(লেখাটি বিজ্ঞানী জেমস লাভলক রচিত ‘Something nasty in the Greenhouse’ প্রবন্ধের অনুবাদ যা বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং উষ্ণায়নের ব্যাপারে আমাদের দ্বায়িত্ব নিয়ে আলোকপাত করে)
১৯৩০ সালের দিকে তরুণ সমাজের প্রায় সবাই জানতো যে একটা যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।কিন্তু এ ব্যাপারে কি করতে হবে সে সম্পর্কে কোন পরিষ্কার ধারণা ছিল না।অধিকাংশ তরুণ তখন বাম রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।তারা ভাবতো,যুদ্ধের চেয়ে খারাপ কিছুই নেই।
অনেকেই এই ভাবনাগুলো নিজেরদের ভেতর ভাগ নিতো,বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এর স্মৃতিতে কাতর বৃদ্ধ সৈন্যদের সাথে।একই সময় ডান পন্থীরা বলতে লাগলো হিটলার কোন সমস্যাই নয় কারন তার জাত শত্রু হল সোভিয়েত রাশিয়া। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই স্বপ্নগুলো বহাল থাকলো কিন্তু যুদ্ধটা সত্যি হয়ে উঠলো।
প্রায় ৬০ বছর আগের ঘটনার সাথে বর্তমানে সময়ের বৈশ্বিক উষ্ণতা বিষয়ে বেশ কিছু মিল খুজে পাওয়া যায়।আমরা অনেকেই ভাবি,খুব শীঘ্রই খারাপ কিছু ঘটবে কিন্ত সেই ১৯৩৮ সালের মত এ বিষয়ে আসলে কি করতে হবে সেই বিষয়ে বিভ্রান্ত।কিয়োটো সমঝোতা চুক্তি অনেকটা মিউনিখ চুক্তির মত যেখানে রাজনীতিবিদরা দেখাচ্ছেন যে তারাও সাড়া দিচ্ছেন কিন্তু বাস্তবে শুধু সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই হচ্ছে না।আমরা হলাম সামাজিক জীব এবং আমরা ততক্ষন পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হই না যতক্ষণ পর্যন্ত আসল বিপদ এসে হাজির হয়।
অবশ্য সেটা হয়নি এবং আমরা নিজেদের গায়া থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।কিন্তু ধরিত্রী বা গায়া (gaya) ইতোমধ্যেই তার মার্শাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহন করেছে এবং এটা জার্মানদের ঝটিকা আক্রমণের থেকে ভয়াবহ কিছু হবে।কারণ আমরা স্বয়ং ধরিত্রীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত এবং বলা যায় যে মানবজাতি সবচেয়ে বড় এক পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছে যা আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি।আমরা নিষ্ঠুর ভাবে পৃথিবীর ক্ষতি করছি,বৈশ্বিক উষ্ণতা এর উত্তর এবং আমাদের অবস্থা এখন যুদ্ধ পরবর্তী অবস্থার থেকেও খারাপ।
বিজ্ঞানীরা পৃথিবীকে আখ্যা দিয়েছেন একটি স্বচালিত সংস্থান হিসেবে যা মানুষসহ এর সকল জীবন্ত কাঠামো এবং অজৈব উপাদান সমন্বয়ে গঠিত।পৃথিবী নিজেই তার জলবায়ু এবং রসায়ন নিয়ন্ত্রণ করে,কারণ পৃথিবী একটি জীবন্ত কাঠামো,আর আমরা যা করি তার প্রতি পৃথিবী সংবেদনশীল।মঙ্গলের মত মৃত গ্রহে গ্রীণ হাউজ গ্যাস সংযোজনের পরিণতির থেকে এই পৃথিবীতে গ্রীণহাউস গ্যাস সংযোজনের পরিণতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
Gaia এর তত্ত্ব মতে,যে প্রজাতি বায়ুমন্ডল এবং ভূমির মধ্যকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য কে হুমকির মুখে ঠেলে সে প্রজাতি বংশ বিস্তারে পৃথিবী সাড়া দেয় না।এভাবেই পৃথিবী ক্ষতিকর প্রজাতি দমায়ে রাখে এবং সেই তত্ত্ব অনুসারে আমরাই এখন তার লক্ষ্যবস্তু।কিন্তু আমরা তো পরজীবী নই।আমরা পৃথিবী অংশ এবং প্রথম বুদ্ধিমান প্রাণী,আমাদের বিশেষ মূল্য আছে।কারন আমরাই পৃথিবীর দর্পন এবং এই দর্পন দিয়ে যখন তাকে দেখি,সে কী সুন্দর!
