‘হায়েনা’! নামটি শুনলে প্রথমেই মাথায় এই প্রাণীর একটি নিকৃষ্ট রূপ ভেসে উঠে। যুগের পর যুগ মানুষ প্রাণীটিকে যেমন নিকৃষ্টতম ভেবে এসেছে তেমনি করেছে অবহেলিত। প্রত্যেকটি প্রাণীর মধ্যেই নিজস্ব কিছু সহজাত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তন্মধ্যে হায়েনা এর ব্যতিক্রম কিছু নয়।
তবুও আমরা যেন প্রাণীটিকে সবক্ষেত্রেই অপকৃষ্ট ভেবে থাকি। হয়তো দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা গ্রীক পৌরাণিক মতানুসারে ও বিভিন্ন টেলিভিশন ‘শো’ গুলো এর জন্য দায়ী যা আমাদের চিন্তাভাবনায় হায়েনার অপকৃষ্ট রূপের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
হায়েনা ছাড়াও অনেক প্রাণী যেমনঃ বাঘ বা সিংহ রয়েছে যারা বেঁচে থাকার তাগিদে শিকার করে তবুও মানুষ হায়েনাকে হীন মনে করে। হতে পারে দেখতে বাঘ কিংবা সিংহের মতো সুদর্শন নয়। অধিকাংশ হায়েনার গায়ের লোম নোংরা থাকে যার ফলে প্রাণীটিকে দেখতে বিভৎসকর মনে হয়। কিন্তু হায়েনা সম্পর্কে কিছু মনো-মুগ্ধকর ও অজানা তথ্য রয়েছে যা সম্পর্কে আমরা অবগত নই। এর পিছনে কারন হলো হায়েনা সম্পর্কে আমাদের ভ্রান্ত ধারণা।
যাই হোক, প্রথমত আসি এর প্রজাতি নিয়ে। পৃথিবীতে মূলত চার প্রজাতির হায়েনা বিদ্যমান। যথাঃ- স্পটেড (Spotted), স্ট্রিপ্ড (Stripped), ব্রাউন (Brown), এবং আর্ডউল্ফ (Aardwolf)। এই চারটি প্রজাতির মধ্যে স্পটেড হায়েনা সবচেয়ে বেশি পরিচিত যার বৈজ্ঞানিক নাম Crotus crotus.
হায়েনার গড় আয়ুঃ হায়েনা গড়ে ২৫ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।
আগে পশ্চিমা ইউরোপে হায়েনা পাওয়া যেত। এছাড়া পূর্ব রাশিয়াতে এদের প্রজাতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে এদের কেবল আফ্রিকাতেই পাওয়া যায়।
তবে হায়েনা সম্পর্কে যে রহস্যময় তথ্য আছে তা হলো-
১. নারী হায়েনার একটি শিশ্ন (Penis) আছে
ভাবতেই খুব অবাক লাগছে! নারীদের আবার পুরুষ যৌনাঙ্গ কিভাবে থাকে? ব্যাপারটি অদ্ভুত হলেও সত্যি; নারীদের যৌনাঙ্গ পুরোপুরি পুরুষ যৌনাঙ্গের মতোই। Crocuta crocuta প্রজাতি তথা স্পটেড হায়েনাগুলোর ক্লাইটোরিস (Clitoris) ৮ ইঞ্চির মত লম্বা এবং এর গঠন আকৃতি পুরুষের মতোই হওয়ায় এটি ‘pseudo-penis’ নামে পরিচিত। এই ‘pseudo-penis’ ছাড়া স্ত্রীর বাহ্যিক কোনো যৌনাঙ্গ না থাকায় এদের এই একটি অঙ্গের মাধ্যমে মূত্রত্যাগ ও বাচ্চা প্রসব করতে হয়। বাচ্চা প্রসব খুবই কষ্টকর একটি প্রক্রিয়া যার ফলস্বরূপ শতকরা ১০ ভাগ মাতৃ হায়েনা বাচ্চা জন্মদানের সময় মারা যায়।
২. স্ত্রী প্রজাতির রাজত্ব
মানুষদের মতো প্রাণীদের গোত্র বা প্রজাতিতেও মাতৃতান্ত্রিকতা কিংবা পিতৃতান্ত্রিকতা রয়েছে; যা সম্পর্কে আমরা অনেকেই হয়তো জানতাম না। হায়েনাদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিকতা বিদ্যমান। মূলত পুরুষ হায়েনা থেক্ব স্ত্রী হায়েনা বেশি হিংস্র এবং শক্তিশালী হয়ে থাকে। এর কারন হলো স্ত্রী প্রজাতির দেহে তিনগুণ বেশি টেস্টোস্টেরন থাকে। এছাড়া, পুরষের থেকে স্ত্রী ১০ গুন বেশি ভারী হয়ে থাকে৷
৩. হায়েনার বিস্ময়কর অস্তিত্ব
