বিজ্ঞান ব্লগ

এলএইচসি(LHC) ও হিগস বোসনের ইতিকথা

বিজ্ঞান চলে যুক্তি ও প্রমাণের কাধে চেপে। ঘড়ির কাঁটা মেপে, গণিতের হিসাব মিলিয়ে। হিসাবের হেরফের হলে প্রমাণ মিলবে না। আর প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞানের কানাকড়িও মূল্য নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে তাকালে হিসাবটা অনেক ক্ষেত্রে পাই টু পাই মিলে না। অনেক তত্ত্ব সময়ের আগেই জন্ম নেয়, আবার অনেক তত্ত্ব জন্মের পরেও পড়ে থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে। কখন কোন বিজ্ঞান রাজ্যের রাজকুমার এসে তাকে ‘অপ্রমাণিত’ নামের রাক্ষসের শিকল থেকে মুক্ত করবে। আবার অনেক তত্ত্ব যুক্তি-তর্ক প্রমাণের দায় মিটিয়েও পরে থাকে ইতিহাসের কানা-গলিতে। উদাহরণ ? ভুরি ভুরি মিলবে।
ইতিহাস তার হিসাব মেলাতে অক্ষম। নইলে নিউটন তার বিখ্যাত সমীকরণ আবিষ্কারের পরেও কেন ত্রিশ বছর লোকচক্ষুর আড়াল করে রাখবেন? কেন এডিংটন মানতে পারেননি বলে চন্দ্রশেখর লিমিট ৫০ বছর ঘুমিয়ে কাটাবে? অ্যারিস্টোটলের নির্বোধ বিরোধিতার কারণে কেন ১৫০০ বছর সূর্যকে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে হবে?
ইতিহাস কী পারবে এসবের হিসাব মিলাতে? সম্প্রতি বিজ্ঞানের এক বড় আবিষ্কারের পর আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে হিসাবের গড়মিলের ব্যাপারটা।
লেখকের এই ব্লগটি পড়তে ক্লিক করো এখানে
এলএইচসির সাইক্লোট্রনে বছর পাঁচেক আগে হিগস বোসনের সন্ধান মিলেছে- আশা করি এই তথ্য কারো অজানা নয়। এই আবিষ্কারের পথ ধরে যদি পেছনে ফিরে দেখা যায় তাহলে বেরিয়ে আসবে কালের গর্ভে গুমরে মরা অনেক অচেনা সত্য। আমারা নাহয় সেদিকে আজ নাই গেলাম। চলুন জেনে আসি এলএইচসি ও হিগস বোসন নিয়ে কিছু অজানা তথ্য। এলএইচসি(LHC) বা লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার হলো পৃথিবীর বৃহত্তম ও মানব নির্মিত সর্ববৃহৎ যন্ত্র। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কণা ত্বরক। ইউরোপের নিউক্লীয় বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সার্ন(CERN) এলএইচসি নির্মাণ প্রকল্পের উদ্যোক্তা। এছাড়া এই যন্ত্র নির্মানে কাজ করেছেন বিশ্বের প্রায় ১০০ টি দেশের ১০০০০-এর অধিক বিজ্ঞানী ও গবেষক।
যন্ত্র টি স্থাপন করা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের কাছাকাছি ফ্রান্স সীমান্তে। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১৭৫ মিটার গভীরে ২৭ কিলোমিটার ব্যাসের একটি সুড়ঙ্গের মাঝে যন্ত্র টি স্থাপন করা হয়েছে। যন্ত্রটি প্রায় নয় টেরা ইলেকট্রন ভোল্ট প্রোটন সমৃদ্ধ রশ্মির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ করতে সক্ষম। বর্তমানে কণা পদার্থবিজ্ঞানে প্রমিত মডেলগুলো সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য মডেল হিসেবে বিবেচিত। এলএইচসি নির্মানের মূল উদ্দেশ্যে এসব প্রমিত মডেলের সত্যতা ও সীমাবদ্ধতা যাচাই করা। এলএইচসি তে প্রাথমিকভাবে কণা রশ্মি চালনা করা হয় ৮ আগস্ট। আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ সেপ্টেম্বর পুরো এলএইচসি তে প্রোটন রশ্মি চালনা করা হয়। তাপমাত্রা নামিয়ে আনা হয় -২৭১.২৫° C এ।

