বিজ্ঞান ব্লগ

A tale of Iron lungs: পোলিও, প্রযুক্তি, একাকিত্ব

চুপচাপ বসে আছি ছাদের রেলিং ধরে। এধরণের পজিশনে বসাটা আসলে বেশ বিপজ্জনক, কিন্তু আজ ইচ্ছা করছে বলেই। অন্তত জীবনের একটা দিনও নিজের ইচ্ছার মূল্য দিয়ে বাচাটা জরুরি।

বুক ভরে শ্বাস নিলাম। আমাদের বাসাটা ১৫ তলা উঁচু। অন্তত নিচের ধুলো ঢাকা বাতাস থেকে এই বাতাস অনেক অনেক বিশুদ্ধ। আশ্চর্য্য না, একটু আগ পর্যন্তও যে বাতাসে অক্সিজেন এর অনুপাত ছিল বেশি, কয়েক সেকেন্ড পরেই সেই জায়গা দখল করে নিলো ভারী কার্বন-ডাইঅক্সাইড! শ্বাস ছাড়া বা নেওয়া, পুরোটাই যে স্নায়ু আর মাংসপেশীর খেলা।

“তোমরা হয়তো খেয়াল করে থাকবে”, আমি পরিষ্কার শুনতে পাই, হেমন্তের কোন এক ক্লাস লেকচার… রোদ আছে, কিন্তু রোদ নেই এমন এক আবহাওয়ায় স্যার পড়িয়ে যাচ্ছেন, “শ্বাস নেওয়া বা inspiration এ দুই সেকেন্ড লাগে, কিন্তু শ্বাস ছাড়তেই লেগে যায় তিন সেকেন্ডের মত। কিন্তু কেন হয় এমন?” উত্তর টা অনুমানের যোগ্য, কিন্তু জ্ঞানপাপী সাজবো আমি এবার। “কারণ” স্যার এর দৃষ্টি একেবারে শেষের বেঞ্চ পর্যন্ত প্রসারিত, “শ্বাস নেওয়া একটা active process!”

কিন্তু Paul Alexander এর ভাগ্য এতটাও ভাল ছিল না। প্রশ্ন হল, এই ব্যক্তিটা কে, তার সাথে আমার ছাদে দাঁড়িয়ে শ্বাস ফেলারই বা কি সম্পর্ক?

তবে তা জানতে হলে, আমাদের কিছু জিনিস আগে জেনে নিতেই হবে, নাহলে গল্পটা না বলাই থেকে যাবে!

আমরা শ্বাস নেই, তার পেছনে হাত আছে আমাদের থোরাক্স এবং এ্যাবডোমিনাল অঞ্চলের কিছু মাসলের। একেবারে নরমাল শ্বাস নেওয়ার কথাই যদি বলি, এখানে কাজ করে,

কিন্ত যখন আমরা শ্বাস টানছি (Forceful inspiration) তখন এই কাজে যোগ দিচ্ছে চারটা পেশি, যাদের ভেতর আমরা পাচ্ছি

কথা হল, শ্বাস ছাড়া হল একটা প্যাসিভ প্রসেস, মাসল রিলাক্সেশন হলেই এটা সম্ভব। তবে সে কথা বলতে গেলে প্রসঙ্গ থেকেই দূরে চলে যাবো আমি।

Respiratory system and gaseous exchange

 

এবার আরেকটা টপিকের আলোচনা করি?

পোলিও (polio) এর নাম শুনেছেন হয়তো। ভাইরাসঘটিত এই রোগকে অনেক সময় poliomyelitis নামেও ডাকা হয়ে থাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার (মজার ব্যাপার শুনতে মজা লাগে না, দুঃখিত) এই রোগের কারণে দেখা দিতে পারে Flacid Paralysis, যা ঘটতে সময় নেয়, কয়েক ঘন্টা(!) থেকে কয়েক দিন। তবে প্রথমে প্রথমে বোঝাই যায় না, কেউ এমন একটি সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কারণ দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০% মানুষের ভেতর এই রোগ কোন লক্ষণই প্রকাশ করে না। বাকি ২৫% মানুষের ভেতর এমন কিছু লক্ষণ দেখা যাবে, হয়তো মনে হবে যে সে ফ্লু তে আক্রান্ত। তারা যে লক্ষণগুলো প্রকাশ করে সেগুলি হলঃ

আবার, দেখা যায় ৫% লোকের ভেতর,  neck stiffness, pains in the arms and legs এবং headache। এবং দেখা যাচ্ছে, ৩০% মানুষ, যারা মাইনর লক্ষণ নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল, তারা সুস্থও হয়ে যায় সময়ের সাথে সাথে। কিন্তু এর পরেই শুরু হয় আসল ভয়াবহতা, Post Polio Syndrome। কি হয় এই পোস্ট পোলিও সিনড্রোম এ? এসময় মাসল উইকনেস বা দূর্বলতা শুরু হয়, যারা বেঁচে গিয়েছিল মৃত্যুর হাত থেকে তাদের আস্তে আস্তে গ্রাস করে প্রতিবন্ধিত্ব।

আচ্ছা, এই রোগ কি সংক্রামক?

