১.
ছোটবেলার স্মৃতি রোমন্থন করতে কে না পছন্দ করে? আর সেই স্মৃতি যদি হয় আমাদের স্কুল সম্পর্কিত কিছু, তাহলে তো আর কথাই নেই! বন্ধুদের সাথে কাটানো সেই দিনগুলো, একসাথে বসে কতশত সমস্যা নিয়ে কথা বলা, নানান জিনিস একসাথে চিন্তা করা… ইশ! শুধু মনে হয়, পারতাম যদি আর একটাবার যদি ফিরে যেতে!
এই লেখার শুরুতেই আমরা ফিরে যাবো আমাদের সেই অতীতে, ডুব দেবো নবম-দশম শ্রেণীর গণিত বইয়ে।
সেখানে বিখ্যাত একটা সমস্যা ছিল এরকমঃ
১-১+১-১+১-১+১-১+… ধারাটির যোগফল বের কর।
দেখতে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ হলে এই সমস্যাটির মাঝে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর কিছু প্রশ্ন, জটিল কিছু ধাঁধাঁ আর গণিতবিদদের শতশত বছর ধরে চলা এক বিতর্ক। আজকে আমরা কথা বলবো এই বিখ্যাত সিরিজটা নিয়ে, গণিতে জগতে যেটা “গ্র্যান্ডির সিরিজ” নামে বেশি পরিচিত।
বেশ বড়সড় এই আর্টিকেলটার একদম শেষ দিকে পাঠকদের জন্যে একটা সমস্যা আছে, তাই যারা আর্টিকেলটা পড়া শুরু করেছো, তারা সাথে একগাদা বিস্কুট-মুড়ি আর পানি নিয়ে বসে পড়ো। মস্তিস্কের ধূসর কোষগুলো এখানে কাজে লাগাতে হবে যে!
…তাহলে আর দেরি কেন, শুরু করে দেই আমাদের জার্নি!
———————————————————————————————————————————–
২.
কঠিন আলোচনা যাওয়ার আগে শুরুতে কিছু বেসিক জিনিস নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রথমে যেটা আলোচনা করবো, সেটা হচ্ছে ধারা নিয়ে।
ধারা কি?
ধারা হচ্ছে অনুক্রমে পদ বা সংখ্যাগুলোর সমষ্টি। যেমনঃ
১+২+৩+৪+৫+…
২+৪+৮+১৬+৩২+…
এখানে কতগুলো পদ প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ক্রমানুসারে বসে একটি ধারা তৈরি করেছে।
ধারা মূলত দুই প্রকার।
- সমান্তর ধারা
- গুণোত্তর ধারা।
নাম শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কোন ধারা দিয়ে কি বোঝায়। সমান্তর ধারায় রাশি বা পদগুলো একটি নির্দিষ্ট অন্তর (difference) মেনে বাড়তে বা কমতে থাকে। আর গুণোত্তর ধারায় রাশিগুলো একটি নির্দিষ্ট অনুপাত (ratio) মেনে বাড়তে বা কমতে থাকে।
যেমনঃ
১+২+৩+৪+…
১০+৭+৪+১+…
প্রথম ধারাটায় প্রত্যেকটি পদ ১ করে করে বাড়ছে। আর দ্বিতীয় ধারাটায় প্রত্যেকটি পদ আগের চেয়ে ৩ করে কমছে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি পদের ডিফারেন্স একই। তাই এই ধারাগুলো সমান্তর ধারা।
আবার,
১+২+৪+৮+১৬+…
৩-৯+২৭-৮১+২৪৩…
প্রথম ধারায় প্রত্যেকটি পদ দুই গুণ করে করে বাড়ছে। আর দ্বিতীয় ধারায় প্রত্যেকটি পদ (-৩) গুণ করে বাড়ছে। তাই এই ধারাগুলো গুণোত্তর ধারা। আমাদের পরবর্তী আলোচনার জন্যে কিন্তু এই কনসেপ্টটা বোঝা ভীষণ জরুরী!
