বিজ্ঞান ব্লগ

অজানা জেনেটিক্স: ইউজেনিক্স,ডিজাইন শিশু,মানব ক্লোনিং

পর্ব ১

ডিএনএ, জিন, জিনোম ইত্যাদি আজকাল সবার কাছেই কম-বেশি পরিচিত । জীবদেহের বিকাশ ও তার বংশগতির সাথে জিনের সম্পর্কের ধারণাটি একেবারেই নতুন এবং জোহান গ্রেগর মেন্ডেলের বংশগতি সংক্রান্ত গবেষণার পর ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে। বিগত শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময়ে বংশগতির ধারক এবং বাহক হিসাবে ডিএনএ নামক জেনেটিক উপাদান আবিষ্কার জীববিজ্ঞানের জগতে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করে । আর সেই সময় থেকেই গবেষণার সাথে সাথে জিনের ধারণাটিও বিবর্তিত হতে থাকে।

জিন বলতে এখন পর্যন্ত আমরা বুঝি জীবদেহের কোন বৈশিষ্ট্য নির্ধারক সংকেত বহনকারী একক আণবিক উপাদান । উদাহরণ স্বরূপ, একজন মানুষ শ্বেতাঙ্গ হবে নাকি কৃষ্ণাঙ্গ হবে , তার চুল সোজা হবে নাকি কোঁকড়ানো হবে, কোনো গাছের ফুল গোলাপি হবে নাকি সাদা হবে , আপনার অনাগত সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এসব বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যই জিনের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় ।

 

বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে জিন হচ্ছে কিছু ডিএনএ বাহ আরএনএ এর সিকোয়েন্স যাহ জীবদেহে কোন কার্যকারী প্রোটিন, পেপটাইড বাহ আরএনএ উৎপাদনের জন্য সংকেত বহন করে। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে কখনো দুই বাহ ততোধিক জীন একত্রে একটি বিশেষ কাজ সম্পাদন করতে পারে ।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে ২০০০০ থেকে ২৫০০০ জিন থাকে। জিনোম নামে পরিচিত এই অংশটি সেলুলার স্তরে উপাদানগুলিকে প্রভাবিত করে ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যগুলি নির্ধারণ করে।
ক্রোমোজোম নামক প্রতিটি কোষে নিউক্লিয়াস স্ট্রাকচারে জিনগত তথ্য সঞ্চিত থাকে। এই তথ্যটি ডি–অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ আকারে বহন করে।

পর্ব ২.১
ইউজেনিক্স
ইউজেনিক্স ( উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানব সম্প্রদায় সৃষ্টী করণ) কথাটা শোনার সাথে সাথে হয়তো অনেকেই শিহরিত হন । অনেকের মানসপটে ভেসে উঠে হিটলার কতৃক চালিত হত্যাযজ্ঞ ।
যার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিখাঁদ আর্য জাতভুক্ত জার্মান জাতি ব্যতীত অন্য জাত ভুক্ত মানব সম্প্রদায় নির্মূল । যদিও মতবাদটি হিটলারের ক্ষমতারোহণের অনেক পূর্বেই মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় শুরু হয় ।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই ক্যালিফোর্নিয়া হয়ে উঠে ইউজেনিক্স মতবাদের কেন্দ্রবিন্দু । এইমতবাদের সমর্থকদের প্ররোচনায় আমেরিকার সাতাশটি অঙ্গরাজ্য ইউজেনিক্সকে আইনে পরিণত করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই ইউজেনিক্স’র চর্চাকারীরা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের প্রায় ৬০০০০ লোককে জোরপূর্বক বন্ধ্যাত্ববরণ করায়। এছাড়া হাজার হাজার লোকের বিয়ে করা ও বাচ্চা নেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ।

এই সময়ে বেলজিয়ামে, সুইডেন, ব্রাজিল, কানাডাসহ আরো কয়েকটি দেশে মতবাদটির চর্চা দেখা যায় । তৎকালীন অনেক দার্শনিক , একাডেমিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী এই মতবাদের পক্ষে কথাও বলেছেন । এমনকি মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত ইউজেনিক্স’র অনুরাগী হয়ে উঠে।
জাতিগত পরিশুদ্ধতার নামে দেওয়া এই বক্তব্য হাজার হাজার মানুষের ওপর নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠে । পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে সারাবিশ্বে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করে ইউজেনিক্সকে নিষিদ্ধ করা হয় ।

“জেনেটিক ইউজেনিক্স”

