কারা বহন করছিল -আসলে এটা ছিল কৃতজ্ঞ ফুল ব্যবসায়ীদের ছোট একটি দল)

Exit mobile version