চলে এসেছে ১ম পর্ব এর পরে আপনাদের অতি প্রতীক্ষিত ২য় তথা শেষ পর্ব ।
১৮৯৩ তে এমি কচ এর সাথে বিচ্ছেদের পর একই বছরেই হেডউইগ ফ্রেইবার্গ এর সাথে দ্বিতীয় বারের মতো আবদ্ধ হন বিবাহ বন্ধনে।
অন্তহীন প্রয়োজনের আরেক নাম যেন মানুষ। মানুষের তার নিজের চাহিদা পূরণের জন্য কি না করে। তবে চাহিদা পূরণের জন্য কেউ ব্যবহার করে অর্থ আর কেউ করে মেধা। আর রবার্ট কচ তার জ্ঞান পিপাসা মেটানোর জন্য ব্যবহার করেছিলেন মেধার।
সাল ১৮৮০ , বিশ্বের জন্য সাধারণ একটি সাল হলেও চিকিৎসা ও বিজ্ঞান মহলের জন্য মোটেও সাধারণ সাল না। এমনকি স্বয়ং কচের জন্যও না। কারণ সালটি ছিল তার জীবনের মোড় পরিবর্তনের,পরিবর্তন চিকিৎসা শাস্ত্রের। তৎকালীন ইম্পেরিয়াল সরকারের অনুরোধে ও মন না টিকায় চলে আসেন বার্লিনে উপদেষ্টা হিসাবে ।
ক্ষুধা বড়ই ভয়ঙ্কর। একবার লাগলেই হল,মিটতে আর চায় না ।
রবার্ট কচ বার্লিনে এসে বসে পড়লেন তার অতৃপ্ত ক্ষুধা নিবারণে। ফের কাজ শুরু করলেন অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে আর এবারের উদ্দেশ্য ছিল অনুবীক্ষণের প্রথাগত পদ্ধতির আরো উন্নতি সাধন।
সেসময় পিওর কালচারে ক্লেবস ও লিস্টারের ‘তরল মিডিয়া‘ কৌশলটি ব্যবহৃত হত ব্যাকটেরিয়ার জীবনচক্রকে আরোও সুস্পষ্ট করে জানার জন্য। তবে কৌশলটি প্রায় অবিশ্বস্ত ও বেশ সময়সাপেক্ষ ছিল ।
“কিছু রাসায়নিক পদার্থ ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে সক্ষম আবার কিছু শুধু বাধা দিতে।” ১৮৮১ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে কচ পিওর কালচার সম্পর্কিত এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করেন যা পরবর্তীতে “বাইবেল অব ব্যাকটেরিওলোজি (Bible of Bacteriology)” হিসেবে পরিচিত পায় ।
দুজন সহকর্মীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে এই গবেষণায়। তাদের একজন হচ্ছেন ওয়াল্টার হেস্ এবং অপর জন জুলিয়াস পেট্রি। স্ত্রী ফ্যানি হেসে্র সহায়তায় ওয়াল্টার হেস্ সামুদ্রিক শৈবাল, সী উইড, থেকে উচ্চ গলনাঙ্ক বিশিষ্ট অ্যাগার পর্যবেক্ষন করতে সক্ষম হন যা কচের পিওর কালচার (pure culture) এ পরীক্ষামূলক ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টিদান করতে সক্ষম। অন্যদিকে আরেক সহকারী, জুলিয়াস পেট্রি , পিওর কালচারকে দূষণমুক্ত রাখতে, পেট্রি ডিশ নামক একটি বিশেষ ধরনের অগভীর ঢাকনাযুক্ত পাত্র তৈরি করেন যা গবেষণাগারে আজও বহুল ব্যবহৃত।
যেমন চোর চুরি করার সময় কোনো না কোনোভাবে এক-দুইটা প্রমাণ রেখে যায় আর তেমনি এত উন্নতি, এত সচেতন থাকা সত্ত্বেও মানুষ ধরা খায়।
বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার!তাই না?
