বিজ্ঞান ব্লগ

সায়েন্স ফিকশন “সেকশন 21”

আকাশটা কি বেশিই মেঘলা লাগছে?” নিজেকে আবার প্রশ্ন করে ইরা।অবশ্য নিজেকে প্রশ্ন করে আবার মন থেকে উত্তর পাওয়া বেশ পুরোন ট্রেন্ড……তাও সে এটা করে।কিংবা বাধ্য হয়ে নির্ভর করতে হয় কোন AI  এর উপর।চিন্তাটা যেন তার AI এ্যাসিস্টেন্ট এর সাথে শেয়ার করার জন্যই বিড়বিড় করে বলে,”আকাশ এত মেঘলা…..”

কিন্তু ক্রোনাস,ইরার পার্সনাল Ai ,আবেগের খুব কম কাছাকাছি গেল।চিরচেনা ধাতব কন্ঠে শুরু করলো,”আজকে টিপ টিপ বৃষ্টি হতে পারে।ভাল হয় তুমি একটা ছাতা নিয়ে যাও….যদিও তুমি আমার কথা আজকাল খুব একটা শুনছো না।ইরা মনে মনে খুব হতাশ হয়।কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দটা বের করতে পারে না,কোথাও যেন আটকে যায়।অভ্যাস,কোন বৈজ্ঞানিকের ভাষায় সহজাত প্রতিবর্ত।

আস্তে আস্তে জানালার কাছে হেটে যায় সে,নাকটা ঠেসে ধরে জানালার কাচের সাথে ।তার এই ছোট বাসস্থানে দেখার মত কিছু নেই,জানলাটা ছাড়া।পুর ঘরের অর্ধেকটা জুড়ে আছে জানালাটা,বিশাল,আর অদ্ভুতরকম স্বচ্ছ।যেন পুরো শহরের কাছে প্রকাশ করে দিচ্ছে সব,যদিও দেখতে হলে ২২ তলা পায়ের নিচে রেখে আসতে হবে।

‘বাইরে যাবে না?” ক্রোনাস নরম গলায় প্রশ্ন করে।‘নরম গলা’,ব্যাপারটা ইরার মাথা ক্রশ করে যায়।ভলিউম আর কম্পাংকের কারিকুরি….গলাটা মানবিক করার একটা সুক্ষ প্রচেষ্টা।

“কিন্তু যাবটা কোথায়?’ইরা প্রশ্নটা না করে পারে না।

Related Article:আলাস্কা ট্রায়াঙ্গেলঃ রহস্য, কল্পনা ও বাস্তবতা

“ক্যাফে গিয়ার,তুমি নিশ্চয় ভুলে গেছ আজকে শুক্রবার।“ ইরা শ্রাগ করে…. শুক্রবারটা তার জীবনে মাহাত্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে না।শহরে মাত্র ২০ হাজার ইউনিট আয় করা কোন লোকের জীবনে শুক্রবার কোন বিশেষ পরিবর্তন নিয়ে আসে না।ক্রোনাস শুধু চেষ্টা করছে যেন ইরা তার দিনের কাজে বিরক্ত না হয়ে যায়।এই শহরের প্রোডাক্টিভিটি দরকার,মানুষ নয়।তাও ইরা বিছানা গুছায় আর গায়ে জ্যাকেটটা চাপিয়ে বাইরে বের হয়। মাস্কটাও নিতে ভুলে না ……

সাধারণত এমন মেঘলা দিনে কুয়াশা পড়ে না,আজকে পড়েছে।তার সাথে যোগ হয়েছে অন্ধকারচ্ছন্নতা।তাও রাস্তার জনসমাগম কমেনি।অনেকেই এসেছে তাদের নিজস্ব AI এর তাড়া খেয়ে,বাকিরা এমনি।ভীড়ের ভেতর EP রোবটগুলোর হলুদ চোখগুলো পিটপিট করে জ্বলছে।হ্যা,EP……বড় করে বললে emotion police।এদের কাজ হল লক্ষ রাখা,কেউ যেন কোন আবেগ প্রকাশ করে না…..সামান্যতম লক্ষণও যেন নয়।

সেকসন ২১ এর বিশেষ ধারার বদৌলতে এরা আবেগ প্রকাশ করার অপরাধে গ্রেফতার করতে পারে,অপরাদের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত দেবার নজির আছে।তাও ভাল,এগুলো কোন চিন্তা পড়তে পারে না,তবে,সম্প্রতি নাকি তাদের সেই ক্ষমতা দেবার চিন্তা ভাবনা চলছে।তবে সাধারন মানুষ থেমে নেই,বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করছে রোবটের চোখকে ফাকি দেবার।মাস্ক পড়া তারই একটা অংশ,ইরা চলতি পথে একটা রোবটের দিকে ভেংচি মেরে চলে আসল…..কিছুই হল না।মাস্কটা কাজ করছে তবে।

