বিজ্ঞান ব্লগ

শকুন্তলা দেবী : একজন হিউম্যান কম্পিউটার

ইতিহাস সাক্ষী, মেয়েরা কখনোই ছেলেদের থেকে পিছিয়ে ছিলো না। আজ এমন একজন মানুষের সম্পর্কে বলতে যাচ্ছি, যিনি পিছিয়ে পরা নারীদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার অংশীদার। তার আগে আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিবো। ব্রিলিয়ান্ট ও জিনিয়াস এর মধ্যে পার্থক্য টা কোথায় ?

  আপনারা পার্থক্য টা করতে থাকেন ,আর আমি আমার ব্লগ টি শুরু করি। এশিয়ায় জিনিয়াস ব্যক্তিবর্গদের তালিকা খুবই স্বল্প। আর জিনিয়াস এর তালিকায় কোনো নারীদের নাম জানতে চাই, তা হাতে গোনা গুটিকয়েক। এরই মধ্যে জিনিয়াসের তালিকায় অন্যতম ছিলেন ভারতীয় মহিলা গণিতবিদ শকুন্তলা দেবী যাকে মানব ক্যালকুলেটার উপাধি দেওয়া হয়েছে। কিভাবে এই মানব ক্যালকুলেটর এর বহিঃপ্রকাশ হয়েছে তা  তুলে ধরা হলো।

জন্ম ও শৈশবঃ

১৯২৯ সালের ৪ নভেম্বর শকুন্তলা দেবী ব্যাঙ্গালুরুর গুট্টাহল্লী গ্রামে একটি  হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা এক সার্কাসের শিল্পী ছিলেন।

হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় সংসারে টানাপোড়ন লেগেই থাকতো। তিনি যখন প্রায় ৩ বছর বয়সী ছিলেন এবং তাঁর বাবা যখন তাসের ম্যাজিক দেখাতেন, প্রতিটা তাসের নম্বর তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। একটা সময় বাবা আবিষ্কার করেছিলেন যে, তাঁর মেয়ে সংখ্যাগুলি মুখস্ত করার একটি অস্বাভাবিক দক্ষতা সম্পন্ন একটি গাণিতিক প্রতিভাবান। যদিও বাল্যকালে শকুন্তলার অসাধারণ স্মরণ শক্তি ও সংখ্যা গণনার দক্ষতাকে তার বাবা বেশি গুরুত্ব দেননি।

যখন তিনি ৫ বছরে পা রাখলেন, তখন তার এই অসাধারন প্রতিভা তার বাবা জানতে পারে। তার বাবা যেহেতু সার্কাস দলে কাজ করে তাই তিনি শকুন্তলাকে দিয়ে বিভিন্ন সার্কাস শো করাতেন। এটাই হয়তো প্রথম কেউ, যিনি গণিতকে কোনো নাচ,গান অর্থাৎ সাংকৃতিক অনুষ্ঠানের মতো ‘স্টেজ শো’ বা ‘রোড শো’ তে নিয়ে গেছেন। তার গনিতের দক্ষতা দেখার জন্য দূর দুরান্ত থেকে অনেক দর্শক ও গণিতবিদরা আসতো যার ফলে তিনি ভালো খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

মাত্র ছয় বছর বয়সে শকুন্তলা মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে অসাধারণ এই দক্ষতার প্রদর্শনী করেন। অন্যান্য শিশুদের মতো তিনি পাঠশালায় যেতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করেন নি।

কারন, তাঁর বাবা মনে করতেন , “তাঁর মেয়ে সবাইকে শেখায় সেখানে স্কুল তাঁর মেয়েকে কি শিখাবে।” তাই প্রথাগত কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেন নি। শিক্ষিত না হলেও গণিত নিয়ে কেরামতি দেখানোর জন্য তিনি আন্নামালাই ইউনিভার্সিটির, ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি, হায়দরাবাদ ও বিশাখাপত্তনমের একাধিক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়তে একই ভাবে নিজের প্রতিভা গণিতের মাধ্যম তুলে ধরেন। 