শুধু নিজের আবিস্কৃত প্লেট প্রযুক্তি লুই পাস্তুর এবং জোসেফ লিস্টারকে দেখাতে চলে যান সুদূর লন্ডনে। উদ্দেশ্যও কিন্তু সফল হয়। বিজ্ঞান মহলে তার আবিষ্কার সক্ষম হয় জনপ্রিয়তা অর্জন করতে।
তবে ভাগ্যের কী পরিহাস। সহকারী ফ্রেডরিখ লফলার এবং ছাত্র জর্জ গ্যাফকি এর হাত দিয়ে গ্ল্যান্ডার্স,ডিপথেরিয়া আর টাইফয়েড জ্বরের মতো রোগের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া আবিস্কার করতে সম্ভব হলেও ধরা পড়েন যক্ষ্মার ক্ষেত্রে।
আজকের করোনার মতনই যক্ষ্মাও ছিল সেই সময়ের ভয়ানক রোগ, যেন যম-দূত। এই রোগ নিয়ে কাজ করার সময় ঘটে এক বিপত্তি। রোগের ধরন দেখে একে ছোঁয়াচে রোগ বলেলও কোনো জীবাণু পাওয়া যাচ্ছিল না এই ক্ষেত্রে। চিন্তায় পড়েন কচ।
তার আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক পদ্ধতিও যে কাজ দিচ্ছে না। শুরু করেন নতুন ভাবে।
পরিবর্তন আনেন রঞ্জন প্রক্রিয়ায়। শুরু করেন মেথিলিন ব্লু রঞ্জনের ব্যবহার।
ব্যবহারে জীবাণু কিছুটা স্পষ্ট হলে আশা জাগে মনে। যেখানে নতুন যথেষ্ট নয়, সেখানে পুরানোর দরকার হয়। কথার সত্যতা নিচে প্রমান সহ পাওয়া যায়।
কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন নতুন এর চেয়ে পুরাতন মেথিলিন ব্লু তে কাজ বেশি দিচ্ছে। কারণ বের করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন ক্ষারধর্মী মেথিলিন ব্লু চেয়ে নতুন মেথিলিন ব্লু কাজ কম করে। কচের মতে বেশি সময় ধরে বাইরে থাকায় বাতাসে উপস্থিত অ্যামোনিয়ার জন্য মেথিলিন ব্লু ক্ষারধর্মী হচ্ছে।
আর তাই ‘মেথিলিন ব্লু’ ক্ষারীয় ধর্ম পাবার জন্যে মিশিয়ে দিলেন পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড। ওনার ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়।
“ব্যাকটেরিয়া সদাই উপস্তিত ছিল, কিন্তু সঠিক রঞ্জনের কারণে তা অদৃশ্য ছিল।”
এবং তার সাথে তিনি এও বুঝতে পারেন পূর্বে উল্লেখিত রঞ্জন, ইওসিন, ফুচিন, স্যাফ্রানিন ও মিথাইল ভায়োলেট, শুধুই ভিত্তি মাত্র।
২৪ শে মার্চ, ১৮৮২। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক ঐতিহাসিক দিন। বার্লিন এর ফিজিওলজিক্যাল সোসাইটিতে, কচ যক্ষ্মা নিয়ে পুরো গবেষণা উপস্থাপন করেন এবং তা প্রায় দুই শতাধিক অণুবীক্ষণ স্লাইড প্রদর্শনের মাধ্যমে। সেই সভায় উপস্থিত পল এর্লিক, কচ এর কাজে বিমোহিত হয়ে,পরবর্তীতে রঞ্জন প্রক্রিয়ার সংস্কার করেন। এবং তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হান্স ক্রিশ্চিয়ান গ্রাম, ফ্রাঞ্জ ঝিল ও ফ্রেডরিখ নিয়েলসন এই তিনজন মিলে শুরু করেন রঞ্জন প্রক্রিয়ার সংস্কার। বলা বাহুল্য, বর্তমানে ‘গ্রাম স্টেইনিং’ ও ‘ঝিল-নিয়েলসন’ অণুজীব বিজ্ঞান এ সর্বাধিক ব্যবহৃত রঞ্জন।
অণুবীক্ষণে অসংখ্য জীবাণু পাওয়া কতো বড় সাফল্য রবার্টের জন্য তা যেমন ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না তেমনি যাবে না লিখায়। যখন আগের কোনো পদ্ধতি কোনো বড় কাজ দিছিলো না তখন তারই এই উদ্ভাবনটি সাফল্য আনে।
দোষী সাব্যস্ত করতে হলে তো প্রমাণ দিতে হয়। কিভাবে প্রমাণ করবে? প্রমানের জন্য পিওর কালচারে সদ্য জন্মানো জীবাণু প্রবেশ করান ২১৭ টি প্রাণি দেহে। জীবাণু প্রবেশ করানো প্রাণীগুলোতে যক্ষার লক্ষণ দেখা দেওয়া শুরু করে।
নদী বা সমুদ্রে থাকা নারিকেল দেখেছেন কোনোদিন? নারিকেল কূল পাওয়ার জন্য ব্যবহার করে ঢেউয়ের। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের সাফল্য আসে ধাক্কা খাওয়ার পর আর কচ ধাক্কা খাওয়া লোকের দলে। যক্ষা নিয়ে গবেষণাই ১৯০৫ সালে এনে দেয় সাফল্য নোবেল প্রাইজ রূপে।
দ্বন্দ্ব শুরু হয় । এক দিকে রবার্ট নিজে, আরেক দিকে পাস্তুরায়ন ও অ্যানথ্রাক্স, জলাতঙ্ক, কলেরার মত রোগের প্রতিষেধকের উৎপাদক লুই পাস্তুর। পেশাগত ভিন্নতাই ছিলো দ্বন্দ্বের কারণ। রবার্ট ছিলেন একজন চিকিৎসক আর লুই একজন রসায়নবিদ। রবার্ট চাইতেন রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে আর লুই চাইতেন প্রতিষেধকের মাধ্যমে। এখানে একটা আশ্চর্যের বিষয় হলো দ্বন্দ্বটি শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়েছিল দুটো দেশ, জার্মানি আর ফ্রান্স, এর মধ্যে।
এই ব্লগগুলি পড়তে ভুলবেন না !!