সেকশন ২১ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে,এমন কি বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছে।কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।কতৃপক্ষের বিশ্বাস,মানুষের প্রোডাকটিভিটি কমে যাওয়ার কারন হল অযথা আবেগ প্রকাশ।গত দশকে যখন রোবটের প্রভাবে মানুষের কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হতে সুরু করে,তখন প্রায় হঠাত করেই একদল মানুষের মাথায় আসে এই আইডিয়া।যদিও এই সুদূরপ্রসারী(?)প্রভাবের ফল এখন হয়েছে ভয়াবহ।

“মানুষের প্রডাক্টিভিটি বেড়েছে,কিন্তু লাইফটাইম কমেছে….মানুষের বিষণ্নতা বেড়েছে”,ইরার মাথায় হরবর করে চিন্তা গুলো বেড়ে চলে।“থামো!”কানের ভেতরটা ঝনঝন করে ওঠে,ক্রোনাসের গলা এটা আর আসছে কানের ইয়ারবাড থেকে।এবং ইরার খেয়াল হল সে ক্যাফের সদর দরজার সামনে,আরেকটু হলেই মাথাটা ঠেকে যাচ্ছিল।পাশে একটা ভার্টিকাল এ্যাপার্টমেন্ট,অবশ্য সেখানে যারা থাকে তারা ভুলেই গেছে তারা যে এককাল মানুষ ছিলো।

ক্যাফেটা চারটা ইউনিটে বিভক্ত,অবশ্য প্রত্যেক ইউনিটে একই সার্ভিস দেওয়া হয়।যদিও আশ্চর্যজনক নয়,কিন্তু ক্যাফেটা লোকজনে ভর্তি……টেবিল একটাও ফাকা নেই।“শেয়ারে বসতে হবে”,ইরা বিড়বিড় করে,”সবচেয়ে বিরক্তির কাজ”।অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না,তার আগেই একটা টেবিল খালি হয়ে গেল আর ইরা সেটাই দখল করলো।

ফিসফিস করে ইয়ারবাড এর রিসিভার দিয়ে ক্রোনাস কে একটা কমান্ড করল,’নিশ্চয় বলে দিতে হবে না,আমার পুরোনো লিস্ট এ্যানালাইসিস করে যে কফিটা বেশি ওর্ডার দিয়েছি সেটাই…”অবশ্য গত কয়েক শুক্রবার সে একটাই আইটেম ওর্ডার করে এসেছে,একটা আইটেমই সে এফোর্ট করতে পারে।

কি একটা ভাবনায়  ডুবে গিয়েছিল,হঠাত করে একটা কন্ঠ তার চিন্তার জালটা ছিড়ে দিলো।“ আমি কি বসতে পারি?”একটা কাপাকাপা গলায় অনুরোধ ভেসে আসে। ইরা মুখ তুলে দেখতে পায় এক মাঝবয়সী লোক তার দিকে অশহায় ভাবে  তাকিয়ে আছে,”সেই টেবিল শেয়ার”,আবার চিন্তা করে ইরা,তারপর অনুমতি দেয়।লোকটাকে পর্যবেক্ষন করা শুরু করে সে,গায়ের রঙ শ্যামলা আর চোখটা কালো।তিনি কোন কারণে খুব বিধস্ত আর পোশাক দেখে মনে হচ্ছে,তার থেকে একটু বেশি আয় করেন।

“ছেলেটা ছিল খুব হাসিখুশি”…বিড়বিড় করে বলল লোকটা

“Sorry,আমাকে কিছু বললেন?”

“তুমি শুনতে চাইলে শুনতে পারো”

‘বলুন,এটা কি আপনার ছেলে?” ইরা স্মার্টফোনে ভেসে আসা একটা ছবির দিকে নির্দেশ করে,একেবারে তরুণ একটা ছেলে।

করোনাভাইরাস আপডেট

“হ্যা,আমার ছোট ছেলে,কলেজে পড়ত…..এই বছরের শুরুর দিকে ভর্তি হয়েছিল।খুব হাসতে ভালবাসতো সে,জানোত।আর আমরা খুব ভয়ে থাকতাম।এজন্য বারেবারে তাকে নিষেধও করেছিলাম।তাও সে মানতো না,তার রুমটা সাউন্ড প্রুফ করেছিলো।কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি,তাকে ধরে নিয়ে যায়।“

‘এখন?’

‘কিছু না,তার আজকে সেকশন A তে নিয়ে যাবার কথা….এবং এতক্ষণে হয়তো নিয়েও গেছে।‘

গা টা ছমছম করে উঠলো ইরার,সেকশন A হল ফায়ারিং স্কোয়াড এর একটা পোশাকি নাম,যাদের দন্ড বিবেচনা করে বেশি মনে হয়,তাকে without any সেকেন্ড বিবেচনা করে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।আন্দাজ করে অপরাধটা,নিশ্চয় কোন EP এর সামনে হেসে ফেলেছিল।

“তোমার ধারণা একদম সঠিক,জোরে হেসে ফেলেছিল….’

