আজ থেকে প্রায় ২২৫০ বছর আগের কোনো এক দুপুর। প্রাচীন গ্রীসের সিসিলি রাজ্যের সিরাকাউস শহরে স্বাভাবিক নিয়মেই শুরু হয়েছিলো দিন। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ, ব্যবসা, সবই আর যেকোনো সাধারণ দিনের মতোই চলছিলো। হঠাৎ ঘটলো এমন একটি ঘটনা, যা হয়তো ওই দিনটিকে তাদের অনেকের জীবনেরই সবচেয়ে স্মরণীয় দিন করে রাখবে।
সেদিন পথচারীরা দেখলো যে একজন প্রায় উলঙ্গ বৃদ্ধ মানুষ ভেজা গায়ে গণস্নানাগার থেকে বেরিয়ে সোজা রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে ছুটছে আর চিৎকার করে বলছে, “ইউরেকা! ইউরেকা! আমি পেয়ে গেছি!”
আশা করি আমাকে আর কষ্ট করে বলতে হবে না আজকে কাকে নিয়ে কথা হবে। জ্বী বন্ধুরা, কথা হচ্ছে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় গণিতবিদ আর্কিমিডিসকে নিয়ে।
আর্কিমিডিস একাধারে ছিলেন গণিতবিদ, পদার্থবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং জ্যোতির্বিদ। আর্কিমিডিসের জন্ম ২৮৭ খ্রীস্টপূর্বে প্রাচীন গ্রীসের (বর্তমানে ইতালির অংশ) সিসিলি দ্বীপে সিরাকাউস রাজ্যে। তাঁর পিতা ফিডিয়াস নিজেও একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন।
যুবক বয়সে আর্কিমিডিস মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় জ্ঞানার্জন করেন। সেখানে ইউক্লিডের অনুসারীদের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিলো। পড়াশোনার জন্য ভিনদেশে গেলেও আর্কিমিডিসের জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে তাঁর নিজ শহর সিরাকাউসে।
আর্কিমিডিস ছিলেন তাঁঁর সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণিতবিদ। তাই তাঁর জীবনের বেশিরভাগ তথ্যই উঠে আসে সমসাময়িক অন্যান্য লেখকের বিবরণী থেকে। আর্কিমিডিসের নিজের লেখা খুব অল্প কিছু পুস্তকই টিকে থাকতে পেরেছে, তাই এসব লেখকদের রচনাই তাঁর সম্পর্কে জানার অন্যতম মাধ্যম।
আর্কিমিডিস বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিকের চেয়ে তাত্ত্বিক বিজ্ঞানেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত বিভিন্ন তত্ত্ব আজ পর্যন্ত বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজে লাগছে।
আর্কিমিডিস যোগজীকরণের একটি ধারা আবিষ্কার করেন, যার সাহায্যে কোনো বস্তুর ক্ষেত্রফল সহজেই পরিমাপ করা যায়। কালক্রমে এই আবিষ্কারই আরো পরিমার্জিত হতে হতে নিউটনের হাতে ক্যালকুলাসের সাথে যুক্ত হয়। এ পদ্ধতিটির নাম ছিলো Method of Exhaustion।
আর্কিমিডিস পাই (π) এর প্রায় সঠিক মান গণনা করেছিলেন। বর্গমূলের মান সঠিকভাবে গণনাতেও তাঁর অবদান আছে। পদার্থবিদ্যায় ঘনবস্তুর ভারকেন্দ্র (Centre of mass) নিয়েও তাঁর একটি মৌলিক আবিষ্কার রয়েছে। আবার তরলে নিমজ্জিত বস্তুর ওজনের বিষয়ে তাঁর আবিষ্কার ‘আর্কিমিডিসের নীতি’ নামেই বিজ্ঞানে অমর হয়ে আছে। গল্পের শুরুতে বলা কাহিনীটা কিন্তু এই আবিষ্কারের পেছনেরই গল্প!
তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের পক্ষপাতী হলেও আর্কিমিডিসের তৈরি কার্যকরী যন্ত্রপাতির সংখ্যা প্রচুর। তৎকালীন সিসিলির রাজা হিয়েরনের(II) এর সাথে আর্কিমিডিসের সখ্যতা ছিলো। রোমানদের সাথে সংঘটিত যুদ্ধে রাজার অনুরোধে তিনি এমন কিছু সমরাস্ত্র উদ্ভাবন করেন যা রোমানদের হতচকিত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য করে। আতশকাঁচ দিয়ে আগুন ধরানোর উপায়ও তিনি এসময় আবিষ্কার করেন।
তাঁর আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় আবিষ্কার হলো পুলি বা লিভার (Lever)। এর সাহায্য খুব সহজেই অল্প বল প্রয়োগে অনেক বেশি ভর সরানো যায়।এই লিভার নিয়েই তাঁর সেই জনপ্রিয় বচনটির জন্ম হয়,
“আমাকে একটি পর্যাপ্ত পরিমাণে লম্বা লাঠি এবং এটি রেখে দাঁড়ানোর একটু জায়গা দিলে আমি এর সাহায্যে পুরো পৃথিবীটা কেই নাড়িয়ে দেখাতে পারবো।”
এছাড়াও আর্কিমিডিসের আবিষ্কৃত আরও অনেক যন্ত্রপাতি অনেক সময় ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছ।
আর্কিমিডিস তাঁর গবেষণাসমূহ সেভাবে সংরক্ষণ করতেন না। তার মধ্যে বেশ কিছু আবার কালের গর্ভে হারিয়েও গেছে। আর্কিমিডিসের রচিত এমনই কিছু গ্রন্থ হলো On Plane Equilibriums (Two books), Quadrature of Parabola, On the Sphere and Cylinder (Two books), On Spirals, On Conoides and Sphenoids, On Floating Bodies (Two books), Mesurements of a Circle, The Sandreckoner।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!
মানুষ এবং অন্য প্রাণীর শুক্রাণু-ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়া সম্ভব? |
আর্কিমিডিস এর জীবনের বেশিরভাগ তথ্যই উঠে এসেছে তাঁর সমসাময়িক বিভিন্ন লেখকের বিবরণী থেকে। অনেকেই এই উৎসকে স্বীকৃত দিতে নারাজ। ফলে আর্কিমিডিসকে নিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন গল্প সত্যি নাও হতে পারে। এমনকি রাস্তা দিয়ে প্রায় উলঙ্গ হয়ে ‘ইউরেকা!’ চেঁচানোর ঘটনাও হতে পারে কাল্পনিক, তেমনই কাল্পনিক হতে পারে আতশকাঁচ দিয়ে শত্রু রোমানদের জাহাজের পালে আগুন লাগানো এর ঘটনাটিও।
তাই তাঁর মৃত্যুঘটিত ইতিহাসের সত্যতাও প্রমানিত নয়। জনপ্রিয় মতানুযায়ী, ২১২ খ্রীস্টপূর্বে রোমানদের সিসিলি জয়ের পরপরই রোমান সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করে। গল্প অনুযায়ী, জ্যামিতিক প্রমাণে মগ্ন আর্কিমিডিস তাঁর নিজ শহর, এমনকি নিজ ঘরেও শত্রুর আগমণের প্রতি তাঁর কোনো মনোযোগই দেননি। ফলে তাঁদের আদেশ অমান্য করায় ক্ষিপ্ত হয়ে রোমান সৈন্যরা তাঁকে হত্যা করে। রোমান সেনাপ্রধান মার্সেলাস এতে অনেক দুঃখ পান, কারণ আর্কিমিডিসের বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগের উপর তার গভীর শ্রদ্ধা ছিলো।