Joker কি শুধুই একটি কাল্পনিক চরিত্র? নাকি বাস্তবেও উপস্থিত ? সোনালী আঁশের গৌরব ফিরিয়ে দিতে মহানায়ক-একজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী |
আমরা তো ড. শম্ভুনাথ দে‘র সম্পর্কে জানি। জ্বি হ্যাঁ, কলেরা সংক্রমণ সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদানকারী। আচ্ছা, ১৯৫৯ সালে তথ্য প্রদানকারী ১৯১৫ তে জন্ম নেওয়া দে‘র কথায় উঠছে কেন? কারন কলেরা। ১৮৮৩ সালে ভারতবর্ষের মহামারি মিশরে ছড়িয়ে পড়লে উদ্বিগ্ন হয়ে জার্মান সরকার কচ’কে দ্বায়িত্ব দেন মিশরের সমস্যা সমাধানের জন্য। 4 জন সহযোগী নিয়ে মিশরের আলেকজান্ড্রায় যান সমাধানের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য সফল হলে দল নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়।
কলেরা, অন্যান্য জীবাণুর মত নয়। আর তাই তো কমা আকৃতির জীবাণুই যে কলেরার জন্য দায়ী তা জানা সত্ত্বেও তার প্রণয়ন করা নীতিমালা,
দায়ী জীবাণু অবশ্যই সেই নীতিমালা অর্থাৎ অন্য দেহে প্রবেশ করিয়ে সংক্রমিত করা, মানবে।
কিন্তু কলেরার ক্ষেত্রে সেই নীতি ছিল অপ্রযোজ্য। কেননা, কমা আকৃতির, কলেরা জীবাণু যে প্রবেশ করানো যাচ্ছিলো না অন্য দেহে। পরবর্তীতে আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে এসে রোগ ছড়ানোর মূলে আসতে সক্ষম হন।
৮ বছর পর ১৮৯২ জার্মানের হ্যামবার্গে কলেরা মহামারী রূপ ধারণ করলে প্রতিরোধব্যবস্থা স্থাপিত হয় কচের কলেরা গবেষণা উপর।
কলকাতা থেকে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত হওয়া রবার্ট কচ, বার্লিনে অধ্যাপক হিসেবে কাজ করার সময় আবারো মনোনিবেশ করেন যক্ষা এর উপর। আর এইবার প্রতিকারের জন্য। কখন কী, কীভাবে মোড় নেয় তা তো সকলের অজানা। এইবার যক্ষা নিয়ে গবেষনা করার সময় সুপ্তাবস্থায় যক্ষা নির্ণয়ের পদ্ধতি বের করেন যা আজও প্রচলিত ।
১৯০৪ এ স্বেছায় অবসর গ্রহন করে, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন গবেষণায়। নিয়োজিত হন “সংক্রমন ব্যাধি ইনস্টিটিউট” ( যা পরবর্তীতে কচ ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিতি লাভ করে) – এর প্রধান হিসেবে ।
সময় কখনো কারোর জন্য থামে না। যদি কোনো কিছু শুরু হয় তাহলে তার শেষ থাকবেই। ১৯১০ এর ২৭শে মার্চ তেমনি একটি দিন ছিল। মাত্র ৬৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে গমন করা রবার্ট কচ আজও আলোর পথের পথিকৃৎ হয়ে আছেন।
তথ্যসূত্র : রোর, আর্কি , সায়েন্স ডিরেক্ট