কিছু বলার আর ইচ্ছা নেই ইরার,নিজেই জমে গেছে।ভাবছে,সে তো আসার পথে ধরাও পড়তে পারতো।আবার অজানায় একটা সমবেদনায় মনটা ভরে যাচ্ছে।

“আমি খুবই দুঃখিত,মিস্টার……”

“কুশান,কুশান উডল্যান্ড”

আবার একটা ধাক্কা,কুশান উডল্যান্ড এলাকার স্বনামধন্য এক চিকিৎসক এবং তার ছোট ছেলেকেই…….ইরা আর এক মূহুর্ত সেখানে থাকে না,তার অসুস্থ লাগছে।এক রকম দৌড়ে নিজের এপার্টমেন্টে ফিরে আসে……কিন্তু কোন শ্বাস ছাড়তে পারে না,আইনের সংশোধনে বলা আছে….যেকোন রকম অঙ্গভঙ্গি শাস্তির পর্যায়ে পড়বে।

তিনদিন পর…………………….

‘আজ আকাশ মেঘলা থাকবে এবং বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা ৮৯%’

ক্রোনাসের মডিউলটার ভলিউম কমিয়ে ইরা আকাশের দিকে তাকায়।মেঘ করেছে অবশ্য,বৃষ্টি কি আদৌ পড়বে?জানালার কাচে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নাকটা চেপে ধরে…..এবং চোখ যায় ক্রোনাসের মডিউলটার দিকে,একটা লাল বিপার জ্বলছে অর্থাৎ ক্রোনাস কিছু বলতে চায়।বিচানার দিকে যেতে যেতে বিপারটার সুইচ অন করে সে,আর অপেক্ষায় থাকে কথা শুরু করার…

“সেই ভদ্রলোক কে মনে আছে তোমার?”ক্রোনাস মৃদু গলায় বলে।

“কোন ভদ্রলোক?”,ইরা বিছানা ঠিক করতে করতে তাকেই আবার প্রশ্ন করে

আকাশটা কালো করে ফেলেছে হুট করে…..

ক্রোনাস তার স্বরের কম্পাঙ্ক কমিয়ে দেয়,গলাটা পুলপীটে ওঠা ধর্মযাজকের মত করে বলে,”সেই ভদ্রলোক,যার সাথে তোমার দেখা হয়েছিল ক্যাফে গিয়ার এ,তিন নং সারির 14D নং চেয়ারে ছিল আর পেমেন্ট করার সময় তার 5 ইউনিট কম পড়েছিলো”

ইরা আবছা স্মৃতি হাতড়ে সেই অর্ধপরিচিত ভদ্রলোকের মুখটা স্মৃতিতে ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা করে..ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে বলে,”তার কি হয়েছে?’

“তিনি মারা গিয়েছেন,আজ সকালে তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে,মেডিকেল টিম কিছু বলতে পারছে না”

‘হা ঈশ্বর!’বলতে গিয়ে থেমে যায় ইরা,স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে,ভয়ার্ত দৃষ্টি দরজার দিকে ,এইমাত্র যেন কোন EP এসে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়াবে আর পড়ে শোনাবে সেকশন 21 এর আওতায় আনা গ্রেপ্তারি পরওয়ানা।

“চিন্তা করার দরকার নেই,আমি সাউন্ড লাইনটা বাইপাশ করে দিয়েছি।“

Related Article:আইনস্টাইনের যে ১০ টি কান্ডকীর্তি তোমাকে হাসাবে!

ইরা আস্তে করে আবার জানালার কাছে সরে আসে,বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টির ফোটা শুরু হয়েছে।আর একটা লাইন করে সব পানি সরে যাচ্ছে।ইরা জানে,কেন কুশান উডল্যান্ড মারা গেলেন।অন্তত আজকের জন্য সে বিশ্বাস করে,

তিনি আত্মহত্যা করেছেন,নিসঙ্গতা কাটানোর জন্য এর থেকে ভালো আর কোন রাস্তা ছিলো না।যে কষ্ট তিনি কাউকে বলতে পারতেন না,মৃত্যুর মাধ্যমে সেটা শেষ হল…হয়তো।

বাইরে বৃষ্টি তীব্র হচ্ছে,কিন্তু মানুষের হাটা চলা আর কর্মব্যস্ততাকে আটকাতে পারছে না।ইরা আস্তে করে মাস্কটা পড়ে নেয়,তাকে কাজে যেতে হবে।

ইট কাঠের এই শহরটাতে এটা একটা সাধারন ঘটনা।

Exit mobile version