আমাদের আলোচনায় যে সমস্যাটা আছে, অর্থাৎ গ্র্যান্ডির সিরিজ, সেটা কি ধারা, বুঝতে পারছো কি?
১-১+১-১+১-১+১-১+…
ভালো করে খেয়াল করে দেখো, এখানে প্রত্যেকটি পদকে (-১) দিয়ে গুণ করলে পরের পদটি পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি রাশির মধ্যে সাধারণ অনুপাত (-১)। তাহলে নিশ্চিত ভাবেই বলা যাচ্ছে, গ্র্যান্ডির ধারাটি একটি গুণোত্তর ধারা! কি সহজ ব্যাপার, তাই না?
এগুলো পড়েছেন?
কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট-শুধুই কী সাইন্স ফিকশন থেকে উঠে আসে গল্প নাকি বাস্তবতা? মা দিবসের প্রবর্তক এ্যানা জারভিস-ই পরবর্তীতে মা দিবস বন্ধের জন্য লড়েছেন |
৩.
গুণোত্তর ধারার ক্ষেত্রে সমষ্টির সূত্র হলোঃ
S= a(1- r^n) / (1-r) ; r≠1
যেখানে, a = প্রথম পদ
r = সাধারণ অনুপাত
n = কতগুলো পদের সমষ্টি তুমি চাচ্ছো।
আমরা যে ধারাটি এতক্ষণ দেখছিলাম,
১-১+১-১+১-১+১-১+…
এই ধারার সমষ্টিটা একটু বের করা যাক, কি বলো?
যদি জোড় সংখ্যক পদ নিয়ে সমষ্টি বের করি?
ধরা যাক, আমরা জোড় সংখ্যক, অর্থাৎ প্রথম দশটা পদের সমষ্টি বের করবো। তাহলে,
a = ১
r = দ্বিতীয় পদ/প্রথম পদ = (-১)/১ = -১
n = ১০ (যেহেতু আমরা ১০টা পদের যোগফল বের করছি)
তাহলে, সমষ্টি, S = 1{1- (-1)^10} / {1- (-1)}
বা, S = (1*0)/2
বা, S = 0
তার মানে, যখন আমরা জোড় সংখ্যক পদের সমষ্টি বের করছি, তখন যোগফল হয়ে যাচ্ছে শূন্য! ব্যাপারটাকে চাইলে এভাবেও দেখা যায়ঃ
১-১+১-১+১-১+১-১+…
= (১-১)+(১-১)+(১-১)+…
= ০+০+০+০+…
= ০
এ তো গেল যদি আমরা জোড়সংখ্যক পদ নিয়ে চিন্তা করি। কিন্তু, যদি আমরা বিজোড় সংখ্যক পদ নিয়ে চিন্তা করি? তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে?
যদি বিজোড় সংখ্যক পদ নিয়ে সমষ্টি বের করি?
এবার আমরা বিজোড় সংখ্যক, ধরা যাক প্রথম এগারোটা পদের সমষ্টি বের করবো। তাহলে,
a = ১
r = দ্বিতীয় পদ/প্রথম পদ = (-১)/১ = -১
n = ১১ (যেহেতু আমরা ১১টা পদের যোগফল বের করছি)
তাহলে, সমষ্টি,
S = 1{1- (-1)^11} / {1- (-1)}
বা, S = (1*2)/2
বা, S = 1
তার মানে, যখন আমরা বিজোড় সংখ্যক পদের সমষ্টি বের করছি, তখন যোগফল হয়ে যাচ্ছে ১। ব্যাপারটাকে চাইলে এভাবেও দেখা যায়ঃ
১-১+১-১+১-১+১-১+১…
= ১+(-১+১)+(-১+১)+(-১+১)+…
= ১+০+০+০+০+…
= ১
এতদূর পর্যন্ত আমরা যা উপরে হিজিবিজি যা যা করেছি, তার সারমর্ম হলো, জোড় সংখ্যক পদ নিলে সমষ্টি আসছে ০, আর বিজোড় সংখ্যক পদ নিলে সমষ্টি আসছে ১। শুধু ব্র্যাকেটগুলো একটু উল্টোপাল্টা করে দিলেই হয়ে গেলো। কি দারুণ ব্যাপার, তাই না? এখন তো আমরা গান গাইতেই পারি, “ব্র্যাকেট তুমি খেল খেলাও ক্যানে!” হাহাহা!
