বিজ্ঞান ব্লগ

বয়সের তুলনায় কিছু মানুষকে অল্পবয়স্ক দেখায়, কিন্তু কেন!

পূর্ণিমা, জয়া আহসানকে দেখলে সবার মাথায় একটাই বিষয় ঘুরে, আরে এরা বুড়ো হয় না কেন? আবার কিছুদিন আগে প্রভাসের একটা ছবি ভাইরাল হয়, যেখানে তাকে তার বয়সের চেয়েও বেশি বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। তাহলে অনেকের বয়সের তুলনায় অল্পবয়স্ক দেখায় কেন? এতো ভিন্নতা কেন?

অনেকে হয়তো বলবেন, এর পিছনে এদের লাইফস্টাইলই দায়ী। হ্যাঁ, এটার সাথে আমিও একমত। কিন্তু আমার পাশের বাসার এক আন্টি আছেন, যার এখন চার বাচ্চা, এক মেয়ের আবার বিয়েও দিলো। আন্টিকে দেখে মনে হয় বয়স এই তো ২৫ ই হবে। তিনি তো তার লাইফস্টাইল নিয়ে এতো সচেতন না, তাহলে ওনাকে অল্পবয়স্ক দেখায় কেন!

জানি, এখন অনেকে হয়তো বলবেন, এতো কথা বলে আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছে! আচ্ছা কথা না বাড়িয়ে লিখা শুরু করি। আজকে আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। এই বয়স্ক, অল্পবয়স্ক বিষয়ে কথা বললে প্রথম যে বিষয়টা আসে তা হলো বার্ধক্য যা একটি জৈবিক প্রক্রিয়া এবং এটি জীবিত যেকোন কিছুর সাথে যেমন ফল, ফুল, প্রাণী বা ব্যক্তির সাথেই ঘটতে পারে।

যদি ফুল,ফলের কথা চিন্তা করি, তাদেরও বয়স হলে অবয়বে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়। যেমন- ফল পচে যায়, ফুল শুকিয়ে যায়। এই হিসেবে বয়স হলে সবাইকে বয়স্ক দেখানোর কথা, কিন্তু কিছু মানুষকে অল্প বয়স্ক দেখানোর কারণ কি? কারণটা হল তাদের কালানুক্রমিক বয়সের (chronological age) তুলনায় তাদের জৈবিক বয়সের (biological age)পার্থক্য। এখন আসি এই দুই ধরনের বয়স সম্পর্কে।

কালানুক্রমিক বয়স হল আপনার জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত বছরের সংখ্যা। মানে কেউ বয়স জানতে চাইলে আমরা যে সংখ্যাটা বলি। আর জৈবিক বয়স, যাকে শারীরবৃত্তীয় বয়সও বলা হয়, যেটাতে খাদ্য, ব্যায়াম এবং ঘুমের অভ্যাস সহ জীবনযাত্রার অনেক বিষয় বিবেচনা করা হয়। তাহলে কি আমরা এসবের মাধ্যমে আমাদের বয়স নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি?

উত্তর হলো হ্যাঁ পারি। যদিও এতে প্রাথমিকভাবে জেনেটিক্স, বায়ু দূষণ, সময়ের ভূমিকা রয়েছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেমন গোলাকার আকৃতির মুখের অধিকারীরা বয়সের তুলনায় অল্প বয়স্ক দেখায়। কিন্তু এমন অনেক বিষয় আছে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এবং তা বয়স জৈবিক বয়স নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। জৈবিক বার্ধক্যকে প্রভাবিত করে এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ নিয়ে আলোচনা করছি…

১. ব্যায়াম:
ফিটনেস বার্ধক্যজনিত প্রভাবগুলি রোধে একটি প্রধান মাধ্যম। পাশাপাশি ব্যায়াম থেকে আপনি অনেক উপকার পেতে পারেন। যেমন এটি ভাল সঞ্চালনে সাহায্য করে, হজমশক্তি বাড়ায়, হৃদযন্ত্রকে শক্তিশালী করে, শরীরের টক্সিন নিঃসরণে সাহায্য করে এবং অন্যান্য ভাল উপকারিতা যা শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে আর এসব বার্ধক্য এবং রোগের সাথে ইতিবাচকভাবে সম্পর্কিত।
আপনি যদি নিষ্ক্রিয় থাকেন, তাহলে আপনার শরীরে বিষাক্ত পদার্থ এবং প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়ার উন্নতি ঘটবে, যা স্বয়ং-প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং অন্যান্য রোগ সৃষ্টির মতো নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণা বলে, সপ্তাহে কমপক্ষে ৩-৪বার ৩০ মিনিট ধরে ব্যায়াম করলে আপনার শরীর ফিট থাকবে।

আরও পড়ুনঃ আমরা কেন বুড়ো হই? চিরজীবন তরুণ থাকতে পারিনা? 

