বিজ্ঞান ব্লগ

সায়েন্স ফিকশন যেভাবে দিয়েছিলো ভবিষ্যতের পূর্বাভাস!

সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান মূলত সাহিত্যের এমন এক শাখা যেখানে লেখক ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে নিজ কল্পনায় চিত্রিত করেন এবং তা লেখনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। বর্তমান সময়ে এটি সাহিত্য ও সিনেমা জগতের অন্যতম জনপ্রিয় একটি জনরা বা শাখা। কিন্তু কখনও কি কোনো লেখক ভেবেছেন, তার এই লেখাই হতে পারে ভবিষ্যতের পূর্বাভাস?

সায়েন্স ফিকশন নিয়ে করা প্রথম কাজ কোনটি?

অনেকের মতে, দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে সিরিয়ান লেখক ‘লুসিয়ান অব সামোসাটা‘ কর্তৃক লিখিত উপন্যাস ‘Verae Historiae (A True Story)‘ হলো প্রথম সায়েন্স ফিকসন সংশ্লিষ্ট সাহিত্যকর্ম। যদিও একটি অংশের দাবী ১৮১৮ সালে প্রকাশিত মেরি শেলির ‘Frankenstein‘ হলো প্রথম সার্থক সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস। তবে সায়েন্স ফিকশনের শুরু কীভাবে তা আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় নয়।

আজ আমরা আলোচনা করব এ পর্যন্ত প্রকাশিত হওয়া বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসে করা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত কিছু ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে। যেহেতু সায়েন্স ফিকশনে করা ভবিষ্যদ্বাণীসমূহ অনেকখানি অনুমান নির্ভর হয়, সেহেতু সেখানে দেখানো উন্নত প্রযুক্তির ধারণার সবটুকু অংশ আমরা বাস্তবে রূপান্তরিত হতে দেখিনা। তবে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার লেখকদের সেই লালিত স্বপ্নগুলোকে সত্য করে তোলে। চলুন জেনে নিই রসায়নের জগতে এই সায়েন্স ফিকশন থেকে আসা চমৎকার কিছু প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্পর্কে!

প্লাস্টিকখেকো ব্যাকটেরিয়া:

ডিসেম্বরের শীতল বাতাসের সাথে সমস্ত লন্ডন শহর জুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে পঁচা প্লাস্টিকের গন্ধ। গন্ধটি অনেকটা পঁচা মাংসের গন্ধের ন্যায়। সমস্ত শহর জুড়ে প্লাস্টিকের এই পঁচন, মানুষের মাঝে ত্রাসের সঞ্চার ঘটাচ্ছে। ধীরে ধীরে সবাই জানতে পারে, এ ঘটনার পেছনে দায়ী এক প্রকার জেনেটিক্যালি মডিফাইড ব্যাকটেরিয়া।

১৯৭২ সালের উপন্যাস ‘Mutant 59: The Plastic Eaters‘ এর কাহিনী মূলত এটিই নিয়ে। তবে ঐ সময় কাহিনীটি সাধারণ মানুষের কাছে বেশ অবিশ্বাস্য ছিল। কারণ প্লাস্টিকের আবিষ্কার হয়েছে মাত্র বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। এত কম সময়ে কোনো প্রাকৃতিক অণুজীব প্লাস্টিকের মতো বস্তু হজম করে ফেলবার ক্ষমতা অর্জন করে ফেলবে, তা অনেকের কাছে ছিলো আকাশ কুসুম কল্পনার মতো। তবে আমরা জানি, প্লাস্টিক মূলত এক ধরনের কৃত্রিম জৈব পলিমার। তাই কালের কোনো এক পর্যায়ে, কোনো এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার পক্ষে প্লাস্টিক হজম করে ফেলার ক্ষমতা অর্জন করা অসম্ভব কিছু নয়।