হ্যা, এই রোগ দারুণ সংক্রামক। মূলত fecal-oral (intestinal source) এবং oral-oral (oropharyngeal source) এই দুই ভাবে এই ভাইরাস আপনাকে সংক্রমিত করতে পারে। এতই সংক্রামক যে এই ভাইরাস একটি বিশাল জনগোষ্ঠীতে পেন্ডেমিক সিচুয়েশন তৈরি করতে পারে। আর এই সংক্রমণ এর হার তাপমাত্রা দিয়ে প্রভাবিত, মূলত গ্রীষ্ম এবং হেমন্তের দিকে সংক্রমণ এর হার বাড়ে। আর এই পোলিও তৈরি করেছিল ইতিহাস খ্যাত নিউইয়র্ক পোলিও এপিডেমিক

নিউইয়র্ক পোলিও এপিডেমিক এর কারণ এখনো অজানা, তবে ১৯১৬ প্রথম সরকারি ভাবে এই এপিডেমিক এর ঘোষণা দেওয়া হয়। এই এপিডেমিক প্রথম শুরু হয় ব্রুকলিন থেকে, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। জরুরি ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় ডক্টর সাইমন ব্ল্যাটিস কে, ফিল্ড ফোর্স সহ।

এবার আসি লোহার ফুসফুস এ, কিভাবেই কাজ করে এই ফুসফুস?

লৌহ ফুসফুস বা Iron lungs বা Drinker tank হল একরকম নেগেটিভ প্রেসার ভেন্টিলেটর। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই যন্ত্রের প্রধান কাজ হল শ্বাস প্রশ্বাসে সাহায্য করা। সাধারণত পোলিও কিংবা বটুলিজম এর ফলে মানুষের শ্বাস নেবার ক্ষমতা  কমে যায়, কারণ তার সহযোগী মাসলগুলি দূর্বল হয়ে পড়ে।

এই ব্লগটি পড়তে ভুলবেন না! 

ওয়াটার অ্যান্ড ডাস্ট রেজিস্ট্যান্সি: আইপি রেটিং

এই আয়রন লাংস হল (Iron lungs), বিশাল একটি সিলিন্ডার। এর একপাশে একটি খোলা মুখ থাকে যার মাধ্যমে মাথা উন্মুক্ত বাতাসে রাখা হয়। এই খোলা অংশটি ছাড়া বাকি সব অংশ সম্পূর্ণভাবে থাকে সিল করা, ভেতরে থাকে রোগীর দেহের অংশ। কিন্তু, পেশেন্ট শ্বাস নেবে কিভাবে? এজন্য ভেন্টের ভেতর কিছু বাতাস বের করে নেওয়া হয়, ভ্যাকুয়াম তৈরি করা হয় সিল করা কন্টেইনার এর ভেতর। এখন বাইরের বায়ুচাপের সাথে সামঞ্জস্য রাখার জন্য রোগীর নাক এবং মুখ হয়ে বাতাস ফুসফুসে ঢুকতে থাকে, এভাবেই সম্পন্ন হয় শ্বাস গ্রহণ। আবার যখন শ্বাস ছাড়ার সময় আসে, তখন কন্টেইনার এর প্রেসার সামান্য বাড়ানো হয়।

একজন নার্স কিংবা রেস্পাইরেটরি থেরাপিস্ট এর প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। যন্ত্রটি মোটর চালিত হতে পারে, এটি হতে পারে ম্যানুয়ালি (সেক্ষেত্রে কন্টেইনার এর শেষে একটি ডায়াফ্রাম লাগানো থাকে)।

১৬৬০ সালে বিজ্ঞানী মেও প্রথম এক্সটার্নাল নেগেটিভ প্রেসার এর সাহায্যে এমন শ্বাস নেবার ধারণা নিয়ে আসেন। তবে সর্বপ্রথম এই যন্ত্রের ব্যবহারিক রূপ তৈরি হয় 1928 by Drinker and Shaw of the United States। এই যন্ত্রের শক্তি আসতো দুটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার থেকে আসা মোটর এর মাধ্যমে, এবং বায়ুচাপ নিয়ন্ত্রিত হয় একটি ধাতব বাক্সের মাধ্যমে। এই যন্ত্রের প্রথম হাসপাতাল ব্যবহার হয় October 12, 1928 তে, নিউইয়র্ক পোলিও এপিডেমিক এর ১২ বছর পর। বোস্টন শিশু হাসপাতালে আট বছর বয়সী এক শিশু, পোলিও জনিত কারণে শ্বাসপ্রশ্বাস জটিলতায় ভুগছিল, যা তাকে নিয়ে গেছিল মৃত্যুর কাছাকাছি। কিন্তু এই যন্ত্র ব্যবহারের মাত্র এক মিনিটের মাথায় সে সুস্থতা লাভ করে, যা এই যন্ত্রের পপুলার হবার পেছনে অন্যতম কারণ। পরবর্তীতে এর আরো প্রকার আবিষ্কার হয়। আপনি যদি ১৯৪০ কি ১৯৫০ এর দশকে পোলিও হাসপাতালে যেতে পারতেন, তাহলে দেখতে পেতেন, bulbar polio and bulbospinal polio এর আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সার বেধে রাখা বিশাল সব আয়রন লাংস (Iron lungs)।