ভ্রমণ যাত্রাঃ

১৯৪৪ সাল,শকুন্তলা তখন ১৫, বাবার হাত ধরে দেশের বাইরে পা রাখলেন। প্রথম ট্রিপ লন্ডনে, একটা ক্যুইজ কনটেস্ট। যেখানে বাকিদের হারিয়ে পুরস্কার জিতে নিলেন শকুন্তলা। বাড়ল আত্মবিশ্বাস। শুরু হলো বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণ যাত্রা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, জাপান, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, কানাডা, রাশিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, মরিশাস, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে নিজের স্কিল দেখিয়ে দিলেন শকুন্তলা। অবাক হলেন নামী দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-গবেষকরা।

শকুন্তলা থেকে হিউম্যান-ক্যালকুলেটর হবার গল্পঃ

১৯৫৫ সালে লন্ডনে বিবিসি-র শো তে শকুন্তলার মুখোমুখি হলেন সঞ্চালক লেসলি মিশেল। খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে শক্ত অঙ্কের হিসাব নিয়ে এসেছেন তিনি। শকুন্তলাকে ভুল প্রমাণ করতেই হবে। মিশেলের প্রশ্নের উত্তর কয়েক সেকেন্ডে দিয়ে দিলেন শকুন্তলা। কিন্তু মিশেল নাছোড়বান্দা।

বললেন, উত্তরটি ভুল। নিজের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ছিল তাঁর। পরে ক্যালকুলেটর ও কম্পিউটারে সেই হিসেব ফেলে দেখা গেল, শকুন্তলার উত্তরই সঠিক। ক্যালকুলেটর এই হিসাবটি কষতে সময় নিয়েছিল ১৮০ সেকেন্ড। অথচ, শকুন্তলা নিয়েছিলেন কয়েক সেকেন্ড মাত্র। মাথা নোয়ালেন বিবিসি-র সঞ্চালক। শকুন্তলার নাম হলো ‘হিউম্যান-ক্যালকুলেটার।’

১৯৭৭ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে ‘সাদার্ন মেথোডিস্ট ইউনিভার্সিটি’তে ডাক পড়ল শকুন্তলার। ততদিনে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মার্কিন মুলুকে। ২০১ ডিজিটের নম্বরের ২৩তম রুট করতে বলা হলো তাঁকে। শকুন্তলা কষে দিলেন ৫০ সেকেন্ডে। তাজ্জব হলেন অধ্যাপক। কারণ প্রবলেমটা বোর্ডে লিখতে তাঁর সময় লেগেছিল ৪ মিনিটকম্পিউটার সেটা সলভ করেছিল ১-২ মিনিটে

‘মানব কম্পিউটার’ খ্যাতিঃ
১৯৮০ সালের, ১৮ জুন। শকুন্তলা দেবীর অঙ্কের-ম্যাজিক দেখতে ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের ক্লাস ঘরে ছাত্রছাত্রীদের ভিড়। অধ্যাপক বোর্ডে দু’টো সংখ্যা লিখে দিলেন। দুটোই ১৩ নম্বরের সংখ্যা। গুন করতে হবে। ৭,৬৮৬,৩৬৯,৭৭৪,৮৭০*২,৪৬৫,০৯৯,৭৪৫,৭৭৯। শকুন্তলা দেবী সময় নিলেন ২৮ সেকেন্ডকোনও কম্পিউটারের সাহায্য নয়।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!

প্রোগ্রামিং-এর-হাতেখড়িঃ প্রাথমিক আলোচনা

গল্পে গল্পে কল্পবিজ্ঞান: কেমন হবে ২০৫০ সালের বিশ্ব?

