বিজ্ঞান ব্লগ

সার্জিক্যাল মাস্ক বনাম N95 মাস্কঃ আমাদের মাস্ক নিয়ে মাতামাতি

পুরো বিশ্বকে স্থবির করে দেয়া মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে ফেইস মাস্কের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, সাথে বেড়েছে সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ব। ক’দিন আগেও সেখানে একটি ভালোমানের মাস্ক ৩০ টাকায় পাওয়া যেত, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকায়।

আর অত্যন্ত নিম্নমানের মানে শপিং ব্যাগ তৈরিতে যে কাপড় ব্যবহৃত হয় সেই কাপড়ের মাস্ক বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকায়। আর অনলাইন শপগুলোর তো পোয়াবারো। কেনার আগে দেখার উপায় নেই। যেনতেন একটা মাস্ক তৈরি করেই তার গায়ে PM2.5 অথবা N95 লিখে দিচ্ছে।
 
এই PM2.5 অথবা N95 সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? অনেকে আবার সার্জিক্যাল মাস্ক পরে বাইরে ঘুরছেন নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাচতে।
 
আমি মাস্ক বিক্রেতা বা ডাক্তার নই। একটি প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ নিয়ে কাজ করি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শর্তমতে কোনো কর্মক্ষেত্রে Ambient Air Quality নষ্ট হলে সেখানে মাস্ক পরে কাজ করা বাধ্যতামূলক। কোন পরিবেশে কি ধরনের মাস্ক পরতে হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে।
 
বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মাস্ক বিক্রেতাদের প্রতারনা, ভন্ডামী ও আতংকিত মানুষের মাস্ক নিয়ে মাতামাতি দেখে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি।


সার্জিক্যাল মাস্ক

শব্দটা শুনলেই বোঝা যায় এটি কোথায় ও কি কাজে ব্যবহৃত হয়। সার্জারীর সময় ডাক্তার, নার্স ও সার্জারী সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা এটি ব্যবহার করেন। সার্জিক্যাল মাস্ক কিসের তৈরি, আকৃতি ও কতবার ব্যবহার করা যাবে তা 21CFR878.4040 অর্থাৎ Code of Federal Regulations (CFR) এর Title 21 (Food And Drugs) এ অন্তর্ভুক্ত Subchapter H (Medical Devices) এর Part 878 (General and Plastic Surgery Devices) এর Subpart E (Surgical Devices) এর Sec. 878.4040 Surgical Apparel এ বলা আছে।
 
যুক্তরাষ্ট্রের Centers for Disease Control and Prevention (CDC) এর তথ্যমতে “A surgical mask is a loose-fitting, disposable device that creates a physical barrier between the mouth and nose of the wearer and potential contaminants in the immediate environment.


If worn properly, a surgical mask is meant to help block large-particle droplets, splashes, sprays, or splatter that may contain germs (viruses and bacteria), keeping it from reaching your mouth and nose. Surgical masks may also help reduce exposure of your saliva and respiratory secretions to others.”
 
কাপড়ের পার্থক্যের কারণে সার্জিক্যাল মাস্ক যে থিকনেসেরই হোক না কেন সেটি দিয়ে স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাসের বিষয়টি সবচে গুরত্ব দেয়া হয়।

CDC আরো বলেছে “Surgical masks also do not provide complete protection from germs and other contaminants because of the loose fit between the surface of the face mask and your face.”
 
সার্জিক্যাল মাস্ক মুখের সাথে ঢিলেঢালাভাবে লাগানো থাকে এবং এটি এমনভাবে ডিজাইন করা যা নিঃশ্বাস নেয়ার সময় নাকের দুপাশে সিল/বায়ু চলাচলরোধ করতে পারে না। আর এটি ঘরের ভিতরে ব্যবহারযোগ্য, বাইরে নয়।
যারা এখন সার্জিক্যাল মাস্ক পরে বাইরে বের হচ্ছেন তারা নিজেরাই ভেবে দেখুন যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আপনার মাস্কটি কতটা কার্যকর?
 