আমরা এখনো বৈশ্বিক উষ্ণতার গুরুত্ব বুঝিনি,যেমন আমরা বুঝিনি ১৯৩৮ সালে অসম্পুর্ন এবং ত্রুটিপুর্ন প্রস্তাবনাগুলো।এখনো কোথাও কোথাও বৈশ্বিক পরিবর্তনের অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করা হয় এবং একটি উষ্ণ একবিংশ শতাব্দী উপভোগের বাসনা পোষণ করা হয়।অবশ্য কেউ কেউ হুমকিটা যদিও বুঝতে পারে কিন্তু সাড়া দেয় অন্যভাবে যেমনঃ জৈব খাবার ছাড়া কিছুই গ্রহন করা যাবে না,নবায়নযোগ্য শক্তি ছাড়া কিছুই ব্যবহার করা যাবে না আর বিজ্ঞানসম্মত ঔষধ নয় বরং বিকল্প পথ অনুসরণ করতে হবে।
এখন আমরা যদি এই মতামতের যেকোন একটি সাড়া দেই,তাহলে gaya হয়তো নিজের স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ফিরে পাবে কিন্তু তা হবে হয়ত মানবজাতির বিরাট অংশ ধ্বংস করে।মাঝখানে একটা পথ আছে সেখানে আমরা বৈশ্বিক উষ্ণতাকে স্বীকার করি বটে,কিন্তু কিয়োটো চুক্তির মত আসলে কিছু প্রসাধনিক প্রলেপন ছাড়া কিছুই করছিনা।পরিণতিতে আমাদের কার্যকর কিছু করার গতি স্লথ হচ্ছে মাত্র।
আমাদের উপলব্ধি করতে হবে,ইতমধ্যেই আমরা পৃথিবীর এত ক্ষতি করে ফেলেছি যে,আমরা যদি এখনই জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করে দেই তাও আগামী প্রজন্মের কাছে একটা নিঃস্ব পৃথিবী ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারবো না।প্রতিদিন আমরা যেভাবে বায়ুদূষণ করে যাছি বা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রকে কৃষি জমিতে পরিণত করে যাচ্ছি তা আমাদের ঋণ পরিশোধকে আরো জটিল করে তুলেছে।
আবহাওয়াবিদ দের মতে আমরা দ্রুতই বায়মন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড এর বিপদসীমার মাত্রায় পৌচ্ছাচ্ছি যা ৪০০ থেকে ৫০০ ppm অতিরিক্ত হলে এমন অবস্থা হবে যে সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না।এই মূহুর্তে আমরা ৩৮০ppm এ আছি,অর্থাত কার্যকর কিছু করার জন্য আমাদের কাছে খুব অল্প সময় আছে।
আমাদের নিজেদের অস্তিত্ত্ব এর জন্যই আমাদের ধরিত্রীর সাথে একটা সমোঝোতায় আসা জরুরি এবং একই সাথে আমাদের উন্নত বিজ্ঞান এবন প্রযুক্তিকে আলিঙ্গন করতে হবে।এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতা এবং আবিষ্কারের ক্ষমতা পৃথিবীর উপর আমাদের প্রভাব লঘু করার জন্য প্রয়োজন।
১৯৪০ সালে আমেরিকার দ্বীপগুলিতে প্রায় আমরা অভুক্ত ছিলাম এবং আমাদের বিজয় হয়েছিল মাটি খোড়াখুড়ি করে নয় বরং সেইসব সূক্ষ ভাবে কাজ করা রাডারের সাহায্য যারা সাবমেরিন কে প্রতিহত করতে সাহায্য করেছিল।আমাদের এখন আবার সবচেয়ে দক্ষ প্রযুক্তির দরকার।
আমাদের ব্যবহার্য শক্তির উৎস সম্পর্কে একটি পোর্টফোলিও দরকার যেখানে পারমাণবিক শক্তি একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে।প্রাণ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কার্বন ডাইঅক্সাইড,পানি ,নাইট্রোজেন থেকে যদি বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় খাদ্য তৈরি করা যায়,চলুন তবে তাই করি এবং পৃথিবীকে একটু বিশ্রাম দেই।