২১ শে অক্টোবর প্রথম উচ্চশক্তির সংঘর্ষ ঘটানো হয়। এতো গেল এলএইচসি। এবার আসা যাক হিগস বোসন বা ঈশ্বর কণার প্রসঙ্গে। হিগস বোসন কণাই একমাত্র মৌলিক কণা যাকে বিজ্ঞানের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা যায়নি। এজন্য বিজ্ঞানীরা উঠেপড়ে লাগলেন হিগস বোসনের অস্তিত্ব খোঁজার জন্য। আর এলএইচসির উদ্দেশ্যই ছিল হিগস বোসন কণা খুজে বের করা। ২০১২ সালের ৪ জুলাই জেনেভায় এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এলএইচসির পক্ষ থেকে জানানো হলো হিগস বোসনের প্রাথমিক অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
তবে সেটা সন্দেহাতীতভাবে। আর এই সন্দেহের কফিনে এলএইচসির বিজ্ঞানীরা সর্বশেষ পেরেক ঠোকেন ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ ইতালির এক সম্মেলনে। সেখানে ঘোষণা করা হয় হিগস বোসনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এর আগেও অনেকগুলো হ্যাড্রন-সংঘর্ষক তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু এলএইচসি-র মত অন্য কোনোটিই এতো আলোচিত হয়নি। এর কারণ এলএইচসি’র উচ্চশক্তি। এর মধ্যকার সংঘর্ষের মাধ্যমে মহাবিষ্ফোরণের ঠিক পরের শর্তগুলো তৈরি করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। অবশ্য এক্ষেত্রে শর্তগুলো খুব ছোট মাপে কাজ করবে। কারণ যন্ত্রটিতে সংঘর্ষের পরের যে অবস্থা তৈরি করা হয় তা মাত্র কয়েক মিলি সেকেন্ড স্থায়ী হয়।
অতি সম্প্রতি সার্ন (CERN) ঘোষণা দিয়েছে যে তারা বর্তমান এলএইচসির চেয়ে ৬ গুণ বেশি ক্ষমতার ত্বরকের ডিজাইন সম্পন্ন করেছে। বৈজ্ঞানিক মহলে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে এই তথ্যটি। কারণ এর দ্বারা আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
বর্তমান এলএইচসি যেখানে ২৭ কিমি ব্যাসের সেখানে নতুনটি হবে ১০০ কিমি ব্যাসের। হিগস বোসনকে ডাকা হয় ঈশ্বর কণা নামে। এর ফলে অনেকে ধারণা করেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করাই এ গবেষণার আসল উদ্দেশ্য। আসল ব্যাপার কিন্তু এটা নয়। যখন হিগস বোসন খুঁজে বের করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ, তখন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিও লেডারম্যান তার বিজ্ঞান নিয়ে লেখা একটি রসরচনামূলক বইয়ের শিরোনামে হিগস বোসনকে উল্লেখ করেন ‘দ্য গডড্যাম পার্টিকেল ‘ বলে। উদ্দেশ্য ছিল একটু বাড়তি নাটকীয়তা সৃষ্টি করা।
কিন্তু তৈরি হলো স্থায়ী নাটকীয়তা। বইটির প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক কলম চালিয়ে ‘গডড্যাম’ থেকে ‘ড্যাম’ শব্দটা কেটে রেখে দিলেন ‘গড পার্টিকেল’। ব্যাস, এ থেকেই জন্ম হলো যত বিভ্রান্তির। এখন বিজ্ঞানীরা সবাইকে বুঝিয়েই কুল পাচ্ছেন না যে -তাদের কাজের সাথে ঈশ্বরানুসন্ধানের কোনোই যোগাযোগ নেই। যে সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে এলএইচসি দ্বারা – 
১. স্ট্রিং থিয়োরির ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন মডেল যে অতিরিক্ত মাত্রার ভবিষ্যৎবাণী করেছে তা আদৌ আছে কিনা কিংবা থাকলে আমরা কি তা আলাদা ভাবে নির্ণয় করতে পারি ?
 ২. তমোপদার্থের ( Dark Matter ) ধর্ম কি যার পরিমাণ মহাবিশ্বের মোট ভরের প্রায় ২৩% ? 
৩.তড়িচ্চৌম্বক বল, সবল নিউক্লীয় বল, এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল কি আসলে একই বলের বিভিন্ন প্রকাশ, যেমনটি মহা একীকরণ তত্ত্বে কল্পনা করা হয়েছে ? 
৪. কেন মহাকর্ষ অন্যান্য মৌলিক বলের তুলনায় অত্যন্ত দুর্বল ? 
৫. সাধারণ মডেলের বাইরে আর কি কোনও কোয়ার্ক মিশ্রণ (Quark Flavor Mixing ) আছে ? 
৬. কেন পদার্থ এবং প্রতি পদার্থের সিমেট্রির( Matter & Anti-Matter Symetry ) মাঝে গরমিল দেখা যায় ? 
৭. মহাবিশ্বের প্রারম্ভে কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাজমার ( Quark-Gluon Plasma ) ধর্ম কি রকম ছিল ?
Exit mobile version