N95 রেসপিরেটর/মাস্ক

মানবদেহে জন্য ক্ষতিকর বাতাসে ভাসমান অতিক্ষুদ্র কণার (০.৩ মাইক্রোমিটারের নিচে) শতকরা ৯৫ ভাগ আটকাতে পারে বলে এর নাম N95 রেসপিরেটর বা মাস্ক। এর পুরো নাম N95 FFRs বা N95 Filtering Facepiece Respirators হলেও N95 রেসপিরেটর হিসেবেই এটি সর্বাধিক পরিচিত।

এই মাস্কের উৎপাদন ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের Centers for Disease Control and Prevention (CDC) আওতাধীন National Institute for Occupational Safety and Health (NIOSH) বা CDC NIOSH under 42 CFR Part 84 এ নির্দেশনা দেয়া আছে।
 
N95 মাস্কটি মূলত কনস্ট্রাকশন ও শিল্প কল-কারখানায় যেখানে ধুলাবালি উৎপাদিত হয় সেখানে বেশী ব্যবহৃত হলেও এটি মাইক্রোঅর্গানিজম, বডি ফ্লুইড, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস সংক্রমণরোধেও বহুল প্রচলিত।


N95 রেসপিরেটর/মাস্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর এয়ার টাইট/বায়ুরোধ ক্ষমতা। মাস্কটি এমনভাবে তৈরি যে মুখে লাগানোর পর নাকের উপর একটি ফ্লেক্সিবল স্টাফ থাকে যেটিতে চাপ দিয়ে নাকের দুপাশের ভাজের সাথে মিলে যায় এবং মাস্কের কিনারা দিয়ে বাইরের বাতাস ভিতরে ঢুকতে পারে না।

এঅবস্থায় নিঃশ্বাস গ্রহন করলে মাস্কের ভিতরে শূণ্যতার ফলে বায়ুচাপ কমে গিয়ে মাস্কটি মুখের সাথে আরো শক্তভাবে চেপে থাকে এবং শুধুমাত্র ফিল্টার দিয়ে বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে। এই ফিল্টার বা ফিল্টার ক্লথ বিভিন্নভাবে মাস্কে লাগানো থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফিল্টারটি মাস্কের ভিতরের অংশে আলাদা লাগানো থাকে।
 
আমাদের দেশে এ ধরণের মাস্কে একটি প্লাস্টিকের এয়ার ভালভ্ লাগানো থাকে। এটি মূলত বহির্মুখি এয়ার ভালভ্ অর্থাৎ নিঃশ্বাস নেয়ার সময় এটি আটকে যায় ফলে কোনো বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে না বরং প্রশ্বাস ছাড়লে এটি দিয়ে দ্রুত বাতাস মাস্ক থেকে বাইরে বের হয়ে যায়।


N95 রেসপিরেটর/মাস্কের উপর অবশ্যই PM বা Particulate Matter এর মান লেখা থাকবে। Occupational Safety and Health Administration (OSHA), National Institute for Occupational Safety and Health (NIOSH), American Conference of Governmental Industrial Hygienists (ACGIH), United States Environmental Protection Agency (US EPA) সকলেই কনস্ট্রাকশন ও শিল্প কল-কারখানায় সৃষ্ট ধুলিকণার জন্য Permissible Exposure Limits ঠিক করেছে PM2.5। এখানে 2.5 হচ্ছে ঐ ধুলিকণার ডায়ামিটার যা 2.5 মাইক্রন বা মাইক্রোমিটার।
 
যদি কোনো মাস্কের উপর PM2.5 লেখা থাকে তার অর্থ হলো মাস্কটি ২.৫ মাইক্রন ডায়ামিটার পর্যন্ত ধুলিকণা/জীবাণূ আটকাতে সক্ষম।