এই প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের উন্নতিসাধন ।অন্যভাবে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের জিন সম্ভারের কোন একটিকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’র সহায়তায় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পরিবর্তিত করে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য প্রদান করা যায় । জেনেটিক ইউজেনিসিস্টেদের ধারণা ,এর মাধ্যমে মানুষের বংশগত রোগের যেমনঃ হান্টিংটন, টে-সেক, হিমফিলিয়া,সিস্টিক ফিব্রুসিস ইত্যাদি রোগের জন্মের শুরুতেই নিরাময় করা সম্ভব ।


পর্ব ২.২
“ডিজাইন শিশু”
প্রজনন জেনেটিক্স

প্রজনন জেনেটিক্স মূলত প্রজনন ও জেনেটিক্সের সাথে সম্পর্কিত প্রযুক্তির সমন্বয়ে ধারণাকৃত একটি সম্ভাব্য প্রযুক্তিগত ধারা । যার মূল লক্ষ্য জনন নির্বাচন পদ্ধতির উন্মেষ ঘটানো । প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি এম সিলভার ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই ধারণাটির প্রবর্তন করেন । সমন্বিত এই প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হচ্ছে জেনেটিক স্ক্রিনিং’র মাধ্যমে ভ্রণের প্রাথমিক পর্যায়ে জিনের প্রকাশ বা নকশা নিরূপণ করে সম্ভাব্য সন্তানের ভবিষ্যৎ গুণাবলি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া । এই প্রক্রিয়ার সহায়তার পিতা-মাতা অনেকগুলা প্রাথমিক ভ্রূণের নির্দিষ্ট একটিকে জেনেটিক গুণাবলির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ সন্তান হিসেবে লালন করতে পারে ।

ইউজেনিক্স যেখানে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে উপযুক্ত লোকের বংশ বিস্তারে সহায়তা দান ও অনুপযুক্ত লোকের বংশবিস্তারে বাধা দান করে, সেখানে প্রজনন জেনেটিক্স উপযুক্ত ভ্রূণকে মানবসন্তান হিসেবে ধারণ করতে ইচ্ছুক পিতা-মাতাকে ঐচ্ছিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উটসাহ দান করে। এক্ষেত্রে আগ্রহী পিতা-মাতাকে অনেক জেনেটিক স্ক্রিনিং সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করতে হয় । মূলত দুটো প্রক্রিয়াতেই অভিন্ন উদ্দেশ্য বিদ্যমান। এই প্রক্রিয়ার সমালোচকদের মতে, সম্ভাব্য এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দুটো ভিন্ন ধারার মানবপ্রজাতির সৃষ্টি হবে।

যারা ভবিষ্যতে পরস্পর যৌন প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তারে করতে অক্ষম হবে । অনেকের মতে প্রজনন জেনেটিক্সের মাধ্যমে উচ্চ আইকিউসম্পন্ন প্রজন্ম সৃষ্টি করা সম্ভব । যদিও বংশগতভাবে বুদ্ধিমত্তার সঞ্চালন নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি, সম্প্রতি কয়েকশ আমেরিকান মেধাবী ছাত্রের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের প্রত্যেকের চার নম্বর ক্রোমোজোমে একটি বিশেষ জিন বিদ্যমান।

” ডিজাইন শিশু “
মানুষ কত কিছুই না ডিজাইন করে । পরিধেয় বস্ত্র থেকে শুরু করে ঘর-বাড়ি , বাগান, পার্ক, এমনকি বাহ্যিক অবয়বও। তাই বলে কী ডিজাইন শিশু !
শুনতে একটু অদ্ভুত মনে হলেও খুব শীঘ্রই তা হয়ে উঠতে পারে বাস্তবতা । খুব সহসাই আপনি চমকিত হতে পারেন ডিজাইন শিশু তৈরির কোনো চটকদার বিজ্ঞাপনে-
“আপনি কি সন্তান নিতে ইচ্ছুক ? আপনি কি চান আপনার সম্ভাব্য সন্তানটি হবে সুশ্রী , সুঠাম দেহের অধিকারী , বংশগত রোগমুক্ত ও উন্নত আইকিউর অধিকারী? আপনি কি চান আপনার পছন্দের লিঙ্গের সন্তান ? তাহলে দেরী না করে আজই চলে আসুন আমাদের ক্লিনিকে “।
ডিজাইন শিশু আসলে কি?

