বিজ্ঞান ব্লগ

লিপ ইয়ারের ইতিহাস, গণনা, বাংলা সনে লিপ ইয়ারের আবির্ভাব

দোস্ত তোর জন্মদিন কবে?
-২৯ ফেব্রুয়ারি।
-অহ…..কিহ? আহারে তোর বয়স তো ৪ বছর পরপর বাড়ে।

আমাদের অনেকেরই এমন কেউ না কেউ পরিচিত আছে, যার জন্মদিন কোনো এক লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষে। তাদের বলা হয় Leapling অথবা Leaper। কিন্তু, ৪ বছর পর পর আরেকটি দিন যোগ করার দরকারই বা কী? জন্মদিন না হলে তো এটা অন্য সব সাধারণ দিনের মতোই। আর প্রতি ৪ বছর পরপরই কী ফেব্রুয়ারী একটা অতিরিক্ত দিন পায়?

অধিবর্ষের উদ্দেশ্য হচ্ছে সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণনের সময়ের সঙ্গে আমাদের ব্যবহৃত ক্যালেন্ডারের সামঞ্জস্য রাখা। যেহেতু সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর আবর্তনের উপর ঋতু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন মহাজাগতিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি নির্ভরশীল তাই বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অধিবর্ষ গণনা করা না হলে ৪০ বছরে আমরা হারাবো ১০ দিন!

খৃষ্টপূর্ব ৪৫ সনে রোমান জেনারেল Julius Caesar রোমান ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার তৈরী করেন। এতে তিনি অধিবর্ষের হিসাব আনেন। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। অর্থাৎ বছরে ৩৬৫ দিন ধরা হলে আমরা প্রায় ৬ ঘন্টা অগ্রাহ্য করে ফেলি। ৪ বছরে যা ৬×৪=২৪ ঘন্টা বা ১ দিন। সহজ কথায় এই বাদ যাওয়া ১ দিনই অধিবর্ষে যোগ হয় এবং বছরটিতে হয় ৩৬৬ দিন। তাই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার এর মতে প্রতি ৪ বছর অন্তর অধিবর্ষ হিসাব করা হতো। তবে লক্ষণীয় যে এক্ষেত্রে পৃথিবীর সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণনের সময় ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা ধরা হলেও তা কিন্তু প্রকৃত সময় নয়! তাই জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে অধিবর্ষ গণনার সময় প্রতি বছরের জন্য অতিরিক্ত প্রায় ১১ মিনিট যোগ করা হচ্ছে। এই পার্থক্যের জন্য মূল ঋতু হতে প্রতি ৪০০ বছরে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির ব্যবধান ঘটতো প্রায় ৩ দিনের।
এই সমস্যার সমাধান হয় যখন ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি বা ইংরেজি ক্যালেন্ডারের উদ্ভব হয়। আন্তর্জাতিকভাবে এটিই সর্বোচ্চ সমাদৃত ক্যালেন্ডার। পোপ ত্রয়োদশ Gregory-র নামানুসারে এর নাম হয়। এই ক্যালেন্ডারের সূত্রানুযায়ী কোনো একটি বছর অধিবর্ষ হবার জন্য:

i. বছরটিকে ৪ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজিত হতে হবে।
ii. তবে বছরটি যদি ১০০ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজিত হয় তখন তা অধিবর্ষ হবে না। কিন্তু ৪০০ দ্বারা আবার নিঃশেষে বিভাজিত হলে তা অধিবর্ষ হবে।

‘ইনফিনিটি”-র আদ্যোপান্ত জানতে ক্লিক করো এখানে


উদাহরণস্বরূপ ২০০০ এবং ২৪০০ সাল অধিবর্ষ হওয়া সত্ত্বেও ১৭০০, ১৮০০ কিংবা ১৯০০ সালসমূহ অধিবর্ষ নয়।
সুতরাং জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে যেহেতু বছরটি ৪ দিয়ে নিঃশেষে বিভাজিত হলেই অধিবর্ষ হতো, যার ফলে কিছু অতিরিক্ত অধিবর্ষের সৃষ্টি হতো- সেই সমস্যার সমাধান এখানে পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি এভবে বোঝা যায়- যেহেতু আমরা ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড এর জায়গায় ৬ ঘন্টা হিসাব করি তাই আমরা কিছু অতিরিক্ত দিন গণনা করে ফেলি। গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারে শতাব্দী বছরগুলো (৪০০ দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য ব্যতীত) অধিবর্ষ না হবার কারণে এই অতিরিক্ত দিনগুলো বাদ যায়। আবার শতাব্দী বছরগুলো অধিবর্ষ হিসেবে না গণনার ফলে উল্টোদিক থেকে কিছুটা over-correct হয়ে যায় এবং কিছু সময় বাদ পড়ে যায়। এই সময়ের যোগফল হয় ১ দিনের কাছাকাছি তাই ৪০০ তম বছরকে অধিবর্ষ হিসেবে গণনা করে এই ত্রুটি দূর করা হয়।সুতরাং গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার এর মাধ্যমে আরো নিখুঁতভাবে দিন গণনা সম্ভবপর হয়।

এবার আসা যাক বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় অধিবর্ষ গণনার ক্ষেত্রে। শুরুতে বঙ্গাব্দতে অধিবর্ষের ধারণা ছিলনা। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নতুন বর্ষপঞ্জিতে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের অনুসারে ফেব্রুয়ারি মাসের সমসাময়িক বাংলা ফাল্গুন মাসে ৪ বছর পরপর অতিরিক্ত একটি দিন গণনা করা হয়। এভাবে দুই ক্যালেন্ডারের মাঝে সাদৃশ্য থাকে বিধায় প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল উদযাপিত হয়।

শেষ করার আগে বলা যাক, গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার অনেক নিখুঁত হলেও পুরোপুরি সঠিকও নয়। অন্যদিকে, পৃথিবীর ঘূর্ণন আবার বছরপ্রতি ০.০০৫ সে. কমছে। তাই, কোনো এক সময় পার্থক্যটা আবার বাড়তে থাকবে, তবে সেটা নিয়ে চিন্তা করবার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে। 

তথ্যসূত্র:
1. wikipedia.org
2. timeanddate.com
3. scienceabc.com
4. youtube.com
Exit mobile version