হায়েনা একমাত্র প্রাণী যেটি দেখতে কুকুরের মতো কিন্তু এদের প্রজাতিগুলো আবার বিড়ালের সাথে সম্পর্কিত। এমনকি শক্তিমত্তার দিক দিয়ে এরা আবার বেজীর গোত্রের সাথেও সম্পর্কিত। যেহেতু এটি মাংসাশী প্রাণী এবং সর্বভুক তাই এরা মূলত ফেলিফর্মিয়া সাবগ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। ফেলিফর্মিয়া ( Feliformia) হলো বিড়ালের এক ধরনের শ্রেনী যারা সর্বভুক। তবে অনেকে হায়েনাকে কুকুরের সাথে তুলনা করে যা একটি ভুল ধারণা।
৪. একটি হায়েনাই যখন স্ত্রী এবং পুরুষ
স্ত্রী ও পুরুষ হায়েনা উভয়েরই লিঙ্গ দেখতে একই রকম হওয়ায় গ্রিক পুরাণমত অনুযায়ী বলা হতো যে এটি লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে। পুরুষের মতো স্ত্রী হায়েনাতেও টেস্টিস রয়েছে তাই পূর্বে সবাই এটিই বিশ্বাস করতেন যে হায়েনা লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এটি সম্ভব নয়। এটি কেবল একটি কাল্পনিক চিন্তাই বটে।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!!
নতুনদের জন্য পাইথন প্রোগ্রামিং – প্রথম প্রোগ্রাম |
৫. হায়েনা যখন হাসে
সবধরনের হায়েনা হাসে না; শুধুমাত্র স্পটেড প্রজাতি হেসে থাকে। কিন্তু তাদের হাসির আওয়াজ এতটাই বিকট যা শুনলে মনে হবে তারা একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত আছে কিংবা খাবার নিয়ে ঝগড়া করছে। এমনকি হাসতে হাসতে তারা শিকার করে এবং শিকারগুলোকে খুব নির্মমভাবে হত্যা করে।
৬. প্রাইমেট বর্গের প্রাণিদের মতোই হায়েনারা জটিল
বিভিন্ন কার্টুনে দেখা যায় হায়েনারা সামাজিকভাবে নির্বোধ এবং হিংস্র, তবে ব্যাপারটি এমন নয়। এই বিশ্বে হায়েনারা বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। হায়েনাদের উন্নত ফ্রন্টাল কর্টেক্স বিদ্যমান। যার ফলে এটি পূর্ব থেকেই বিভিন্ন ধরনের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে উঠতে পেরেছে যা একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। এমনকি এটি শিম্পাঞ্জির থেকেও বেশি বুদ্ধিমান। তাই এরা প্রাইমেট বর্গের প্রাণীদের মতোই জটিল প্রকৃতির।
৭. হায়েনা মূলত দক্ষ শিকারী
একটি আমেরিকান ড্রামা ‘The Lion King’ – এ হায়েনাকে বোকা প্রকৃতির প্রাণী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়; যা নিছক ভুল ধারণা। বাস্তবিকরূপে এটি সিংহের চেয়েও বেশি দক্ষ। হায়েনা সবসময়ই সুযোগসন্ধানী এবং তারা তাদের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে শতকরা ৯৫ ভাগ শিকারে সফল হয়েছে। তবে সুযোগ পেলেই এরা অন্যের খাবার চুরি করে। একটি কথা না বললেই নয়, সেটি হলো এদের সবসময়ই বিরোধ লেগে থাকে এবং শত্রুতাবশত কারনে হায়েনা যেমন সুযোগ পেলে সিংহের বাচ্চাকে মেরে ফেলে তেমনি সিংহও হায়েনার বাচ্চাকে শিকার করে। তাই একটি বাচ্চা হায়েনার জীবনে বেড়ে উঠা খুবই দুর্বিষহ।
অধিকন্তু সোমালিয়া তে হায়েনাকে খাদ্য ও বিভিন্ন ঔষধের জন্য ব্যবহার করা হয় । প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের সময়কাল থেকে এই প্রাণীটি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কারন তারা মনে করেন হায়েনার শরীরের বিভিন্ন অংশ অশুভ শক্তি ও রোগ প্রতিরোধে সক্ষম যা একটি ভুল ধারণাও বটে।