এটি এমন এক শিশু যার জেনেটিক নকশা কৃত্রিমভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং এর সাথে টেস্ট-টিউব বেবি প্রযুক্তির সমন্বয়ে ঘটানো হবে । গর্ভাস্থাপনপূর্ব জেনেটিক স্ক্রিনিং ইতোমধ্যেই এই ব্যবস্থাটিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে । তদুপরি, এখন আমাদের হাতে রুয়েছে মানব জিনোম সিকোয়েন্স। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, খুবই শীঘ্রই হয়তো এমন যন্ত্র আবিষ্কৃত হবে যার মাধ্যমে খুব সহজেই জানা যাবে যে কোনোকিছুর জিনোম সিকোয়েন্স।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জিব্রা ফিশের রং্যের জন্য দায়ী জিন এবং সেগুলার সাথে সম্পর্কিত মানব জিনসমূহ নিরূপণ করেছেন। অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা অধিকতর গবেষণার মাধ্যমে মানুষের শরীরের রং সুচারুভাবে নির্ধারণ করতে পারবেন , শুধু তাই নয় , চুলের রং, চোখের রং, দাতের বাহ্যিক রূপ কেমন হবে তাও পূর্বে থেকেই নির্ধারণ করা যাবে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে প্রত্যাশা করা হয়েছে, নব আবিষ্কৃত প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি ভ্রূণকোষে বিদ্যমান প্রতিটি ক্রোমোজোমের কয়েকশ জিনের রোগ সৃষ্টিকারী মিউটেশন নির্ণয় করা সম্ভব।

ইতোমধ্যে এমন একটি মাইক্রোচিপ আবিষ্কৃত হয়েছে যার মাধ্যমে ১৫০০’র মতো জেনেটিক বৈশিষ্ট্য একসাথে নিরূপণ করা যায় । এসব বৈশিষ্ট্যগুলো হলো হৃদরোগ থেকে শুরু করে স্থুলতা, আবহাওয়ার কারণে সাময়িক শারীরিক অস্বাভাবিকতা, চুল ও চোখের রং, উচ্চতা মদ ও নিকোটিনের প্রতি আসক্তি এবং ল্যাকটোজ পরিপাকে ত্রুটি ।

ডিজাইন শিশুর ধারণাটি উন্নত ও অভিষ্ট সন্তানের অভিপ্রায়ে ভবিষ্যতের জন্য কল্পিত একটি সম্ভাব্য প্রযুক্তি । কিন্তু এই প্রযুক্তির মানবিক ও নৈতিক দিক নিয়ে বির্তকের উদ্রেক হয়েছে । প্রথম যেই প্রক্রিয়ায় বা প্রযুক্তির মাধ্যমে ভ্রূনের জেনেটিক নকশা নির্বাচন করা হবে তার নৈতিক দিক ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।


পর্ব ৩
ক্লোনিং

ক্লোনিং বলতে সাধারণত অনুরূপভাবে যেকোনো কিছুর অনুলিপি তৈরি করাকে বোঝায় । বায়োটেকনোলজির বা জীবপ্রযুক্তির ভাষায় ক্লোনিং হচ্ছে একটি বিশেষ প্রক্রিয়া , যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো রকম যৌন প্রক্রিয়া ব্যতীত জেনেটিক্যালি সদৃশ বিশেষ কোষ, অঙ্গ , ব্যাকটেরিয়া , উদ্ভিদ অথবা প্রাণী তৈরি করা । আর জেনেটিক্স বাহ মলিকিউলার বায়োলজির ভাষায় ক্লোনিং হচ্ছে কোনো একটি নির্দিষ্ট জিন অথবা জেনেটিক অংশকে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধিক সংখ্যায় বর্ধিত করা । এই পর্বে ক্লোনিং বলতে আমরা কেবল জেনেটিক্যালি একই রকম কোন বিশেষ কোষ , অঙ্গ , ব্যাকটেরিয়া , উদ্ভিদ অথবা প্রাণী বহু সংখ্যায় তৈরি করাই বুঝাবো ।

ক্লোনিং নিয়ে অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে । তাদের বিশ্বাস, ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে দেখতে হুবহু একই রকম কোন প্রাণী তৈরি করা সম্ভব। তাই অনেকে এটাও ভাবেন, এই প্রযুক্তির সহায়তার বুঝি সত্যি সত্যি আরেকজন আইনস্টাইন বা নিউটন বানিয়ে ফেলা সম্ভব । কিন্তু সবসময় এটি সত্যি হবে এমনটি ভাবা ঠিক নয় । কারণ কোনো জীবের জিনের বাহ্যিক প্রকাশ নিজ জিনের বহির্ভূত অনেক উপাদানের ওপর নির্ভরশীল ।

 

এগুলো পড়েছেন ?

