বিজ্ঞান ব্লগ

HIV এর দীর্ঘ যাত্রা : সৃষ্টি থেকে শুরু এর অজানা গল্প

শনিবার সকালে বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করছি,আর একই সাথে চলছে ফেসবুক স্ক্রলিং।প্রশ্নোত্তর গ্রুপগুলোতে ঢু মারছিলাম,কোন ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন এর অপেক্ষায়। হুট করে একটা জায়গায় চোখ আটকালো, প্রশ্নটা ছিল এমন,’’এইডস এর ভাইরাস HIV কি ভাবে মানুষের মধ্যে আসলো ?’’ অর্থাৎ আমরা জানি,বানর থেকে এসেছে এটা কিন্তু এর প্রথম ভিক্টিম কি করে আক্রান্ত হয়েছিল, এই ভাইরাসের যাত্রা কি তবে আমাদের ধারণার থেকেও লম্বা?

বিস্তর চিন্তা নিয়ে বের হয়ে গেলাম ঘর থেকে।মেডিকেলের উল্টোপাশের টংগুলিতে যাবার প্রশ্ন আসে না,কারন এরিক ভাই ছুটিতে বাইরে। বরং মিরাজকে ফোন করে রওয়ানা দিলাম আড্ডাখানা ‘কফিতা’ তে। মিরাজ দেখি সেখানেই বসা,দুটো বিড়াল কোলে নিয়ে। বিড়ালগুলো আসলে কফিতার আপুর,আসলে তারা পুরো দোকান জুড়ে ঘুরঘুর করে।

গিয়ে চেয়ার টানতে টানতে প্রশ্নটা করেই ফেললাম, “আচ্ছা ব্রো, HIV কি করে বানর থেকে মানুষে আসলো ?মানে কোন মানুষ কি বানর খেয়েছিল এমন কিছু ?’’

-না,বানর থেকে আসেনি। নতুন গবেষণা বলছে HIV আসলে শিম্পাঞ্জি থেকে।

বিড়ালের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কথাগুলো বলে মিরাজ। রীতিমত বোকা হয়ে গেলাম,একথা তো আমিই লিখেছিলাম। যাই হোক,আমিও গুছিয়ে বসলাম একগাদা আলোচনার জন্য।

-আমাকে প্রশ্ন করলে কিছু পারবো না এখন,আগে একটু পড়াশোনা করে নিতে হবে ।

মিরাজ বিড়ালগুলোকে ছেড়ে দিয়ে ফোন ঘাটতে বসলো। বুঝলাম,আগামী ত্রিশ মিনিট কোন আলোচনা হবে না। যখন মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে মাত্র তাকিয়েছি,দেখলাম মাশিয়াত ঢুকছে,দেখতে পেয়ে একগাল হেসে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।

-কি নিয়ে আলোচনা করছো তোমরা ?

-AIDS আর HIV নিয়ে, কিছু বলতে পারবে তুমি ?

-ওহ এই কথা। একটা কথা জানো,আজকে সকালে ভাইয়া আমাকে এটা নিয়ে আমাকে বলছিলেন ।দেখি তোমাদের জানাতে পারি  কিনা ।

কফির অর্ডার দিয়ে এসে বসলাম,সে চুলগুলো ঠিক করে ঘটনা বর্ণনা করতে বসলো। মিরাজও জয়েন করলো আমাদের সাথে ।

“HIV ভাইরাস প্রথমে জার্নালে আসে ১৯৮০ এর দশকে ।আর এর পর থেকেই আমাদের কাছে প্রচুর তথ্য আছে যেটা দিয়ে আমরা বর্ণনা করতে পারি ,আমাদের পেশেন্ট জিরো কিভাবে ইনফেক্টেড হল বা কি করে এই ভাইরাস কি করে সময়ের সাথে বিবর্তিত হল।”

 

“মানে বলতে চাচ্ছো,আমরা আজকে এই ভাইরাসের যে রূপ দেখছি আগে সেটা ছিল না ?’’,আমি এবার বেশ কৌতুহল বোধ করছি,অবশ্য কৌতুহলটা আগেও ছিল…এখন শুধুই বেড়েছে !!!

“তোমার লেখা কিন্তু আমিও পড়ি,তুমি বলেছিলে যে HIV শিম্পাঞ্জি থেকে এসেছে। আসলেই তাই ! তবে এর যাত্রাটা বেশ দীর্ঘ। না জানলে জানিয়ে রাখি, HIV কিন্তু  একরকম লেন্টিভাইরাস (Lentivirus) । অর্থাৎ, অন্য ভাইরাসের রিসেপ্টর সাইট যেমন শরীরের বিভিন্ন অংশের কোষ,যেমনঃ সর্দিকাশির রাইনোভাইরাস আক্রমণ করে নাকের মিউকাস সেলকে,তেমনি এই লেন্টিভাইরাস গ্রুপ আক্রমণ করে শরীরের ইমিউন সিস্টেম কে।”

-বুঝলাম, কিন্তু তারপর?

