বিজ্ঞান ব্লগ

মোলার প্রেগনেন্সি: গর্ভধারণের ঝুঁকি ও আদ্যোপান্ত

প্রথমত, চলুন জেনে নেওয়া যাক “মোলার প্রেগনেন্সি” কি?

মোলার প্রেগনেন্সি (হাইডাটিডিফর্ম মোল) হলো এক প্রকার অস্বাভাবিক গর্ভাবস্থা যেখানে কোনো শিশুর অবয়ব সৃষ্টি হবার আদলে অনেকটা টিউমারের মত অবস্থার তৈরি হয়। অমরার অন্তর্গত ট্রোফোব্লাস্টের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির দরুন এ অবস্থার উৎপত্তি।
সাধারণত দুই ধরনের মোলার প্রেগনেন্সি রয়েছে। প্রথমটি হলো কমপ্লিট মোলার প্রেগনেন্সি, আর দ্বিতীয়টি হলো পার্শিয়াল মোলার প্রেগনেন্সি।  

কমপ্লিট মোলার প্রেগনেন্সিতে সাধারণত গর্ভাবস্থায় অমরার সকল টিস্যু বা কোষগুচ্ছই অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায় এবং তরলে ভরা সিস্টে রূপান্তরিত হয়। আর ভ্রূণে টিস্যু গঠনেরও কোনো পরিপূর্ণ নকশা থাকেনা। অন্যদিকে পার্শিয়াল মোলার প্রেগনেন্সিতে অমরার অল্পসংখ্যক টিস্যু স্বাভাবিক থাকতেও পারে। সেক্ষেত্রে একটি ভ্রূণও গঠিত হতে পারে, তবে ভ্রূণটি বেশিদিন স্থায়ী হয় না এবং সাধারণত প্রাক্কালেই গর্ভপাত হয়।

মোলার প্রেগনেন্সির ঝুঁকি অনেক। রোগটি হবার পর মায়ের গর্ভাবস্থায় যেকোনো গুরুতর জটিলতা থেকে শুরু করে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনাও অনেকাংশে থেকেই যায়। 

 

লক্ষণ:
গর্ভাবস্থায় মোলার প্রেগনেন্সিকে যেকোনো নরমাল প্রেগনেন্সির মতোই মনে হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগটি হলে বেশ কিছু নির্দিষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায়, যেমন-
• প্রথম ত্রৈমাসিকের সময় যোনিপথ দিয়ে বাদামী থেকে উজ্জ্বল লাল রক্তপাত হওয়া
• অতিরিক্ত বমিবমি ভাব এবং বমি হওয়া
আঙ্গুরের থোকার মত সিস্ট তৈরি
• কোমরে প্রচণ্ড ব্যাথা হওয়া

উক্ত লক্ষণগুলো গর্ভাবস্থায় প্রকাশ পেলে অবশ্যই অভিজ্ঞ কোনো ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এছাড়াও অন্যান্য লক্ষণের মধ্যে আরো রয়েছে-
• জরায়ুর দ্রুত বৃদ্ধি; স্বাভাবিক গর্ভাবস্থার তুলনায় জরায়ু অতিরিক্ত বড় হওয়া
• উচ্চ রক্তচাপ
প্রিক্ল্যাম্পসিয়া হওয়া (গর্ভধারণের ২০ সপ্তাহ পর প্রস্রাবের মাধ্যমে প্রোটিন নির্গত হওয়া)
• গর্ভাশয়ে সিস্ট
• অ্যানেমিয়া (রক্তাল্পতা)
• ওভার অ্যাক্টিভ থাইরয়েড (হাইপার থাইরয়েডিজম)

মোলার প্রেগনেন্সি হবার কারন:
মূলত গর্ভাশয়ে ডিম্বাণুর অস্বাভাবিকভাবে নিষিক্ত হবার কারণেই এটি ঘটে থাকে। প্রতিটি মানবকোষে সাধারণত ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম থাকে এবং প্রতিটি জোড়ার মধ্যে একটি ক্রোমোজোম বাবা এবং অন্যটি মা থেকে আসে।
কমপ্লিট মোলার প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে, একটি ডিম্বাণু দুটি শুক্রাণু কর্তৃক নিষিক্ত হয় এবং জিনগত সকল বৈশিষ্ট্য তখন শুধু বাবা থেকেই আসে। এই পরিস্থিতিতে মায়ের ডিম্বাণু থেকে আসা ক্রোমোজোমগুলো নষ্ট হয়ে যায় অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আর পিতা হতে আসা  ক্রোমোজোমগুলোর ডুপ্লিকেট তৈরি হতেই থাকে।

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!! 

