বিজ্ঞান ব্লগ

HIV ভাইরাসের যাত্রাঃ শেষ হয়েও হইলো না শেষ

মাশিয়াতের সামনে চুপচাপ বসে আছি। তার বাড়িতে নয়,চিরচেনা মিটিং প্লেস ‘কফিতা’ তে। মিরাজ অন্যবারের মত জয়েন করতে পারেনি, জানিনা, হয়তো বাড়িতে কাজ আছে কোন কিছু হয়তো।

যাই হোক, আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিলাম, মাশিয়াত প্রথম প্রশ্নটা করলো, “আচ্ছা,তুমি গত আলোচনায় বলেছিলে ‘হান্টার থিওরি ’ নিয়ে, কিন্তু অনেকটা বুঝিনি  এই থিওরি সম্পর্কে।”

নড়েচড়ে বসলাম। “হান্টার থিওরিকে বুশমিট প্র্যাকটিস থিওরিও বলা হয়ে থাকে। এটা হল  সবচেয়ে  সম্ভাব্য একটা পথ, যেটা দিয়ে ব্যাখা করা যায় কিভাবে SIV স্ট্রেইন মানব দেহে প্রবেশ করেছে। এই থিওরি মোতাবেক, আফ্রিকার অঞ্চলে বন্য জন্তুর মাংস সংগ্রহ বা পোচিং এর সময় কোন একজন শিকারী,রোগাক্রান্ত শিম্পাঞ্জি বা বানরের কামড়ের শিকার হয় কিংবা অন্য কোন উপায়ে দূষিত রক্তের সংস্পর্শে  আসে,এবং এরকম দীর্ঘ এক্সপোজার এর ফলে ইনফেকশন এর সূচনা হয়। এই থিওরিকে ইতিহাস সমর্থন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের থেকে সাব-সাহারান অঞ্চলে আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর উপর ইউরোপিয়ান লোকদের একটা চাপ ছিল,রিসোর্স সংগ্রহের। সবচেয়ে বড় কথা ,এই রিসোর্সের বেশির ভাগ আসত বন থেকে,আর আরেকটা কথা হল, এই আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর লোকেরা কৃষি বা গৃহপালিত পশুপালন টাইপের কাজে জড়িত ছিল না।তাদের খাদ্যেরও বেশিরভাগ অংশ আসতো বন্যপ্রাণি থেকে ।

সেরোলজিক্যাল সার্ভে করা তথ্য কিন্তু একই কথাই বলছে। এই সার্ভের ভিত ছিল যে, কন্টিনিউয়াস ব্লাড-টু-ব্লাড কানেকশন থাকার কারণে SIV এর স্ট্রেইনগুলো মানবদেহে এসেছে। এবং সার্ভেকারীরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সেন্ট্রাল আফ্রিকাতে SIV ইনফেকশন খুব সাধারণ একটা ঘটনা, উদাহরণস্বরূপ ক্যামেরুন এর ২.৩% মানুষের ভেতর পুরোনো বা নতুন SIV এন্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া যায় ,৭.৮% গ্রামে এবং এই গ্রামের ১৭.৮% মানুষের ভেতর। ”

মাশিয়াত এবার চশমাটা ঠেলে দিলো পেছনে, “তবে যে কিছু মানুষ  বলে যে, শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের যৌনসঙ্গমের ফলেই HIV এর আগমণ !?”

“ আসলে এক মার্কিন সিনেটর, স্ট্যাসি ক্যাম্পফিল্ড তার নাম, তিনি সর্বপ্রথম এই কনট্রোভার্সি তৈরি করেন। এবং প্রভাবশালী বলে, অনেকে তার কথা মেনেও নেন। কিন্তু আসল ঘটনা অন্য জায়গায় । সিনেটর আসলে জানতেন না, HIV এর পুর্বপুরুষ SIV এর  স্ট্রেইনগুলি যে বানরগুলি ধারণ করে, তাদের শিকার ছাড়া আর  কিছুই করা হয় না। আর SIV এর ইনফেকশন থেকে HIV এর রূপ নিতে, ভাইরাসটিকে অতি দ্রুত মলিকিউলার ক্লক মেকানিজম সম্পন্ন করতে হয়েছে। সরাসরি যৌনসঙ্গমের ধারণাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে প্রতিয়মান হয় এটি আবিষ্কারের পর। ”