– এখন, বানর এবং শিম্পাঞ্জিদের ভেতর এক ধরণের ভাইরাস পাওয়া যায়, একে বলে Simian Immunodeficiency Virus বা  SIV, যা অনেকটা HIV এর মতন আচরণ করে অর্থাৎ বানর বা শিম্পাঞ্জির ইমিউন সিস্টেমকে আক্রমণ করে।

এবার মিরাজ প্রশ্ন করে ,”তাহলে তুমি HIV এর সাথে SIV কে কিভাবে মিলাবে ?”

-HIV এর দুটো ধরণ আছে,সেগুলো হল HIV-1 & HIV-2। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, HIV-1 সরাসরি সম্পর্কিত রয়েছে সেই  SIV এর স্ট্রেইন এর সাথে যেটা শিম্পাঞ্জিতে সংক্রমণ ঘটায়, একই সাথে Sooty Mangabey নামক একধরণের বানরের দেহে পাওয়া SIV এর স্ট্রেইন এর সাথে মিল পাওয়া গেছে  HIV-2  এর। গবেষকরা এই দুটি ভাইরাসের ভেতর দারুণ মিল খুজে পেয়েছেন,এত মিল আগে পাওয়া যায়নি ! তবে কাহিনী এখনো শেষ হয়নি।

“কিভাবে, কেমন ?”,আমার ঘোর তখনো কাটছে না। এমন সময় মিরাজ বলে উঠে ,”আচ্ছা ,তুমি রেস্ট নাও,ইতিহাস আমিই বলি “।

-১৯৯৯ সালে বিজ্ঞানীরা শিম্পাঞ্জির দেহে SIV এর একটা স্ট্রেইন খুজে পান,যেটা মানুষের দেহে পাওয়া HIV ভাইরাসের মতই ছিল।বিজ্ঞানীরা এই স্ট্রেইন এর নাম দেন SIVcpz । বিজ্ঞানীরা কয়েক ধাপে গবেষণাটা করছিলেন,তার একটা ধাপের ইতি টানেন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে,মানুষের দেহে পাওয়া HIV-1 আসলেই এসেছে শিম্পাঞ্জি থেকে।

কিন্তু তারা তখনো এটা খুজে পাননি কি করে এই ভাইরাস শিম্পাঞ্জিতেই বা আসলো, আবার কি করে বা এটা বাধা পেরিয়ে মানুষের মধ্যেই ছড়ালো! গবেষকরা এ পর্যায়ে তাদের কাজ শুরু করেন, কিভাবে এই SIVcpz এর উৎপত্তি হল,বা তার এই স্ট্রেইন এর জন্ম হল কি করে,কারন এর এই স্ট্রেইনটা অন্য জায়গায় পাননি।

শিম্পাঞ্জি সর্বভূক প্রাণি, এটা বিজ্ঞানীরা জানতেন। তারা এই স্বভাবটা কাজে লাগিয়ে তাদের কাজ এগুনো শুরু করলেন।তারা দেখলেন,যে শিম্পাঞ্জিরা SIVcpz দিয়ে আক্রান্ত,তারা দুটো বিশেষ প্রজাতির বানর শিকার করে খায়। এগুলো হল, Red-capped mangabey and Greater spot-nosed monkeys. মজার ব্যাপার হল,এই ছোট বানরগুলোর ভেতর SIV এর আরো দুটো স্ট্রেইন ছিল ।তো এই আলাদা দুই ভাইরাস,যুক্ত হয়ে তৈরি হল তৃতীয় ভাইরাস স্ট্রেইন (SIVcpz) ,যা মানুষকেও আক্রমণ করতে সক্ষম।

মাশিয়াত এবার কথা বলা শুরু করলো, “আমাদের একটা ব্যাপার ভুলে গেলে চলবে না যে, HIV এর কথা বললেই আমাদের ধরে নিতে হবে যে HIV-1 এর কথা বলা হচ্ছে।কারণ এর সেকেন্ড স্ট্রেইন এত বিরল যে ,খুব একটা দেখা যায় না।HIV-2 এসেছে SIVsmm স্ট্রেইন থেকে যা পাওয়া যায় Sooty mangabey monkey থেকে,আর এটা মানুষে এসেছে এই বানর এর মাংস খাবার মাধ্যমে।সেকেন্ড স্ট্রেইনটা তেমন সংক্রামকও নয়।“