এবার শেষ যে ব্যক্তি এখনো এটি ব্যবহার করছেন তার কথায় আসি।

১৯৫২ সালের গরম কালটা অন্য সাধারণ গরম কালের মত ছিল না। ডালাস শহরতলিতে ২৫ দিন পর্যন্ত ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর মত তাপমাত্রা ছিল। সকল পাবলিক সুইমিংপুল, বার, মুভি থিয়েটার বন্ধ রাখা হয়েছিল, এমনকি চার্চও বন্ধ ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত গরম এর কারণ ছিল না, বরং সরকারি কর্মচারীরা রাস্তাঘাটে ডিডিটি ছড়াচ্ছিলেন। তারা জানতেন এটা কোন কাজ করবে না, কারণ এর আগে প্রমাণিত হয়েছে যে পোলিও মশার মাধ্যমে ছড়ায় না। তাও তাদের এটা করতে হচ্ছিলো, কারণ, অন্তত তাতে কিছু কাজ তো দেখানো যাবে! 

এরকম এক জুলাই মাসে, পল আলেক্সান্ডার মাঠের ভেতর ছুটোছুটি করছিলেন। কতই বা আর বয়স হবে তার? ছয় বছর ! কিন্তু তিনি জানতেন না তার শরীরেও বাসা বেধেছে সেই সময়ের দূরারোগ্য পোলিও রোগ। প্রথমে সামান্য সর্দিজ্বর থাকলেও পাঁচদিন পর অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে, যে চঞ্চল ছেলেটি পাঁচদিন আগেও খালি পায়ে সারা ঘর ঘুরে বেরিয়েছিল, সে বিছানায় শুয়ে হাত পা নাড়তে পারছে না, এমনকি কিছু গিলতে পারছে না। আতঙ্কিত পিতামাতা তাকে নিয়ে যান Parkland hospital এ, যেখানে ছিল পোলিও ডেডিকেটেড ওয়ার্ড, কিন্তু রোগীর চাপ সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছিলো ডাক্তারদের। ডাক্তার প্রথমবার তাকে দেখে রায় দেন, তাদের কিছুই করার নেই এই রোগীকে, বেচারা পল একা হল ঘরে অপেক্ষা করতে থাকে অনেক কষ্টে, মৃত্যুর জন্য। দ্বিতীয় আরেক ডাক্তার সহ্য করতে না পেরে আরেকটি চেষ্টা করতে উদ্যত হলেন, দ্রুততম সময়ে করা হল emergency tracheotomy। 

তিনদিন পর, পলের জ্ঞান যখন আসলো তখন তিনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন বিশাল এক আয়রণ লাংস এর ভেতর, যা নেগেটিভ প্রেসার দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখছিল। তার মুখের চারপাশে একটি ভিনাইল এর আবরণ ছিল, যাতে শ্বাসের সাথে পানি বের হয়ে নতুন করে পানিশূণ্যতা তৈরি না হয়। যখন সেই আবরণ সরানো হয়, তিনি যা দেখেন, As far as you can see, rows and rows of iron lungs. Full of children।

হাসপাতালে তার কোন বন্ধু ছিল কিনা, জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, “কার সাথেই বা করবো, কারণ আজ যার সাথে কথা বলি, কাল শুনি, সে মারা গেছে।” ডাক্তাররা তার পাশ দিয়ে গেলে মন্তব্য করতেন, তিনি নাকি বাঁচবেন না। দীর্ঘ ১৮ মাস এর যন্ত্রণা সহ্য করে তিনি সুস্থ হলেন ঠিকই, কিন্তু তার দেহ বন্দি হল লোহার ফুসফুসে। অন্য রোগীরা সুস্থ হলেও, তার সেই সক্ষমতা ছিল না, তার ডায়াফ্রাম কাজ করার মত শক্তিশালী ছিল না। ফলে এটা একরকম ঠিকই হয়ে গেছিলো যে, বাকি জীবনের পুরোটাই কাটাতে হবে এই যন্ত্রে, পরিণত হতে হবে এই যন্ত্রের ব্যবহারকারী শেষ মানুষে। 

থেমে থাকেননি তিনি। বরং পড়াশোনা শেষ করেন, একজন সফল আইনজীবীতে পরিণত হন এবং লোহার ফুসফুসে থাকা অবস্থাতেই তার হার মানা এই যাত্রা শেষ হয় ৭৪ বছর বয়সে। তার সম্পর্কে জানতে বিস্তারিত এই লিংকে! 

এত এত ভাবতে ভাবতে ছাদের একেবারে কিনারায় চলে এসেছি। কি ভাবছেন, সুইসাইড করবো?

না, সুইসাইড করা এত সহজ না, অনেক অনেক সাহস লাগে এসবে। 

Exit mobile version