ভবিষ্যতের-পূর্বাভাস-science-fiction

অনেকটা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস সত্য হয়ে যাবার মতো, ঠিক এমনটাই হয়েছে ২০১৬ সালে, জাপানের একটি রিসাইক্লিং প্ল্যান্টে। বিজ্ঞানীরা সেখানে থাকা অণুজীবগুলো নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কিছু প্লাস্টিক খেকো ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পান। ব্যাকটেরিয়াগুলোর মধ্যে থাকা পাচক এনজাইমগুলো (পাচক এনজাইমগুলোই মূলত পলিমারগুলোকে ভেঙ্গে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে রূপান্তরিত করে) নিয়ে বিজ্ঞানীরা আরও গবেষণা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাদের মতে, পৃথিবীতে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণে এই এনজাইমগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

কৃত্রিম মাংস উৎপাদন:

১৮৯০ এর দিকে প্রকাশিত ‘Mizora‘ মেরি ব্র‍্যডলি লেনের লিখিত একটি ফেমিনিস্ট সায়েন্স ফিকশন। ফেমিনিস্ট কেন তা উপন্যাসের প্লটটা আলোচনা করলেই বুঝে যাবেন। উপন্যাসটিতে লেখক পৃথিবীতে থাকা এমন একটি রাজ্যের কথা উল্লেখ করেন যা সম্পূর্ণরূপে নারী নিয়ন্ত্রিত। রাজ্যটির নাম ‘মিজোরা’। সেখানে কোনো পুরুষ থাকতে পারেনা। মিজোরা রাজ্যের অন্যান্য বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হল তাদের উন্নত প্রযুক্তি। সেখানে কোনো গৃহপালিত পশু না থাকায় ওখানকার নারীরা কৃত্রিমভাবে নির্মিত মাংস উৎপন্ন করে এবং নিজেদের মাংসের চাহিদা মেটায়।

২০১৩ সালে মাস্ট্রিচ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এবং ফার্মাকোলজিস্ট মার্ক পোস্ট প্রথম কালচারড বিফ বার্গার প্যাটি তৈরি করেছিলেন, যার দাম  $300,000 এর বেশি। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় 2 বছর। ৫-ই আগস্ট ২০১৩-তে লন্ডনে লাইভ টেলিভিশনে, দর্শকদের সামনে ঐ বার্গারটি খেয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। কালচারড মাংস এবং প্রাকৃতিক মাংসের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো কালচারড মাংস ল্যাবে তৈরি। এক্ষেত্রে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট প্রাণীর কোষগুলোকে পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করে, মাংসে পরিণত করা হয়। ১৮৯০ এর কল্পবিজ্ঞানে তা একরকম কাল্পনিক ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হলেও, আজ তা বাস্তবতা।

পারমাণবিক বোমা:

এটি সম্ভবত এই আবিষ্কারগুলোর মাঝে সবচেয়ে বেশি শোনা একটি।

১৯১৪ সাল। সারাবিশ্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে চলেছে। এমন সময় এইচ.জি.ওয়েলস ‘The World Set Free‘ নামক একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। উপন্যাসটিতে তিনি ইউরেনিয়াম নির্মিত একটি বোমার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন যে, বোমাটি উড়োজাহাজ থেকে ফেলা হবে। শুনতে খুব পরিচিত পরিচিত লাগেনা?

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ১৯১৪ সালে এইচ.জি.ওয়েলস যে বোমাটির কথা সবাইকে একটি কাল্পনিক গল্প হিসেবে শুনাচ্ছিলেন, তার প্রায় তিন দশক পর সারা বিশ্ব সেটি বাস্তবে চিত্রায়িত হতে দেখতে পায়। আপনারা ইতোমধ্যে বুঝে গিয়েছেন যে, আমি পারমাণবিক বোমার কথা বলছি। এটি এমন এক বোমা যা ‘নিউক্লিয়ার ফিশন‘ বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে বিশাল আকারের বিস্ফোরন ঘটাতে সক্ষম। (নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ায় একটি বড় পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে দুই বা ততোধিক ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়)

লেখক যে কি পরিমাণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তা এ আলোচনা থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি।

 

তথ্যসূত্র: দ্যা কনভারসেশন, মিজোরা, ফ্যান্টাস্টিক ফিকশন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, বিবিসি

Exit mobile version