বিজ্ঞান ব্লগ

(সায়েন্স ফিকশন) ড্যাজল-২: অন্য একটা পৃথিবী -পর্ব ১

১.
খুব একটা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে না সুহানার। সহজেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে মাইনাস পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা। ৭৪ বছর ধরে তৈরি করতে থাকা মহাকাশযান ‘লুকিং ফর লাইফ(এলএফএল-১৮)’ -এ করে কাঙ্ক্ষিত গ্রহ ড্যাজল-২ এ পৌঁছেছে সুহানা ও নিশাদ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে দ্বিতীয় বসবাস উপযোগী গ্রহ আবিষ্কার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। এর আগে মঙ্গলে পৌছানোর প্রচেষ্টা সফল না হলেও এক্ষেত্রে মানুষ সফল হয়েছে।

কিন্তু যতোটা না নিজেদের অবদানে তার চেয়েও বেশি রোবটদের দক্ষতায়। বর্তমানে ৪০২০ সালে এসে বিবর্তিত হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতি যখন পৃথিবী পৃষ্ঠের পরিবর্তে ভূগর্ভে বসবাস করছে, তখন সেখানে কৃত্রিম পদ্ধতিতে তাপমাত্রা মাইনাস ১০ ডিগ্রী থেকে প্লাস ১৫ ডিগ্রী রাখার চেষ্টা করা হয়।
-সুহানা, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
-হ্যা, নিশাদ। আমি শুনতে পাচ্ছি তোমাকে।

অর্থাৎ শব্দ তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়মেই।

-ড্যাজল-২ থেকে ২০৫৮ সালে যে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সিগন্যাল পাঠানো হয়েছিলো পৃথিবীতে তা মূলত গ্রহের উত্তর অংশ থেকে। আমাদের ওখানে যেতে হবে, সুহা। হয়তো ওখানেই পাবো কাঙ্ক্ষিত এলিয়েন।

৭৪ বছরে ১৫৬ রোবট ৩৫ জন মহাবিজ্ঞানীর পরিশ্রমের ফলে তৈরি করা মহাকাশযান এলএফএল-১৮ পড়ে রয়েছে একপাশে। প্রাণহীন জড় বস্তুটার যেন মৃত্যু হয়েছে প্রাণীদের মতোন। নিস্তেজ। শুনশান চারপাশ। নিশাদের হাতটা ধরে ওঠার চেষ্টা করলো সুহানা। কিন্তু পারলো না। পায়ের দিকটা কেটে গেছে বেশ খানিকটা।

সবুজ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, বেশ ভালো পরিমাণ রক্তই। বায়োলজিকাল ক্লকে যার স্ট্যাটাস দেখাচ্ছে ‘পেইনফুল’। তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হবার কথা সুহানার। কিন্তু হচ্ছে না। পঞ্চম প্রজন্মের রোবটরা তাদের যে ক্যাপসুল খাইয়ে ড্যাজল-২ এ পাঠিয়েছে তার কাছে এইটুকু ব্যাথা যেন কিছুই না।

২.
হাটতে হাটতে অনেকটা পথ চলে এসেছে দুজন। তারা জানে না আর কখনো পৃথিবীতে পৌঁছতে পারবে কিনা। আন্ডারগ্রাউন্ডের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিকেল আর উপভোগ করা হবে কিনা। হয়তো এই নতুন পৃথিবীতেই তাদের বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। রোবটদের সাথে নিশাদ যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

তীব্র অনিশ্চয়তার মাঝে আচমকা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে সুহানা। বরফে আচ্ছাদিত এই জায়গাটা বেশ পরিপাটি। দুপাশে দুটো সরু পথে নেই বরফের স্তুপ। সাইনবোর্ডে বড় বড় করে কী যেন লেখা। ট্রান্সলেটর যন্ত্র দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে দুজনই। চতু্র্থ প্রজন্মের রোবটের সহায়তায় এই গ্রহ থেকে পাঠানো সিগন্যালের প্রেক্ষিতে বানানো হয়েছিলো এই ট্রান্সলেটর। পুরোপুরি অনুবাদ না করা গেলেও, একটা শব্দ বেশ স্পষ্ট; ‘সামনে পল্লীগ্রাম’।
-তার মানে এখানে প্রাণ রয়েছে?
চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে সুহানা।
-হ্যা। কিন্তু খুশি হবার মতো কোনো কারণ আমি দেখছি না।
-কেন? আমরা তো এলিয়েন আবিষ্কারের খুব সন্নিকটে।

 এই ব্লগগুলোও পড়তে পারেন-

চুপচাপ চারদিকে তাকিয়ে জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করে নিশাদ। কী যেন ভয় খেলে যায় তার মনে।
-আমরাও কিন্তু তাদের কাছে এলিয়েন, সুহা। এবং আমরা জানি না তাদের আচরণ সম্বন্ধে।
ঠিক তখনই ৪ থেকে ৫ জন মানুষ ঘিরে ধরলো তাদের। নিশাদ বুঝতে পারলো সহজেই, এরা লাল রক্তের মানুষ, যাদের রক্তে ক্লোরোফিল নেই, আছে হিমোগ্লোবিন। ম্যাগনেসিয়ামের জায়গায় যাদের কেন্দ্রিয় মৌলটা আয়রন। নিশাদ ও সুহানার মতোন এরা সূর্যের আলোয় খাদ্য তৈরি করতে পারে না। ঠিক যেন একবিংশ শতাব্দীর আদি মানুষ।