দাঁড়াও! এক মিনিট!
এতদূর পর্যন্ত আমরা যা করেছি, সবই একদম শিশু লেভেলের। এখন আমরা যেটা করতে যাচ্ছি, সেটাই হচ্ছে আমাদের এই আলোচনার আসল রহস্য, সত্যিকারের ঝামেলা!
———————————————————————————————————————-
৪.
এই দুটো সমষ্টি (১ আর ০) ছাড়াও এই সিরিজের আরেকটা সমষ্টি আছে। আর, বিশ্বাস করো বা নাই করো, সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে উত্তর!
আগ্রহ হচ্ছে? চলো দেখে ফেলি কি নিয়ে আমাদের এত সমস্যা!
আমি আরেকবার আমাদের সেই ধারাটা লিখে ফেলছিঃ
১-১+১-১+১-১+১-১+…
ধরা যাক,
ধারাটির সমষ্টি, S = 1-1+1-1+1-1+1
এখন আমরা 1-S বের করার চেষ্টা করবো।
1-S = 1 – (1-1+1-1+1-1+1-1+…)
বা, 1-S = 1-1+1-1+1-1+1-1+1- … (জাস্ট ব্র্যাকেটগুলো উঠিয়ে দিয়েছি)
বা, 1-S = S (খেয়াল করে দেখো, ব্র্যাকেট উঠানোর পরেও কিন্তু আমরা আবার S ই পাচ্ছি!)
বা, 2S = 1
∴ S = 1/2
ও মা! কি থেকে কি হয়ে গেলো! এতক্ষণ আমরা বুঝেছিলাম যে সমষ্টি হয় ০ হবে অথবা ১ হবে, তাই বলে 1/2 ? এ কি মামা বাড়ির মোয়া নাকি! কি আজব ব্যাপারস্যাপার! কিভাবে সম্ভব এটা?
৫.
এই আইডিয়া যেই মানুষটি প্রথম সবার সামনে নিয়ে আসেন, তাঁর নাম ছিলো Guido Grandi (1671-1742). জাতে ইতালিয়ান এই ভদ্রলোকের গণিতের উপর ছিলো প্রবল আগ্রহ। সারাজীবন বিয়ে-থা করেন নি, সন্ন্যাসী হিসেবেই কেটে গেছে তাঁর জীবন। জীবনের বড় একটা সময় তিনি নীরবে-নিভৃতে গণিতের উপর গবেষণা করে গিয়েছেন। গোলাপের বক্রতার উপর তার গবেষণা ছিলো দেখার মত!
আমরা যে সিরিজটা নিয়ে আলোচনা করছি, গ্র্যান্ডি সেই সিরিজের তৃতীয় সমাধান, অর্থাৎ ১/২ নিয়ে আলোচনায় আসেন ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে।
তিনি যখন সমাধানটা নিয়ে সবার সামনে আসেন, তখন গণিতবিদরা সবাই হতভম্ব হয়ে যান। তারা বলাবলি করতে থাকেন, সিরিজের যোগফল ০ হতে পারে, ১-ও হতে পারে, কিন্তু ১/২ কিভাবে হয়?
জিনিসটা নিয়ে চলতে থাকে বছরের পর ধরে বিতর্ক। একদল বলে, ১/২ হতে পারে,আরেকদল বলে, না, কখনোই এটা সম্ভব না। একদল আরেকদলের সাথে গলার রগ ফুলিয়ে ঝগড়া করতে থাকে।
এগুলো কি এক-দুই বছরের ঝগড়া ছিলো? না রে ভাই, মোটেও না! এই ঝগড়ার স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় দেড়শ বছর! হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছ, প্রায় ১৫০ বছর! চিন্তা করে দেখো, একটা সাধারণ সমস্যা নিয়ে একদল লোক দেড়শ’ বছর ধরে তর্ক করছে। চিন্তা করেই তো আমার পেট ফেটে হাসি আসছে!