২. ধূমপানঃ
আপনার শরীরের সর্বোচ্চ ক্ষতি করতে পারেন এই সিগারেট খেয়ে। ধূমপান ত্বকের স্বাভাবিক বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে। সিগারেটে কার্বন মনোক্সাইড এবং ৪০০ কার্সিনোজেন ( যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে) রয়েছে। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি মতে,৩০% ধুমপায়ী সব ধরনের ক্যান্সারে এবং ৮৭% ফুসফুসের ক্যান্সার মৃত্যুবরণ করে।

ধূমপানের নেতিবাচক প্রভাব অনেক। একটি হল ত্বক কুঁচকে যাওয়া এবং বয়সের ছাপ পড়া। এর কারণ নিকোটিন সেবনের কারণে রক্তনালী সংকুচিত হয়ে ত্বকে রক্ত ​​প্রবাহ কমে যাওয়া। ধূমপানের আরেকটি খারাপ প্রভাব হল এটি হাড়ের অক্সিজেন হ্রাস করে, যা অস্টিওপরোসিস (ভঙ্গুর হাড়) সৃষ্টিতে সাহায্য করতে পারে।

এছাড়াও ধূমপান চুল পড়া, সোরিয়াসিস, ছানি, দাঁতের সমস্যা, চামড়া ঝুলে যাওয়া, হাঁপানি, সিওপিডি এবং অন্যান্য অবস্থার কারণ হতে পারে। সিগারেট ধূমপান শরীরের অঙ্গ, বিশেষ করে ফুসফুস এবং হার্টের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং ধমনী সংকুচিত হওয়ার কারণে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে ।

উপরের সব সমস্যা আপনার জৈবিক বয়সকে বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক। ফলে আপনাকে আপনার বয়সের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বয়স্ক দেখাবে।

আর যদি আপনি ধূমপান না করেন তাহলে একদিকে যেমন ধূমপানের কারণে সৃষ্ট রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচবেন, অন্যদিকে ধূমপান থেকে বিরত থাকায় আপনি পাবেন উন্নত চেহারা। কারণ ধূমপান না করলে বা ছেড়ে দিলে আপনার দেহে রক্ত ​​প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, আপনার শরীর এবং ত্বক আরও বেশি পুষ্টি এবং অক্সিজেন গ্রহণ করার সুযোগ পায়,যা তরুণ দেখতে এবং সুস্থ থাকার জন্য অপরিহার্য।

৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস:
বলা হয়,স্বাস্থ্য এবং সুস্থ ত্বক ভেতর থেকে আসে। অনেকে বুঝতে পারে না যে খাদ্য তাদের চেহারাতে কীভাবে ভূমিকা পালন করছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস আপনাকে বয়স্ক দেখানোর জন্য দায়ী। একটি খারাপ ডায়েটে ফ্রাইড চিকেন, হট ডগ, পটেটো চিপস,ডোনাটস,বার্গার ও ফ্রাই,বেকন এবং সসেজ,মিল্কশেক, সোডা পপ,ক্যান্ডি, পিৎজা, ভাজা আচার ইত্যাদি থাকে।

আর একটি ভাল ডায়েটে চর্বিহীন মাংস,ফল, সবজি, বাদাম, ডিম, তোফু, দানাদার খাবার, জল, সেকা আলু,স্বাস্থ্যকর তেল (যেমন, জলপাই তেল), দই ইত্যাদি থাকে।
এমন নয় যে স্বাস্থ্যকর উপকারিতা দেখতে আমাদের সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে  হবে, কিন্তু সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন স্বাস্থ্যকর খাওয়া আপনার বয়স কত দেখাবে এবং আপনার বয়স কত তাড়াতাড়ি বা ধীরে ধীরে বাড়বে,এতে তা উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ কি?