নিজের ভেতর কেমন যেন একটা টান অনুভব করছে নিশাদ। কিন্তু এমনটা হবার তো কথা না। রোবটরা বিশেষ প্রক্রিয়ায় অনেক আগেই তাদের আবেগ প্রায় শূন্যের ঘরে নিয়ে এসেছে। ‘ইমোশন স্কেলে’ তাদের আবেগ দেখায় দশমিক একেরও কম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিশেষ বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করলো প্রাণিগুলো। মাঝখান থেকে একজন মন মাতানো কণ্ঠে গান ধরলো, ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে…’

৩.
এখন পেছনে ফিরে গিয়ে আড়াই হাজার সালের কিছু বেশি সময়ের কথা বলা হবে। পৃথিবী পাড়ি দিচ্ছে চরম সংকটময় পরিস্থিতি। বায়ূতে অক্সিজেনের পরিমান উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অসহনীয় পর্যায়ে। মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে গেছে ‘লাং অব আর্থ খ্যাত মহাবন আমাজন’। সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এক-তৃতীয়াংশ স্থলভাগ। গাছপালা নিঃশ্বেষ হতে চলেছে তড়িৎগতিতে। এরই মাঝে একদল গবেষক মানবদেহে ক্লোরোপ্লাস্ট স্থাপন করে সফল হলেন। প্রতিটা মানুষের দেহে এখন কৃত্রিম ক্লোরোপ্লাস্ট। ফলে মানুষ নিজের খাদ্য নিজেই তৈরি করতে পারছে।

এ যেন পৃথিবীর নতুন শুরু। টিকে যায় মানবসমাজ। সাময়িক সময়ের জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয় মানবক্লোন তৈরিকে। ধীরে ধীরে আবার স্থির হতে থাকে পৃথিবী, ফিরতে শুরু করে চিরচেনা যৌবনে। কিন্তু, কীসের কী? একটা সময় নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ আবারো তার বাসস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বিবর্তনের ধারায় বসবাস শুরু হয় ভূ-অভ্যন্তরে। মানুষের চেয়ে যেখানে রোবটের সংখ্যা বেশি। রোবটরা যা চায় মানুষকে সেভাবেই চলতে হয়।

যে স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে কতো সংগ্রাম লেখা হয়েছে ইতিহাসের পাতায়, তা এখন হাহাকার করে। মানুষের মতো রোবটরাও নতুন বসবাস উপযোগী গ্রহের সন্ধান করছে। কিন্তু বিভিন্ন গ্রহে রোবটের বদলে পাঠানো হচ্ছে মানুষ। নতুন গ্রহ যতোটা না মানুষের জন্য তার চেয়েও বেশি রোবটদের জন্যই। তারাও জানে, ফুরিয়ে আসছে পৃথিবী। এরই ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গ্রহ ড্যাজল-২-এ পাঠানো হচ্ছে নিষাদ ও সুহানাকে।

রোবট ও মানুষের সম্মিলিত জোট থেকে অনুমোদন পত্র পাঠানো হয়ে গেছে। নিষাদ ও সুহানার জন্য এই সুযোগ বেশ সম্মানের। যেসব মানুষকে নতুন গ্রহে অবতরণ করা হয়েছে, মানবসমাজ ও রোবটসমাজে তাদেরকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হয়। অথচ এখন অবধি কেউ ফিরে আসেনি। ধারণা করা হয় গ্রহগুলোর বায়ুমন্ডল ভেদ করে মহাকাশযান অবতরণ করলেও তীব্র ঠান্ডা, গরম কিংবা বিষাক্ত ধুলিকণার কারণে মৃত্যু হয়েছে তাদের।

এগুলো পড়েছেন?

সেই মহান মানুষগুলোর নাম ‘দ্য মিউজিয়াম অব আন্ডারগ্রাউন্ড-বিউটিতে’ সম্মানের সাথে লিপিবদ্ধ আছে। এবার সবাই আশা করছে ড্যাজল-২ এ ভালো কিছু আছে। সফল হবে তাদের সকল প্রচেষ্টা। গ্রহটি সম্বন্ধে পূর্ববর্তী রেকর্ডও ইতিবাচক। নিষাদ ও সুহানা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ে এলএফএল-১৮-এ। তীব্র গতিতে ছুটে চলছে তাতা। শুরুতে খানিকটা মানিয়ে নিতে সমস্যা হলেও, সময়ের সাথে কেটে যায় অনভ্যস্ততা। অনেকটা দূর চলে গেছে। উপর থেকে পৃথিবীটাকে দেখতে কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছে! ধীরে ধীরে দূরত্ব বেড়ে যায়। একসময় হারিয়ে যায় প্রিয় পৃথিবী।

(চলবে….)

Exit mobile version