অবশেষে, উনিশ শতকের দিকে যখন অসীম ধারা নিয়ে গণিতশাস্ত্রের জ্ঞান মোটামুটি সমৃদ্ধ হয়, তখন এই বিতর্কের অবসান হয়। গণিতবিদরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নেন, ১ নয়, ০-ও নয়, ১/২ ই হচ্ছে সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত উত্তর। আর গ্র্যান্ডির প্রতি সম্মান জানিয়ে এই বিখ্যাত সিরিজটির নাম দেয়া হয় “গ্র্যান্ডির সিরিজ”।
৬.
কেন ১/২ হচ্ছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর?
এটার উত্তর দিতে হলে আমাদের উচিত অন্য আরেকটা অসীম গুণোত্তর ধারা নিয়ে গবেষণা করা (গুণোত্তর ধারা কি, এতক্ষণে বুঝে গিয়েছো নিশ্চয়ই?)। চলো, আমরা সবচেয়ে কমন আর প্রচলিত একটা ধারা নিয়ে গবেষণা করি।
১+ ১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ১/১৬ + ১/৩২ + …
সূত্র দিয়ে তুমি এই ধারাটির যোগফল কি বের করতে পারবে? যদি না পারো, তবে একটু কষ্ট করে উপরে স্ক্রল করো। ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে যাও। সূত্র তো দেয়াই আছে, বাকিটা কি আমাকে আর বলে দেওয়া লাগবে?
তবে আমি, হ্যাঁ, আমি- সূত্র দিয়ে করবো না। সূত্র তো আমরা শিখে ফেলেছিই! আমি চেষ্টা করব অন্য আরেকভাবে করতে।
কি, ভয় পাচ্ছো?
ভয় পেয়ো না। নতুন কিছু শিখতে তো দোষ নেই, তাই না? সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়!
যাই হোক, দুটো পদ্ধতি নিয়ে কথা বলা যাক।
প্রথম পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতিতে আমরা টার্ম বাই টার্ম পদগুলো যোগ করে দেখবো।
আরেকটু খোলাসা করে জিনিসটা বলা যাক।
শুধুমাত্র প্রথম পদের যোগফল = ১
প্রথম দুটো পদের যোগফল = ১ + ১/২ = ১.৫
প্রথম তিনটে পদের যোগফল = ১ + ১/২ + ১/৪ = ১.৭৫
প্রথম চারটে পদের যোগফল = ১ + ১/২ + ১/৪ + ১/৮ = ১.৮৭৫
প্রথম পাঁচটি পদের যোগফল = ১ + ১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ১/১৬ = ১.৯৬৮৭৫
উপরের যোগফলগুলোর দিকে ভালো করে তাকাও। কোনো সিকুয়েন্স দেখতে পাচ্ছো কি?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। আমরা যতই বেশি সংখ্যক পদ নিয়ে যোগ করছি ততই ‘২’ এর কাছাকাছি অগ্রসর হচ্ছি। মানে হচ্ছে, আমরা যদি একটা, দুইটা বা তিনটে নয়, বরং অনেক-অনেকগুলো পদ নিয়ে যোগ করি তাহলে একসময় আমরা যোগফল বা সমষ্টি হিসেবে ‘২’ পাবোই!
এবার এই একই পদ্ধতি আমরা গ্র্যান্ডির সিরিজে প্রয়োগ করি। চলো, দেখি, গ্র্যান্ডির সিরিজের যোগফল এরকম কোনো ‘সংখ্যার’ কাছাকাছি অগ্রসর হচ্ছে কি না।
গ্র্যান্ডির সিরিজটা হচ্ছেঃ ১-১+১-১+১-১+১-১+…
শুধুমাত্র প্রথম পদের যোগফল = ১
প্রথম দুটো পদের যোগফল = ১ -১ = ০
প্রথম তিনটে পদের যোগফল = ১-১+১ = ১
প্রথম চারটে পদের যোগফল = ১-১+১-১ = ০
…এভাবে চলতে থাকবে।
সমস্যাটা কি, আমরা কি বুঝতে পারছি?