বুঝলাম মাশিয়াত একটা জিনিস বুঝতে পারছে না, “আর মলিকিউলার ক্লক মেকানিজম একটা পদ্ধতি যা দিয়ে নির্ণয় করা হয় ,কোন জিনে কত হারে মিউটেসন সম্পন্ন হচ্ছে। হ্যা, মিউটেসন এর ফল ভাল হতে পারে,খারাপও হতে পারে। কিন্তু ভাইরাসের মিউটেসন হয় খুব দ্রুত,এবং বেশিরভাগই এর ভাল ছাড়া, খারাপ কিছু করে না। বরং যে ভাইরাসের মলিকিউলার ক্লক যত দ্রুত, সে পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে আরো দ্রুত সক্ষম হয়ে পড়ে এবং নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। যৌন সঙ্গসর্গে ছড়ানো, এই দ্রুত মলিকিউলার ক্লক মেকানিজমে ফল এবং মানুষের দেহেই হয়তো এই বৈশিষ্ট্যের জন্ম। আমাদের HIV ভাইরাসের ক্লক মেকানিজম কিন্তু অনেক ফাস্ট !”

“আচ্ছা,তবে HIV এর যাত্রাপথের ঘটনা বর্ণনা করো !!”, সে তাড়া দেয়।

হেলান দিয়ে বসে বর্ণনা শুরু করি, “ আমাদের ফিরতে হবে, আফ্রিকাতে। বিজ্ঞানীরা আগের নেওয়া সব স্যাম্পলের ভিত্তিতে HIV ভাইরাসের একটি ফ্যামিলি ট্রি তৈরি করেন। আর সেই সূত্র ধরে চলে যান, কিনসাসা, একসময় ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর রাজধানী। এই অঞ্চলটি একসময় বেলজিয়ামের উপনিবেশ ছিল, স্বভাবতই চোরাই পশুর অংশ এখানে বিক্রি হবে ! আবার রাজধানী হবার সুবাদে এখানে গড়ে উঠেছিল রাস্তাঘাট এবং রেলওয়ে, ফলে এখানে কাজ করতে আসতো দেশি, বিদেশি শ্রমিক, স্থানীয়  অনেকে হয়তো তখন SIV এর কিছু স্ট্রেইন দিয়ে আক্রান্ত। শ্রমিক আনাগোনা এবং পাল্লা দিয়ে তৈরি হওয়া পতিতালয় এই ভাইরাস এর অভিযোজনকে সুবিধা দিয়ে আজকের অবস্থায় আসতে সাহায্য করেছে। তবে বিশ্বে ছড়ানোর জন্য হাইতিয়ানরাই দায়ী বলা যায়। ”

-কিন্তু তারা কি দোষ করলো ?

“ সমস্যা হল, HIV-1 এর একটা সাবটাইপ HIV-1 (B) হাইতির লোকদের হয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্বে ছড়ানোর জন্য। তুমি জানো , এই সাবটাইপ B সবচেয়ে বেশি লোককে আক্রান্ত করেছে। ২০১৪ সালের হিসেব বলছে, বিশ্বের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ এই ভাইরাস ইনফেকসন এ আক্রান্ত !! হাইতিতে মহামারি শুরুর জন্যও এই ভাইরাস সাবটাইপ দায়ী। এসব ঘটনা ঘটে ১৯৬০ সালের দিকে।”