বিকিরণ এবং রাসায়নিক উতপাদন থেকে ক্যান্সার হবার মিনিটভিত্তিক পরিসংখ্যান এর প্রতি অস্থির হওয়া অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমাদের ভেতর এক তৃতীয়াংশ কোন না কোন ভাবে ক্যান্সারে মারা যাবো কারণ আমারা যে বাতাস গ্রহণ করি তাতে রয়েছে অন্যতম ক্যান্সার উদ্দীপক,অক্সিজেন।যদি আমরা আসল বিপদ,অর্থাত বৈশ্বিক উষ্ণতা এর প্রভাব বুঝতে ব্যর্থ হই,তবে আমরা দ্রুত অস্ত্বিত্তহীন হয়ে পড়বো।
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রতিরোধে জীবাশ্ম জ্বলানি সংগ্রহ করা থেকে বিরত থাকা এবং কোথাও যেনো প্রাকৃতিক সংস্থান ধ্বংস না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।যদি চেষ্টা করা হয়,খাদ্য উতপাদনের জন্য প্রতি ইঞ্চি জমিকে চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসা তবে আমাদের অবস্থা হবে সেই সব নাবিকদের মত যারা জাহাজ চালাতে গিয়ে জাহাজের কাঠামো পুড়িয়ে ফেলেছিল।পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র শুধু চাষের জমির জন্যই নয়,এটি জলবায়ু এবং রসায়নকে চলমান এবং টেকসই রাখার কাজে নিয়োজিত থাকে।
আমাদের করা সকল ক্ষতির মাসুল দেবার দেবার জন্য আমাদের একটি পরিকল্পনা দরকার যার বিস্তৃতি এবং পরিসর মহাকাশ বা কোন সামরিক পরিকল্পনাকে হার মানাবে।আর শুধু টেকসই উন্নয়ন নয়,আমাদের দরকার সুপরিকল্পিত পশ্চাতপসরণ।আমাদের ভুল হওয়া অনিবার্য কারণ আমাদের পৃথিবী নিয়ে আমরা আশ্চর্যজনকভাবে অজ্ঞ।
নবায়নযোগ্য শক্তি শুনতে ভালো এবং এটাই আমাদের দরকার।কিন্তু কল্পনা করুন যখন কোটি কোটি বায়ুকল শক্তির প্রধান উতস হয়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তান্ডব চালাবে তখন এটা কি সম্পুর্ণ বড় কোন পরিণতি থেকে মুক্ত?
এগুলো পড়তে ভুলবেন না!
অর্কিড নিয়ে যত কথা এবং অন্যান্য আলোচনা |
প্রকৌশলগত দিক থেকে মানব সৃষ্ট যেকোন শক্তি উতপাদন কাঠামো এর ভেতর নিউক্লিয়ার শক্তি উতপাদন কাঠামো অনেক আস্থাভাজন।কিন্তু একে অবলীলায় প্রত্যাখান করা হয়েছে।ফ্রান্স দেখিয়ে দিয়েছে এটি একটি নিরাপদ শক্তির উৎস হতে পারে,তাও আমরা শক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে দ্বিধায় আছি এবং একই সাথে আমরা কিছু অযোগ্য কল্পনাবিলাসী লোকের কথা শুনছি যারা এ্যাপারটা ফুলিয়ে ফাপিয়ে ভয়ংকরভাবে দেখাচ্ছে।আমাদের নিরপেক্ষ হতে হবে এবং নিশ্চিত হতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে,সমস্যা সমাধানের সংবেদনশীল পথগুলো যেনো হুজুগেদের অকর্মণ্য হাতে না পড়ে।
আসলে ধ্বংস ছাড়া এই জীবাশ্ম জ্বলানি নির্ভর সভ্যতাকে একেবারে থামানোর উপায় নেই।এখন আশা ভরসা আমাদের সেই মহাশক্তির উপর যা আমাদের সমাজ বা দেশকে যেকোন হুমকি থেকে রক্ষা করে ।মহাকাশচারীরা পৃথিবীকে নিজেদের ঘর বলেন,কারণ তারা পৃথিবীর বাইরে গিয়েই তবে টানটা অনুভব করেন।
তবে আসুন,আমাদের ভিত্তিহীন ভয় এবং চিন্তাকে দূরে সরিয়ে এটা অনুধাবন করি যে,পরিবেশের প্রতি হুমকি আসে আমাদের অপকর্ম থেকে যা আমরা সবসময় করছি এই পৃথিবীর সাথে যার সাথে রয়েছ এক অবিছেদ্য সম্পর্ক।
(ঈষৎ সংক্ষিপ্ত)