আমরা কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যার দিকে আগাচ্ছি না। একই বৃত্তে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছি। তাই এই প্রথম পদ্ধতিটা গ্র্যান্ডির সিরিজের জন্যে খুব একটা ভালো পদ্ধতি না। আমাদের দরকার আরো ভালো কোনো পদ্ধতি, যেটা নিয়ে অন্ততঃ কাজ চালানো যাবে। মুরগী দিয়ে তো আর হালচাষ করা যাবে না, তাই না? হালচাষ করার জন্যে গরু না হোক, অন্তত একটা ঘোড়া আমরা জোগাড় করার চেষ্টা করি!
দ্বিতীয় পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতিতে আমরা যে কনসেপ্টটা ব্যবহার করবো, সেটা হচ্ছে এভারেজের (গড়) ধারণা। গড় কি জিনিস, তোমরা জানো নিশ্চয়ই? ১,৫,৮ এই তিনটি সংখ্যার গড় হচ্ছে , (১+৫+৮)/৩ = ৪.৬৭।
অর্থাৎ, গড় = (সবগুলো পদের যোগফল)/ পদসংখ্যা।
গড় বা এভারেজও কিন্তু যোগফল নির্ণয়ের খুব ভালো একটা পদ্ধতি।
কি, চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে? চলো তবে, দেখা যাক ব্যাপারটা আসলে কি। তবে এই পদ্ধতিতে আমাদের দরকার হবে প্রথম পদ্ধতিতে বের করা সেই যোগফলগুলো।
শুরু করবো আমাদের সেই ‘কমন’ সিরিজটা দিয়ে।
১+ ১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ১/১৬ + ১/৩২ + …
প্রথম পদের যোগফল ছিল = ১।
প্রথম দুটো পদের যোগফল ছিল ১.৫ (প্রথম পদ্ধতিতে দেখো)
তাহলে, দুটো যোগফলের গড় দাঁড়াচ্ছে = (১+১.৫)/২ = ১.২৫
এরকম ভাবে,
প্রথম তিনটে যোগফলের গড় = (১+১.৫+১.৭৫)/৩ = ১.৪২
প্রথম চারটা যোগফলের গড় = (১ + ১.৫ + ১.৭৫ + ১.৮৭৫)/৪ = ১.৫৩
আবার খেয়াল করো, আমরা যতই বেশি করে পদ নিচ্ছি, যোগফলের গড় ততই ‘২’ এর কাছাকাছি অগ্রসর হচ্ছে। ঠিক আমরা প্রথম পদ্ধতিতে যেমনটি দেখেছিলাম! তার মানে হচ্ছে, এখান থেকেও আমরা ধারণা নিতে পারি যে, এই ‘কমন’ সিরিজটির যোগফল ২ এর কাছাকাছি যেতে যেতে একসময় সত্যি সত্যিই ২ হয়ে যাবে! বুঝতে পারছো কি, কোনো সিরিজের সমষ্টি বের করতে যে এই ‘গড়’ পদ্ধতিটা আসলেই বেশ কাজের?
অর্থাৎ, প্রথম পদ্ধতি হোক বা দ্বিতীয় পদ্ধতি, আমরা এতটুকু অন্তত বুঝতে পারছি যে এই ‘কমন’ সিরিজটির সবগুলো পদের যোগফল একসময় ২ হবেই।
এবার আমরা এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটা এপ্লাই করবো গ্র্যান্ডির সিরিজে।
মনে আছে কি, আমাদের প্রথম পদ্ধতিটা ‘কমন’ সিরিজটায় কাজে লাগলেও গ্র্যান্ডির সিরিজে যে কাজ করেনি? দ্বিতীয় পদ্ধতিটা কি কাজ করবে? আমার তো ভীষণ ভয় হচ্ছে!
চলো, দুরুদুরু বুকে যাত্রা শুরু করি। “দুর্গম গিরি কান্তার মরু”… হেহেহে!