“তবে আমেরিকাতেই কি করে এই ভাইরাস আসলো?” , মাশিয়াতের প্রশ্ন থামছেই না।

“ লোকে বলে, আমেরিকাতে  নাকি ১৯৮০ সালের দিকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে, আসল কথা হল, ১৯৮০ সালের দিকে এই রোগের রিপোর্ট আসতে থাকে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা আরো গবেষণা করে দেখেন, এটি ১৯৬৯ সালের আশেপাশে কোন একটা সময়ে আমেরিকাতে প্রবেশ করে, হাইতি থেকে অবশ্যই । কিন্তু কিভাবে এলো তা এখনো অজানা।  ১৯৮১ সালে নিউইয়র্ক এবং ক্যালিফর্নিয়ার হোমোস্যাক্সুয়াল পুরুষদের ভেতর একটি অজানা রোগ এর প্রাদুর্ভাব ঘটে, যার ভেতর ছিল Kaposi’s Sarcoma এবং ফুসফুসের PCP নামে একটি অতি দূর্লভ ইনফেকশন।

কিন্তু কেউ জানতো না, কেন হোমোস্যাক্সুয়াল পুরুষদেরই এই রোগ কেন হচ্ছে, অন্য কারো কেন নয়? ডাক্তাররা একটা সিদ্ধান্তে আসেন যে, কোন ধরণের সংক্রামক রোগের লক্ষণ এটি। আমেরিকান সংস্কৃতিতে HTLV-III এবং হোমোস্যাক্সুয়াল পুরুষ যেন সমার্থক হয়ে গেলো। কিন্তু পরে, ১৯৮২ এর মাঝামাঝি সময়ে , বিজ্ঞানীরা আরো আবিষ্কার করেন এই রোগ শুধু হোমোস্যাক্সুয়াল পুরুষ নয়, দেখা যাচ্ছে  সেই সব জনগোষ্ঠীর ভেতর যারা হেরোইন বা সিরিঞ্জের মাধ্যমে নেওয়া লাগে এমন ধরণের মাদকে আসক্ত। এসব মাদকাসক্তরা সাধারণত একই সিরিঞ্জ ভাগাভাগি করতো।” 

এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! 

HIV এর দীর্ঘ যাত্রা : সৃষ্টি থেকে শুরু এর অজানা গল্প

৬টি অনলাইনে ছবি রাখার সফটওয়্যার : গুগল ফটো এর বিকল্প

ক্ষুদে বৃক্ষ প্রেমিক হতে আজকের বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু

-“ আচ্ছা, এই HTLV-III আবার কোথা থেকে এলো ?”

“ বলতে ভুলেই গেছিলাম, HTLV-III বা human T-cell lymphotropic virus / Human T-cell leukemia-lymphoma virus  হল HIV ভাইরাস, যদি ভাল করে বলি HIV-1 group M subtype B এর আমেরিকান নাম। অন্যদিকে ফ্রান্সের পাস্তুর ইন্সটিটিউট এ এই HIV কে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং নাম রাখা হয়  Lymphadenopathy-Associated Virus (or LAV) ।কিন্তু পরে ফ্রান্স এবং আমেরিকার গবেষণা এক করা হয়,দেখা যায়, দুটি ভাইরাসই এক। পরবর্তীতে ভাইরাসের নাম HIV রাখা হয় , HTLV নামটি অন্য ভাইরাস ফ্যামিলিকে দেওয়া হয়। আরো পরে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন, হোমোস্যাক্সুয়ালিটি নয়, যেকোন অনিরাপদ যৌন্ সংসর্গে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। এছাড়া রক্তের মাধ্যমে, এবং গর্ভের শিশুতে মায়ের দুধের মাধ্যমে ছড়ানো, এসবও ধীরে ধীরে আবিষ্কার হয়। কিন্তু তারা বেশি দেরি করে ফেলেছিলেন। কারণ ততদিনে এই ভাইরাস ছড়িয়ে যায় আমেরিকা থেকে সারা বিশ্বে ।”

মাশিয়াত বুঝে নিয়েছে আমার পক্ষে আর বলা সম্ভব নয়। কফিতার সাউন্ড বক্সে একটা অজানা মিউজিক বাজছে…আর আমি ভাবছি ,HIV ভাইরাসের সাথে মানুষের এই যুদ্ধের শেষ কোথায় ??    

  শেষ… 

Exit mobile version