কারণ হল অস্বাস্থ্যকর খাবারে থাকে স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি, সোডিয়াম, ট্রান্স ফ্যাট, নাইট্রাইসের মতো অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান। খারাপ খাদ্যাভ্যাসের খারাপ উপাদানগুলো শরীরে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে, এতে আপনার শরীরের কোষগুলো ভালো পুষ্টি পায় না। তাই খারাপ খাদ্যাভ্যাসের কারণে আপনাকে বয়সের তুলনায় বৃদ্ধ, রোগা দেখাতে পারে।

৪. অত্যধিক সূর্যের এক্সপোজারঃ 
কিছু পরিমাণে সূর্যের এক্সপোজার আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভাল কারণ এটি আপনার শরীরে ভিটামিন ডি এর মাত্রা ঠিক রাখার জন্য সর্বোত্তম উপায়। কিন্তু সূর্যের অত্যধিক এক্সপোজার ত্বকের জন্য ক্ষতিকর এবং অত্যধিক রোদ ত্বকের কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে ত্বকে বয়সের ছাপ দেখা দেয় এবং ত্বক কুঁচকে যায়, যা আপনাকে বয়স্ক দেখানোর জন্য দায়ী।

ইলাস্টিন নামক ত্বকের ফাইবারগুলি সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির দ্বারা  ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এই কারণেই সরাসরি সূর্যালোক থেকে অতিবেগুনী বিকিরণ ত্বকের ক্যান্সারের পাশাপাশি অকাল বার্ধক্যকেও ৮০% পর্যন্ত বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
সান ট্যানিং এর ফলে ত্বকের এপিডার্মিস কোষের ক্ষতি হতে পারে। ট্যানিংয়ের সময় ত্বকের মেলানিন বৃদ্ধি পায় আর ত্বকের রঙ পরিবর্তন মানেই ত্বকের ক্ষতি।

৫. পর্যাপ্ত পানি পান
একটি সচ্ছল জমিতে যদি খরা দেখা দেয় তাহলে কী হবে? এটি মরুভূমির মতো হয়ে যাবে, সবকিছু শুকিয়ে যাবে। সচ্ছল ঘাস, গাছ, পাতা সব শুকনো, ভঙ্গুর এবং রঙ পরিবর্তন হয়ে মরে যাবে। আমাদের শরীরের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটবে, যদি আমরা পর্যাপ্ত পানি পান না করি

শরীরের সব কাজ সঠিকভাবে করার জন্য পর্যাপ্ত পানি গ্রহণ প্রয়োজন। এটি শরীরের বিপাকীয় এবং রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের সিস্টেম, সমস্ত অঙ্গ, টিস্যু,কোষের কার্যকারিতা বজায় রাখে এবং শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখে।পানি সারা শরীরে পুষ্টি পরিবহনে সাহায্য করে, বর্জ্য বের করে দিতে এবং ত্বককে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

যদি ত্বক, কোষ, অঙ্গ এবং টিস্যু পর্যাপ্ত পরিমাণে হাইড্রেটেড না থাকে তবে সেগুলি শুকিয়ে যেতে শুরু করবে এবং নানা জটিলতা দেখা দিবে। তাই যখন আপনি পর্যাপ্ত পানি পান না করেন, তাখন অকাল বার্ধক্য ( বয়সের তুলনায় বেশি বয়স্ক দেখানো) হয়। ঘাম, হজম ও শ্বাস -প্রশ্বাসে পানি নষ্ট হয়। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করুন এবং এমন খাবার খান যাতে প্রচুর পানি থাকে।

তাহলে এখন মোটকথা হল সুস্থ এবং তারুণ্য দেখাতে আমাদের ভাল ডায়েট নির্বাচন করতে হবে, ধূমপান করা যাবে না, ব্যায়াম করতে হবে, প্রচুর পানি পান করতে হবে এবং সূর্যের অতিরিক্ত এক্সপোজার থেকে সর্তক থাকতে হবে। এছাড়াও পরিষ্কার, ব্রণমুক্ত ত্বক বেশি তারুণ্য দেখাতে সহায়ক। যদিও জেনেটিক্সের কিছু বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে, তা আমাদের অনুশীলন করার চেষ্টা করা উচিৎ কারণ অভ্যাসগুলো ভালো।

Exit mobile version