আমাদের কাজ কিন্তু খুবই সোজা। প্রথম পদ্ধতি থেকে যোগফলগুলো নিয়ে শুধু গড় করবো। আর কিছু নয়। তাও আমি তোমাদের জন্যে যোগফলগুলো ছোট্ট করে লিখে দিচ্ছিঃ
(প্রথম পদ্ধতি থেকে যা পেয়েছিলাম),
শুধুমাত্র প্রথম পদের যোগফল = ১
প্রথম দুটো পদের যোগফল = ০
প্রথম তিনটে পদের যোগফল = ১
প্রথম চারটে পদের যোগফল = ০
এবার শুরু করি আমাদের ‘গড়’ পদ্ধতি।
শুধুমাত্র প্রথম পদের গড় = ১
প্রথম দুটো যোগফলের গড় = (১+০)/২ = ০.৫
প্রথম তিনটে যোগফলের গড় = (১+০+১)/৩ = ০.৬৬
প্রথম চারটে যোগফলের গড় = (১+০+১+০)/৪ = ০.৫
প্রথম পাঁচটি যোগফলের গড় = (১+০+১+০+১)/৫ = ০.৬
এখানেও একটু খেয়াল করে দেখো, গড় ক্রমাগত কমছে। কমতে কমতে কিসের কাছাকাছি অগ্রসর হচ্ছে, বুঝতে পারছো?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। ০.৫ অর্থাৎ এর কাছাকাছি যাচ্ছে। ঠিক যেটা নিয়ে আমরা সন্দেহ করেছিলাম! তার মানে আসলেই এই সিরিজটার যোগফল ০.৫ বা ১/২।
এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটা নিয়ে অল্প কিছু কথা বলা দরকার।
এই পদ্ধতিটা হচ্ছে অনেকটা লিমিটের মত (যারা লিমিট কি জানো না, তারা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ম্যাথ বইটা ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখতে পারো)। কিন্তু এটা সত্যি সত্যি লিমিট না। মিথ্যামিথ্যি লিমিট বলতে পারো!
লিমিটের সাথে এই পদ্ধতির পার্থক্য হচ্ছে, লিমিট তোমাকে একটা বিন্দুতে ফাংশনের মান বের করে দেবে, যোগফল না। কিন্তু এই ‘গড়’ পদ্ধতিতে আমরা সিরিজের যোগফল বের করে ফেলছি, অনেকটা লিমিটের মতই চেহারা ধরে। অনেকটা কাক-কোকিলের মত সম্পর্ক, নিজের তো বাসা নেই, তাই আরেক বাসায় ডিম পাড়ছে!
গণিতের ভাষায় এই ধরণের জিনিসকে বলা হয় ‘Fake Limit’ বা ‘Pseudo Limit’ । লিমিটের মত সব বৈশিষ্ট্যই এতে আছে, এই দুষ্টু জিনিসটা কাজও করে লিমিটের মতই, কিন্তু এটা আসলে লিমিট না। কি মজার ব্যাপার তাই না?
এইজন্যেই ম্যাথমেটিশিয়ানরা ঠিক এই জায়গাতে এসেই এই রহস্যময় “গ্র্যান্ডির সিরিজ”-টির ব্যাপারে একমত হয়ে যান। তাই মোটামুটি বেশিরভাগ গণিতবিদই এই সিরিজের সবচেয়ে ভালো উত্তর হিসেবে ১/২-ই ধরে নেন, ১ বা ০-কে নয়।
—————————————————————————————————————————————————–
এগুলো পড়েছেন?
কোয়ারেন্টাইনে স্যার আইজ্যাক নিউটনের যতো আবিষ্কার |
৭.
আমরা আমাদের এই আলোচনার একদম শেষদিকে চলে এসেছি।
একদম শুরুতেই বলেছিলাম, এই লেখাটার শেষে আমি কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। এখন সেই প্রশ্নের পালা। তার আগে শেষবারের মত ছোটখাটো কিছু জিনিস বলি।
এই যে আমরা এতক্ষণ ধরে এই ‘সিরিজের আলাপ’ করলাম, এই সিরিজ আর সিরিজের সমষ্টিগুলো দিয়ে বোঝায় কি? মাহাত্ম্য কি এইসব সিরিজের? বাস্তব জীবনে-ই বা কিভাবে প্রয়োগ হয় এইসব সিরিজের?