রোগীর লক্ষণ প্রকাশের আগেও অন্যদের করোনা সংক্রমণ হতে পারে-মার্কিন গবেষণা

সার্জিক্যাল মাস্ক ও N95 রেসপিরেটর/মাস্কের পার্থক্য

সার্জিক্যাল মাস্ক মুখের উপর ঢিলাভাবে লাগাতে হয় এবং নাকের উপর দুপাশে ফাঁকা থাকে তাই এটি N95 রেসপিরেটর নয়। এটি সাধারণ মানুষের ও বাইরে ব্যবহার উপযোগী নয়।

আর N95 রেসপিরেটর তৈরি হয় টুপি আকৃতির যাতে নাকের উপর ফ্লেক্সিবল স্টাফ ও ভিতরে ফিল্টার থাকে যা সকলে ঘরে বাইরে যেখানে Potential Contaminant আছে সেখানে ব্যবহার করতে পারবে। আর একটি মাস্ক কোনভাবেই একাধিক ব্যাক্তি ব্যবহার করতে পারবে না।

রক্তের গ্রুপ ‘A’ হলে করোনা ঝুঁকি বেশি, ‘O’ হলে সবচেয়ে কম – বলছে চীনা গবেষণা

নভেল করোনা ভাইরাস ও মাস্ক

ভাইরাস এতটাই ক্ষুদ্রাকৃতি যেটিকে আসলে মাস্ক দিয়ে পুরোপুরি আটকানো সম্ভব নয়। কিন্তু নভেল করোনা ভাইরাস একা একা বাতাসে বেশিক্ষণ বাচে না বা আসে না। সংক্রমিত কেউ যখন হাচি/কাশি দেয় তখন তার মুখ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র থুতু আকারে অসংখ্য Respiratory Droplets বের হয় যার মধ্যে এই ভাইরাসগুলো থাকে।

করোনা ভাইরাসের সকল আপডেট


আমরা একটি PM2.5 মাত্রার N95 রেসপিরেটর/মাস্ক পরে থাকলে এই Respiratory Droplets গুলো সরাসরি আমাদের নাকে বা মুখে প্রবেশ করতে পারবে না। মাস্ক সেগুলো আটকে দিবে। আর বাতাসে কিছুক্ষণ থাকলে Droplets গুলো শুকিয়ে যাবে এবং করোনা ভাইরাস কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।
 
যদিও World Health Organization (WHO) বলছে কোনো সুস্থ মানুষের কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংস্পর্শে যাবার প্রয়োজন না থাকলে মাস্ক পরার দরকার নেই। কিন্তু WHO তো জানে না যে, আমরা বাঙালীরা কোনো শিষ্ঠাচার না মেনেই যেখানে সেখানে হাচি/কাশি দিই এবং হাই তুলি। আর দেশে কোন অঞ্চলে, কি পরিমাণে এমনকি নিজেও করোনায় সংক্রমতি হয়েছি কিনা জানিনা।


তাই বাইরে জনসমাগমে যাবার প্রয়োজন হলে, অন্যের থেকে নিজের অথবা নিজের থেকে অন্যের সংক্রমণ এড়াতে আমরা সকলে একটি PM2.5 মাত্রার N95 রেসপিরেটর/মাস্ক ব্যবহার করব।
নেহায়েতই এই মাস্ক না পাওয়া গেলে সাধারণ মাস্ক এমনকি সার্জিক্যাল মাস্ক পরেই বাইরে যাবো যেন কেউ হাচি/কাশি দিলে Respiratory Droplets গুলো সরাসরি আমাদের নাকে বা মুখে চলে না আসে।
 

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় অন্যান্য নির্দেশনাবলীও মেনে চলুন। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন।

@Jamail Basir JB
    Environmental Specialist at Energypac
    Former Manager at Ekushey Television
Exit mobile version