পদার্থবিদ নীলস বোর এবং তার নোবেল প্রাইজ এর গলিয়ে ফেলার রহস্য

স্রেফ মুখে মুখেই অঙ্ক কষে উত্তর দিলেন ১৮,৯৪৭,৬৬৮,১৭৭,৯৯৫,৪২৬,৪৬২,৭৭৩,৭৩০। হাততালি দিয়ে উঠলেন ক্লাসে উপস্থিত পড়ুয়া, অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা। ‘দ্য বুলেটিন’ দৈনিকে ছবি দিয়ে ফলাও করে বার হলো শকুন্তলা দেবীর ব্যতিক্রমী প্রতিভার কথা। এর পরেও চমক দিয়েছেন বহুবার। ১৯৮২ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম উঠল অঙ্কের-জাদুকর শকুন্তলী দেবীর। বিশ্বে পরিচিতি হলো ‘মানব-কম্পিউটার’ (Human Computer) নামে।

 

শকুন্তলা দেবীর উপর গবেষণাঃ

শকুন্তলা দেবীর এই অসাধারণ ক্ষমতা প্রকাশ পেলে সমস্ত বিশ্ব ব্যাপী তার প্রদর্শনী শুরু হয়। কী রয়েছে এই মেয়ের মগজে? শকুন্তলা দেবীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে ১৯৮৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আর্থার জেসন তার উপর গবেষণা করেন। তিনি শকুন্তলা দেবীর মানসিক দক্ষতার উপর
বেশ কিছু পরীক্ষা করেন।

জেসন ১৯৯০ সালে তার একাডেমীক জার্নালে লেখেন, “৬১,৬২৯,৮৭৫ এর ৩ বর্গমূল এবং ১৭০,৮৫৯,৩৭৫ এর ৭ বর্গমূল করতে দিলে শকুন্তলা দেবী জেসনের নোটবুকে লেখার আগেই এগুলোর উত্তর ৩৯৫ ও ১৫ বলে দেন।” নানা রকম জটিল অঙ্কের সমস্যা দিয়ে তিনি নিশ্চিত হন, এই মেয়ের ব্রেন কাজ করে অসামান্য ক্ষিপ্রতায়।

প্রথম বই দ্য ওয়ার্ল্ড অব হোমোসেক্সুয়ালসঃ

গণিত প্রেমী এই নারীর প্রথম বই কিন্তু গণিত নিয়ে নয়। তাঁর প্রথম লেখা বইটির নাম ছিলো “The World of Homosexuals” ১৯৬৫-৭০ সালে সমকামিতা তখন আইনের চোখেই নয়, সমাজের চোখেও ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ অপরাধ।’ যৌন পছন্দকে তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেয়নি দেশ। সমকামিতাকে মানসিক অসুস্থতা বলেই দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগিয়ে এলেন শকুন্তলা দেবী। সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন শকুন্তলা দেবী।

তাঁদের মানসিকতা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেন তিনি। এই গবেষণার ফসল হলো তাঁর প্রথম বই। সমকামিতা যে অপরাধ নয়, সমকামীদের যাপন-পদ্ধতি শুধু আলাদা, এই বইয়ের প্রতি পাতায় সেটাই বুঝিয়েছিলেন শকুন্তলা। পরবর্তী কালে আন্তর্জাতিক মহলেও স্বীকৃতি পায় এই বই। বলা হয়, এলজিবিটি কমিউনিটির উপর এত বিস্তারিত তথ্য আগে কেউ লেখেননি। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু বই লিখেছেন যার মধ্যে আছে উপন্যাস,গণিত, ধাঁধাঁ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর বই।

নির্বাচনে অংশগ্রহণঃ
গনিতের বাইরেও নিজেকে লেখক,জ্যোতিষী হিসাবে পরিচিত করার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতেও পা দিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালে, তিনি মুম্বাই দক্ষিণ এবং অন্ধ্র প্রদেশের মেডাক (বর্তমানে তেলেঙ্গানার) থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে লোকসভা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখন মেডাকের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন যে, “তিনি মিসেস গান্ধীর দ্বারা বোকা বানানো থেকে মেডাকের মানুষকে রক্ষা করতে” চেয়েছিলেন। তিনি ৬৫১৪ ভোট ( মোট ভোটের ১.৪৭%) নিয়ে নবম স্থানে ছিলেন।

শেষ নিঃশ্বাসঃ
২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল শকুন্তলা দেবী ব্যাঙ্গালুরুতে শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান। তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই হার্ট ও কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বরে তার ৮৪ তম জন্ম দিবসে গুগল তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিশেষ ডুডল তৈরি করে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Exit mobile version