চিন্তা করো, তুমি একটা বদ্ধ ঘরে বসে আছো। তোমার সামনে একটা লাইট। তুমি যেটা করবে, সেটা হচ্ছে, এই সুইচটা ক্রমাগত on আর off করবে। একবার on, একবার off। কি, রাজি আছো তো?
এবার তুমি “গ্র্যান্ডির সিরিজ” এর কথা ভাবো। সিরিজটা যেন কি ছিলো?
১-১+১-১+১-১+…
যখন তুমি (+১) দেখবে, তখন লাইটটা on করবে। আর যখন (-১) দেখবে, তখন লাইটটা off করবে। মানে হচ্ছে, একবার on, একবার off, একবার on, একবার off… করতেই থাকবে করতেই থাকবে। খুব একঘেঁয়ে কাজ, তাই না?
এ তো গেলো তোমার কাজ।
কিন্তু লাইটটা কখন on থাকবে, আর কখন off থাকবে, এটা কিন্তু সেই ‘প্রথম পদ্ধতির’ যোগফল দিয়ে বলে ফেলা যায়।
যখন যোগফল ১, তখন লাইট on.
যখন যোগফল ০, তখন লাইট off.
অনেকটা লজিক গেইটের মত।
এতটুকু বুঝেছ তো? চলো এবার আমাদের এক্সপেরিমেন্ট শুরু করা যাক।
আমাদের সেই ‘কমন’ সিরিজটার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই?
১+ ১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ১/১৬ + ১/৩২ + …
প্রথম মিনিট পরে তুমি লাইট on করলে।
½ মিনিট পরে তুমি লাইট off করলে।
¼ মিনিট পরে তুমি লাইট on করলে।
1/8 মিনিট পরে তুমি লাইট off করলে।
সিরিজের পদগুলো দিয়ে তুমি কত মিনিট পরপর লাইট on/off করবে, সেটা বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ, তুমি একই কাজ প্রতিবার আগের চেয়ে দ্রুত সময়ে করছো, করছো তো করছোই… করছো তো করছোই… উফফ! কি বিরক্তিকর কাজ রে বাবা! খেয়েদেয়ে কি আর কাজ নেই নাকি, আমি একই কাজ অসীম সংখ্যকবার করে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই!
এই যে এই হ্যাঁপা তুমি এতক্ষণ সময় ধরে সামলাচ্ছো, টোটাল সময় কতটুকু লেগেছে, বলতে পারবে কি?
যারা এই অব্দি এই দীর্ঘ লেখাটা মনযোগ দিয়ে পড়ে এসেছো, তারা চট করেই জিনিসটা ধরে ফেলতে পেরেছো, আমি জানি।
মোট সময় = ১+ ১/২ + ১/৪ + ১/৮ + ১/১৬ + ১/৩২ + …
= ২ মিনিট।
ঝামেলাটা কি বুঝতে পারছো? তুমি একই কাজ অসীম সংখ্যকবার করে যাচ্ছো, সেই হিসেবে তোমার সময়ও হওয়ার কথা অসীম, কিন্তু এই অসীম কাজের জন্যে মোট সময় তুমি পাচ্ছো মাত্র ২ মিনিট!
এবার হচ্ছে আমার সেই প্রশ্নটা।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই দুই মিনিট পরে লাইটের শেষ অবস্থা কি হবে? লাইটটা কি on থাকবে, নাকি off থাকবে?
মাথা ঘুরাচ্ছে?
আরেকটা প্রশ্ন করি।
গ্র্যান্ডির সিরিজে আমরা তিন ধরণের যোগফল পেয়েছিলাম। ১, ০ এবং ১/২।
১ মানে লাইট on.
০ মানে লাইট off.
১/২ মানে কি? অর্ধেক on, অর্ধেক off? তা কি করে হয়? নাকি একই সময়ে on–off?
…কি মনে হয় তোমার?
…বলো দেখি!
___________________________________