বিজ্ঞান ব্লগ

স্পেসস্টেশন এ নভোচারীরা কেন ভাসতে থাকে?

স্পেসস্টেশন এ নভোচারীরা মহাকাশে ভাসছে– এ এক পরিচিত দৃশ্য। বিভিন্ন ডকুমেন্টারিতে কিংবা মুভি-সিরিজে এই দৃশ্য আমরা প্রায়ই দেখি। একটু বৈজ্ঞানিকভাবে ভাবা যাক, নভোচারীরা কেন মহাকাশে ভাসে? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে মানুষের মাঝে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। সাধারণত এই প্রশ্নের জন্য এ জাতীয় কিছু উত্তর পাওয়া যায়ঃ 

১. স্পেস হচ্ছে একটা শুন্যস্থান। শুন্যস্থানে মহাকর্ষ তৈরি হতে পারে না। এজন্য নভোচারীরা ওজনহীন অনুভব করে।

২. স্পেস স্টেশন পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। তাই পৃথিবীর আকর্ষণ বল ওখানে কাজ করে না।

কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, উপরের সবগুলো উত্তরই ভুল! হ্যা, একদম ভুল! আপনিও যদি এই উত্তরে এতোকাল বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে এখন থেকে তা একদম ভুলে যান।

প্রথমে এই ভুল ধারণাগুলো ভাঙ্গা যাক। স্পেসে মহাকর্ষ নেই– কথাটা নিতান্ত হাস্যকর। পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের ঘূর্ণন, সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ, ধূমকেতুর ঘূর্ণন সবই মহাকর্ষের ফলে হচ্ছে। এতো মহাকর্ষ বলের ছড়াছড়ির পরও মহাকাশ শূন্যস্থান, তাই বলে মহাকর্ষ নেই – এই কথার কোনো ভিত্তি নেই।

স্পেসস্টেশন

 

এবার আসি দ্বিতীয় উত্তরে। স্পেসস্টেশন পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৭০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত। পৃথিবীপৃষ্ঠের তুলনায় ঐ উচ্চতায় অভিকর্ষ বলের মান প্রায় একই। g এর মান নির্ণয়ের সূত্র জানা থাকলে নিজেই বের করে দেখতে পারেন, ঐ উচ্চতায় g এর পরিবর্তন হয় খুবই সামান্য। পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে লাফ দিলে আপনি যে ত্বরণে মাটিতে ফিরে আসেন, ঐ স্পেস স্টেশন থেকে লাফ দিলেও আপনি একই ত্বরণে ফিরে আসবেন।

মিথবাস্টিং তো হলো, এবার প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন নভোচারীরা ওজনহীন অনুভব করে? এজন্য বুঝতে হবে আমরা কেন ওজন অনুভব করি। পৃথিবী সবসময় আমাদের তার কেন্দ্রের দিকে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু আমরা তো যাবো না। তাই আমরা ভূপৃষ্ঠের উপর বল প্রয়োগ করে দাঁড়িয়ে থাকি। আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে ভূপৃষ্ঠও আপনার দেহ বরাবর প্রতিক্রিয়া বল দেখায়। আমরা আসলে এই প্রতিক্রিয়া বলই অনুভব করি, এই প্রতিক্রিয়া বলই ওজন। তার মানে প্রতিক্রিয়া বল নেই মানে ওজন নেই। আর প্রতিক্রিয়া বলের উদ্ভব তো আমাদের প্রযুক্ত বল থেকেই! অর্থাৎ আমরা যদি কোনো বাধা ছাড়াই পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যেতে থাকি তাহলে আমরা ওজন অনুভব করবো না! ঠিক এই ব্যাপারটি ঘটে যখন কেউ উচু স্থান থেকে লাফ দেয়।

কোনো বাধা ছাড়াই সে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে ছুটতে থাকে, যদিও শেষপর্যন্ত ভূপৃষ্ঠে এসে থেমে যায়। প্যারাশুট জাম্পিং এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ (যদিও বাতাসের বাধা থাকে, তবুও বোঝার স্বার্থে তা ধর্তব্যের ভেতর আনছি না )। সকল মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুই একারণে ওজনহীন, কারণ তারা পৃথিবীর আকর্ষণের বিপরীতে কোনো বল প্রয়োগ করে না। বল প্রয়োগ করে না বলতে বোঝাচ্ছি যে তারা কোনো বাধার শিকার হয় না, কারণ বাধা আসা মাত্রই তো বল প্রয়োগ ঘটে।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! 

ডোরওয়ে ইফেক্টঃ দরজার সাথেই যখন স্মৃতির আয়ু !