প্রজাতি তে ইমিউন ও প্যারাসাইটিজম: সম্পর্ক যখন স্ত্রী ও পুরুষে

কোন কারাগার আটকে রাখতে পারেনি যাকে – ইয়োশিয়ে শিরাটোরী

শিয়ালকে কুকুরের মতোই পোষ মানানো সম্ভব! আসলেই কি তাই?

অন্যদিকে পার্শিয়াল মোলার প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে, মা থেকে আসা ক্রোমোজোমগুলো যদিও কমপ্লিট মোলার প্রেগনেন্সির মত নষ্ট হয়ে যায়না, কিন্তু ব্যাতিক্রম হিসেবে পিতা হতে এক্ষেত্রে দুই সেট ক্রোমোজোম আসে। ফলস্বরূপ ভ্রূণে ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকার বদৌলতে ক্রোমোজোম হয় ৬৯টি। সুতরাং একটি ডিম্বাণু দুটি শুক্রাণু কর্তৃক নিষিক্ত হলে মোলার প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বৃদ্ধি পায়।

রিস্ক ফ্যাক্টর:
পুরো বিশ্বে প্রায়ই প্রতি এক হাজারে একজনের মোলার প্রেগনেন্সি ধরা পড়ে। মোলার প্রেগনেন্সি হবার বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম হলো:
• গর্ভধারণের বয়স; সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের বেশি এবং ২০ বছরের কম কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে তার মোলার প্রেগনেন্সি হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
• পূর্বেও মোলার প্রেগনেন্সি হয়ে থাকলে; যদি কোনো মাতার পূর্বেও গর্ভাবস্থায় একবার এ ঘটনা ঘটে থাকে, তবে পুনরায় তিনি মোলার প্রেগনেন্সিতে আক্রান্ত হতে পারেন। উল্লেখ্য, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে একজনের মোলার প্রেগনেন্সি তে পুনরায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।

জটিলতা:

সাকশন ইভাকুয়েশন অর্থাৎ জরায়ু থেকে কেটে উক্ত সিস্ট খুব সন্তর্পনে বের করে আনতে হবে। কাটার ক্ষেত্রে একটু এদিক সেদিক হলেই জরায়ু ফুটো হয়ে যেতে পারে। এছাড়াও একটা দুটো আঙ্গুরের মতো সিস্টের কনা ছুটে গিয়ে ফুসফুসের রক্তনালী বন্ধ করে দিতে পারে; এ অবস্থাকে বলা হয় পালমোনারি অ্যাম্বোলিজম। এর ফলে পরবর্তীতে ভয়াবহ পরিস্থিতি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
ইভাকুয়েশনের মাধ্যমে মোলার প্রেগনেন্সি ঠিকমত প্রতিকার করার পর যদি ভুলেও গর্ভাশয়ে মোলার টিস্যুগুচ্ছ থেকে যায়, তবে তারা ঐ স্থানে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে পারে। এ ঘটনাকে বলা হয় পারসিসটেন্ট জেস্ট্যাশনাল ট্রফোব্লাস্টিক নিওপ্লাজিয়া(জিটিএন)। এটি কমপ্লিট মোলার প্রেগনেন্সিতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ এবং পার্শিয়াল মোলার প্রেগনেন্সিতে প্রায় ৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। পারসিসটেন্ট জিটিএন গর্ভাবস্থায় কাজ করা হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রপিন(এইচসিজি) হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় হাইডাটিডিফর্ম মোল জরায়ুর তিনটি প্রাচীরের মধ্যে দ্বিতীয়টির অনেক গভীরে প্রবেশ করে, যা যোনি রক্তপাতের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বর্তমানে পারসিসটেন্ট জিটিএন চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা সম্ভব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি দিয়েও এর প্রতিরোধ করা যায়। তবে জরায়ু অপসারণ (হিস্টেরেক্টমি) -এর মাধ্যমেও রোগটি থেকে পুরোপুরি বেঁচে আসা সম্ভব। কিন্তু এই পারসিসটেন্ট জিটিএন-এর সময়মতো চিকিৎসা করা না হলে গর্ভাশয়ে কোরিওকার্সিনোমা নামক ক্যান্সারের উদ্ভব ঘটতে পারে। যদিও কোরিওকার্সিনোমা ক্যান্সারের বিভিন্ন ওষুধের সাহায্যে সারিয়ে তোলা যায়। উল্লেখ্য যে, পার্শিয়াল মোলার প্রেগনেন্সির তুলনায় কমপ্লিট মোলার প্রেগনেন্সিতে এই জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

প্রতিরোধ:
মোলার প্রেগনেন্সির কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই অতিসত্বর ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পুনরায় কনসিভ করবার আগে ডাক্তার ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন। তবে গর্ভাবস্থায় কোনো ঝুঁকিই নেওয়া যাবে না। প্রতিনিয়তই আপডেট জানানোর মাধ্যমে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

তথ্যসূত্র: Mayo Clinic

Exit mobile version