মিরাজ আবার বলা শুরু করে,” বিজ্ঞানীদের মনে তখনো কোটি টাকার প্রশ্ন ,মানুষে এই রোগ কি করে এলো,আর কেই বা ছিল সেই পেশেন্ট জিরো ? তারা তখন সামনে নিয়ে আসেন হান্টার থিওরি, অর্থাৎ আক্রান্ত শিম্পাজি কে খাওয়া বা তার চামড়া ছিলার সময় কোনসময়ে পেশেন্ট জিরো এর রক্তের সংস্পর্শ এ আসে কন্টামিনেটেড রক্ত। পেশেন্ট জিরো এর ইমিউন সিস্টেম লড়াই করেছিল নতুন ভাইরাসের সাথে,কিন্তু HIV খুব দ্রুত খাপ খাইয়ে নেয় নতুন পরিস্থিতির সাথে এবং রোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

HIV স্ট্রেইন এর চারটা গ্রুপ আছে,সেগুলো হল M ,N,O,P আর এটা হান্টার থিওরিকে সমর্থন করে।কারণ চার গ্রুপের ভেতর জেনেটিকালি সামান্য পার্থক্য আছে ,আর এটা সম্ভব কারন প্রতিবার SIV হোস্টের দেহে প্রবেশ করলে কোন একভাবে খাপ খাইয়ে থাকার একটা উপায় বের করে নেয়। বর্তমানে M গ্রুপের ভাইরাস দিয়েই বেশি রোগ হয়।”

ততক্ষণে কফি চলে এসেছে,আমরা সবাই এক চুমুক খেয়েছিও। ক্যাফেইন আমাদের রক্ত দখল করেছে,শরীরে আলাদা একটা চনমনে ভাব কাজ করছে।

এবার মাশিয়াত তার কথা শুরু করে আবার,

-অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন বিজ্ঞানী নিনো ফারিয়া। তিনি  তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সময় বলেন যে, HIV এর মত RNA ভাইরাস খুব দ্রুত বিবর্তিত হতে পারে,মানুষের DNA থেকে ১ মিলিয়ন গুণ দ্রুত । মানে হল,এর আণবিক ঘড়ি আসলে খুব দ্রুত নিজেকে পরিবর্তন করে নিতে পারে। বিজ্ঞানী ফারিয়া এবং তার টিম HIV এর একটা ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করার জন্য আফ্রিকা থেকে ৮০০ টি স্যাম্পল সংগ্রহ করলেন। তারা অবাক হয়ে খেয়াল করলেন যে,তারা যে স্যাম্পল নিয়েছেন,সেই ভাইরাস দ্রুত পরিবর্তিত হলেও,এমন এক পুর্বপুরুষ ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য থেকে এসেছে  যার বয়স ১০০ বছরের বেশি নয়।

এগুলা পড়তে ভুলবেন না!!!

ডক্টর অরুণ কুমার বসাক স্যার এর সাথে একদিন

গণিতের রঙ্গমঞ্চে পাই “π” এর আবির্ভাব এর গল্প

 

জিন মিউটেশন যত দ্রুতই হোক না কেন তা একটা স্থিতিস্থাপক হারে হয়ে থাকে ,ফলে বিজ্ঞানীদের পক্ষে দুটো জিনোমের পার্থক্য বের করা সহজ হয় । এরপর বিজ্ঞানীরা আরো গবেষণা করে চলে আসেন কঙ্গো এর কিনসাসা শহরে,১৯২০ সালের দিকে এটি ছিল বেলজিয়ান কঙ্গো এর রাজধানী।জনপ্রিয় হওয়ার সুবাদে এখানে তরুণ জনগোষ্ঠী এবং যৌনকর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকে,সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে এই রোগ ছড়ানোর হার।“

“তার মানে বিজ্ঞানীরা জানেন কি করে আফ্রিকার বিশাল জনগোষ্ঠীতে HIV ছড়িয়ে পরে। আর ওয়েস্টার্ন দেশে তা ছড়ানোর আরো বড় গল্প আছে”,মিরাজ বলে,”তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরেকদিন !”

(চলবে)

Source:

1. https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://www.avert.org/professionals/history-hiv-aids/origin&ved=2ahUKEwiK78S3pfXsAhUjIbcAHSPWCe8QFjAAegQIAxAB&usg=AOvVaw0XZ_7kJmcepw6iR1UeGyvB

2. https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=https://www.theaidsinstitute.org/education/aids-101/where-did-hiv-come-0&ved=2ahUKEwiK78S3pfXsAhUjIbcAHSPWCe8QFjABegQIAhAB&usg=AOvVaw1fNiqymo_i1-xQOYPSklWF

3. https://www.google.com/url?sa=t&source=web&rct=j&url=http://www.bbc.com/earth/story/20151119-we-know-the-city-where-hiv-first-infected-a-human&ved=2ahUKEwiK78S3pfXsAhUjIbcAHSPWCe8QFjAIegQICxAB&usg=AOvVaw2FBQjn7YZUjzOA3ip5Xkpd

Exit mobile version