বিজ্ঞান ব্লগ

কোয়ান্টাম কম্পিউটার :ভবিষ্যত বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় বিস্ময়!(১)

এতদিন আমরা জানতাম কম্পিউটারই বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় বিস্ময়। কিন্তু এখন সেই ধারণা পাল্টে গেছে।কেননা, সাধারণ কম্পিউটারের জায়গায় এখন আসছে “কোয়ান্টাম কম্পিউটার”। এটা প্রমাণিত যে, যেধরণের হিসাব  করতে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির সুপারকম্পিউটারের ১০ হাজার বছর লেগে যাওয়ার কথা সেখানে একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার একই কাজ ২০০ সেকেন্ডেই করে ফেলতে পারে। তো চলুন আজকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রাথমিক পরিচয় পর্ব জেনে নিই।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার

১৯৯৪ সালের কথা। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তখনো খাতা-কলমের তাত্ত্বিকজগতের ঘেরাটোপে বন্দী। বিজ্ঞানীদের চিন্তায় দারুণ একটা  সম্ভাবনা হিসেবে উঁকি দিচ্ছে শুধু। এরকম সময়ে গণিতবিদ পিটার শোর ফ্যাক্টরিংয়ের উপর নির্ভর করে একটা অ্যালগরিদম আবিষ্কার করেন। একজন গণিতবিদ ফ্যাক্টরিং (উৎপাদক) নিয়ে কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শোরের অ্যালগরিদম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগৎকে কিছুদিনের মধ্যেই একদম নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রযুক্তিজগতের সবাই অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন, এই অ্যালগরিদম ব্যবহার করে পুরো ইন্টারনেট জগতকে মুঠোয় পুরে ফেলা সম্ভব! দুর্ভেদ্য কোনো কিছুর ভয়ংকর দুর্বলতাকে প্রকাশের জন্য ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে। অ্যাকিলিস হিল!

শোরের অ্যালগরিদম ইন্টারনেট জগতের জন্য অ্যাকিলিস হিল হয়ে এল। খুব দ্রুত কাজ করতে পারে এরকম কম্পিউটারে যদি এই অ্যালগরিদম রান করতে পারে, তাহলে ভেঙে ফেলা যাবে শক্তিশালী প্রায় সব এনক্রিপশন! খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলা যাবে মানুষের গোপনীয় সব তথ্য!শোরের কাছে এরকম কোনো যন্ত্র ছিল না। তিনি শুধু একটা হাইপোথেটিক্যাল যন্ত্রের জন্য একটা অ্যালগরিদম লিখেছিলেন। হাইপোথেটিক্যাল কথাটার বাংলা অর্থ প্রকল্প। আসলে এই শব্দের সঠিক অর্থ করলে দাঁড়ায় “সম্ভাবনাময় কল্পনা”। সম্ভাবনাময় কাল্পনিক যে যন্ত্রের জন্য শোর অ্যালগরিদম লিখেছিলেন তারই নাম কোয়ান্টাম কম্পিউটার! ১৯৯৪ সালের সেই পেপার, মানে গবেষণাপত্রে তিনি লিখেছিলেন, “কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করে কম্পিউটারের হিসাব-নিকাশের ক্ষমতা বাড়িয়ে ফেলা সম্ভব কি না, এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব কারো জানা নেই।” শোরের সেই প্রশ্নের জবাব এখন ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে।

গতবছর গুগলের জন মার্টিনিস ও সার্জিও বোইজো তাদের ব্লগে লিখেছেন,”আমাদের হিসাব অনুযায়ী যে হিসাব-নিকাশ করতে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগতির সুপার কম্পিউটারের ১০ হাজার বছর লেগে যাওয়ার কথা, আমাদের যন্ত্র সেটা ২০০ সেকেন্ডের মধ্যেই করে ফেলেছে!” এটা করা সম্ভব হয়েছে “কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি” র বাস্তব প্রয়োগের জন্য।

এদিকে বেশ কিছুদিন আগে (নভেম্বর ২০২০)প্যান জিয়ানোয়েই’র নেতৃত্বে চীনের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির(USTC) একদল বিজ্ঞানী তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটারে সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে ১০০ ট্রিলিয়ন গুণ দ্রুত একটি হিসাব সফলভাবে সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছেন।চীনের সংবাদ মাধ্যম সিনহুয়ার তথ্যমতে, এটি গুগলের কম্পিউটারের চেয়ে ১০ বিলিয়ন গুণ দ্রুত কাজ করতে পারে।তাদের গবেষণাপত্রটি সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

এই ব্লগ পড়তে ভুলবেন না ! 

বিজ্ঞানী ড. শুভ রায় : প্রতিস্থাপনযোগ্য কৃত্রিম কিডনির উদ্ভাবক

পানির অতল গভীরে চলন্ত জাহাজঃ সাবমেরিন

গবেষণাগারে করা এসব হিসাব-নিকাশ অবশ্য বাস্তবে কোনো কাজে লাগবে না। শোরের অ্যালগরিদম বাস্তবে প্রয়োগের মতো কোনো কম্পিউটার এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তবে গুগল, আইবিএম, এমাজনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্টার্টআপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা বাস্তবে কাজে লাগবে, এরকম কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদ্ভাবনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এসব কোম্পানি ও বিভিন্ন দেশের সরকার কোয়ান্টাম কম্পিউটার উদ্ভাবনের জন্য প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। জানা গেছে, চীন প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো বিনিয়োগ করে একটা সফল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গবেষণাগার বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও বিলিয়নখানেক ডলারের মতো বিনিয়োগ করেছে। আবার আইবিএম ও গুগলের মতো কোম্পানিগুলোর প্রতিটা ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করতেও ইতস্তত করছে না।কারণ, কোয়ান্টাম কম্পিউটার যে শুধু কম্পিউটার প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটকে বদলে দেবে তা-ই নয়, এটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স,মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিকেও এগিয়ে নেবে কয়েকগুণ!

আর যে মূহুর্তে কোয়ান্টাম কম্পিউটার বাস্তব হয়ে উঠবে সাথে সাথে ধসে পড়বে প্রচলিত সব এনক্রিপশন।আমাদের ই-মেইল থেকে শুরু করে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড— সবকিছুর পেছনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে যাবে আমাদের চোখের পলকে।

শোরের অ্যালগরিদম ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার হতে পারে প্রযুক্তির জন্য আশীর্বাদ ও সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের জ্বালানি। একই সাথে এটি হতে পারে তথ্য-নির্ভর আধুনিক জীবনযাত্রার জন্য ভয়ংকর এক হুমকি। কথা হলো, সম্ভাবনাময় এই কল্পনা বাস্তবতা হয়ে উঠার পথে কতদূর এগিয়েছে? 

 

[বিঃদ্রঃ এটা প্রথম পার্ট।এরপরে আরো বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে আপনাদের জন্য আসছে পার্ট ২ ও পার্ট ৩।তো একদম সম্পূর্ণ বিষয়টা জানার জন্য চোখ রাখুন ScienceBee এর ওয়েবসাইটে+গ্রুপে]

Exit mobile version