ইনসাইড দ্য অ্যাপ্লিকেশন: মাই থেরাপি এর বিস্তারিত

ভালবাসার ব্যবচ্ছেদ: মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার হরমোন

তাহলে কি নভোচারীরা স্পেসস্টেশনসহ পৃথিবীর দিকে পড়ে যাচ্ছে? কিন্তু আমরা তো দেখি কী সুন্দর করে স্পেসস্টেশনগুলো ভেসে আছে। তাহলে এই ব্যাপারটা একটু ভালো করে বোঝা যাক।

ধরা যাক একটা বিশেষ ধরণের লং জাম্প প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। একটা উচু স্থান থেকে লাফ দিয়ে কে কতদূর সামনে যেতে পারে। একজনের পর একজন লাফ দিতে থাকে। কেউ হয়তো অনেক জোরে দৌড়ে এসে লাফ দেয়, ফলে সে অনেকখানি সামনে চলে যায়। লাফ দেওয়ার পর গতিপথটা কেমন হয়? একই সময়ে সে কিছুটা সামনে যেতে থাকে এবং কিছুটা নিচে নামতে থাকে। ফলে গতিপথটা হয় পরাবৃত্ত আকৃতির। এবারও কিন্তু ঐ মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর মতো ব্যাপার ঘটে, লাফ দেয়া ব্যাক্তি শূন্যে থাকা অবস্থায় ওজনহীন অনুভব করে! এই প্রক্রিয়া কাজে লাগানো হয় নাসার “Vomit Comet” — the KC 135 নামক বিমানেও, যেখানে বিমানটা অনেক গতি সহকারে পরাবৃত্তাকার পথে উপরে গিয়ে প্রায় মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর সমান ত্বরণে নামতে থাকে, ফলে ভেতরের সবাই ওজনহীন অনুভব করে! বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর জন্য বিমানটি ব্যবহার করা হয়।

আবার লং জাম্প খেলায় ফিরে আসি। এবার একটু আজগুবি কথাবার্তা বলবো। মনে করি এবার আপনি ৩৭০ কি.মি উচ্চতা থেকে প্রচন্ড বেগ নিয়ে এসে লাফ দিলেন। আপনি গণিত জানা মানুষ, প্রাসের হিসাব কষে আগে থেকেই বের করে রেখেছেন কতদূরে গিয়ে পড়বেন। কিন্তু লাফ দিয়ে নামার পর দেখলেন আপনার হিসাবের তুলনায় অনেকখানি বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছেন! কেন বলুন তো?

কারণ পৃথিবী গোলাকার! আপনি যেভাবে পরাবৃত্তাকার পথে নামছেন, আপনার নিচের ভূপৃষ্ঠও সেই সাথে বৃত্তাকার হয়ে সরে এসেছে। ফলে সমান যায়গায় আপনার যে সময়টুকু শূন্যে থাকার কথা ছিলো, পৃথিবী গোলাকার হওয়ায় আপনি আরো বেশি সময় শূন্যে থাকেন এবং বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেন। এবার আপনি যদি 28,160 km/h (17,500 mph) বেগে ৩৭০ কিমি উচ্চতা থেকে লাফ দেন, তাহলে একটা মজার ব্যাপার ঘটবে! আপনি পরাবৃত্তাকার গতিপথে ভূ-পৃষ্ঠের কাছে যেতে যেতে ভূ-পৃষ্ঠও ততটুকু বেঁকে যাবে! অর্থাৎ আপনি প্রতি মুহূর্তে মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর মতো নিচের দিকে পড়ছেন, কিন্তু ভূ-পৃষ্ঠ এর কাছে আসতে পারছেন না!

 

তখনই আসলে আপনি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকেন। স্পেসস্টেশন ও চাঁদ ঠিক একই কারণে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, পৃথিবীও ঠিক একই কারণে সূর্যের চারদিকে ঘোরে! সবাই পড়ন্ত বস্তু, কিন্তু কেউই পড়তে পারছে না। আর পড়ন্ত বস্তু মানেই তো ওজনহীন। স্পেসস্টেশনের ভেতরের সবকিছুই তাই ওজনহীন। কথা উঠতে পারে, চাঁদে তো মানুষের কিছুটা ওজন থাকে। তার কারণ হলো চাঁদের ঐ পরিমাণ মহাকর্ষ তৈরির জন্য পর্যাপ্ত ভর রয়েছে। কিন্তু সাপেক্ষ বিবেচনায় স্পেসস্টেশনের ভর তো নগন্য। তাই ওখানে সবকিছুই ওজনহীন।

Exit mobile version