এছাড়াও উদ্ভিদ অথবা প্রাণীর ক্রমবিকাশ , মন ও মানসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি তার চারপাশে বিদ্যমান পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ার ফলেই তৈরি হয় । তাছাড়া জিনগত পরিবর্তন বা মিউটেশন পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল একটি সর্বদা বিরাজমান প্রক্রিয়া । এর ফলে যেকোনো সময় যেকোনো জিনের একটি পরিবর্তন ফলে বাহ্যিক অবস্থার বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন সৃষ্টি হতে পারে ।

সহজ কথায় একটি উদাহরণ দেওয়া যাক । ধরুন, আপনি আপনার একটি ক্লোন বানাতে ইচ্ছুক । যদি পুরো প্রক্রিয়াটি সফল হয় তাহলে আপনার ক্লোনটি আপনার মতো পুরুষ অথবা নারী হয়েই জন্মাবে এবং একটি নির্দিষ্ট বয়সে আপনিও আপনার ক্লোন দেখতে অনেকটাই একইরকম হবেন। আর আপনার ডিএনএ এবং আপনার থেকে সৃষ্ট ক্লোনের ডিএনএ ও দেখতে হবে অবিকল একই ।

যেহেতু আপনিও আপনার ক্লোন একই মায়ের জরায়ুতে বড় হয়ে ওঠেন নাই এবং দুইজন মায়ের গর্ভকালীন খাদ্যাভাসের ও শরীরবৃত্তীয় কার্যাবলি সম্পূর্ণ আলাদা, তাই দুজনের মধ্যে বাহ্যিকভাবে কর্মকুশলতাও হবে সম্পূর্ণ আলাদা । সুতরাং আমরা খুব সহজেই একটি অনুসিদ্ধান্তে আসতে পারি এই বলে যে ,জন্ম যদিও দুজনের একই ডিএনএ’র সমন্বয়ে, তথ্যাপি আপনার ও তার ক্রমবিকাশ ও মৃত্যু হবে অবধারিতভাবে দুটো ভিন্ন পথে । উল্লেখ্য, এই প্রক্রিয়ায় জন্ম নেওয়া শিশুর নিউক্লিয়ার ডিএনএ দেখতে হুবহু পিতার মতো হলেও মাইটোকন্ড্রিয়ার ডিএনএ মায়ের কাছ থেকেই আসে ।


মানব ক্লোনিং
মানব ক্লোনিং হচ্ছে অনুরূপ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আরেকজন মানুষ তৈরী করা । অন্য কথায় কৃত্রিমভাবে মানুষ তৈরির নামই মানব ক্লোনিং। এই প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগে মারা যাওয়া কোন মানুষের ডিএনএ ব্যবহার করে তারই অনুরূপ আরেকজন মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব। আর একইরকম জমজ সন্তান হচ্ছে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট মানব ক্লোন , যার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানী মহলে তিন ধরণের মানব ক্লোনিং বেশি আলোচনায় এসেছে ।

প্রজনন ক্লোনিং

প্রজনন ক্লোনিং হচ্ছে সম্পূর্ণরূপ নতুন ক্লোন মানব তৈরি করার পদ্ধতি । এই ব্যবস্থাটি বেশ সমালোচনার সৃষ্টি করেছে । বেশির ভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় গোষ্ঠী ও বৈজ্ঞানিক সংস্থা এ পদ্ধতির বিরোধিতায় সক্রিয়। অনেক মহল আইন করে মানব প্রজনন ক্লোনিং বন্ধের পক্ষপাতী । নিরাপত্তাসহ বেশ কিছু ইস্যুর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এই পদ্ধতি বন্ধের সুপারিশ করেছেন AAAS । অঙ্গ প্রতিস্থাপনের নিমিত্তে বাণিজ্যিকভাবে ক্লোন মানুষ তৈরী করে তা বিক্রি অথবা দান করার ব্যাপারে সাংঘাতিক নৈতিক ও মানবিক বির্পযয়ের আশঙ্কার কথা উচ্চারিত হয়েছে । এসব সমালোচনা এড়ানোর জন্য অনেকেই আলাদা করে কেবল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উৎপাদনের পরামর্শ দিচ্ছেন এবং এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নে বিজ্ঞানীরা অনেকদূর এগিয়েছেন ।

 

এগুলো পড়েছেন ?
উপরন্ত মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্যকোনো প্রাণির ভেতর ক্লোন করে সেটা মানুষের কাজে ব্যবহার করা যায় কিনা তা যাচাই করে দেখছেন তারা ।

থেরাপিউটিক ক্লোনিং বা রিসার্চ ক্লোনিংচিকিৎসার উদ্দেশ্যে স্টেমসেল তৈরির কাজে এই পদ্ধতি ব্যাপৃত। যেহেতু চিকিৎসাক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটির অপার সম্ভাবনা রয়েছে । তাই এটি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলেছে । এই প্রযুক্তির পক্ষ অবলম্বন করে AAAS সহায়তার সুপারিশ করেছে । এই পদ্ধতিটির মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিরাট বিপ্লবের সূচনা হবে বলে অনেকে আশা করেছে ।

প্রতিস্থাপন ক্লোনিং
এই প্রক্রিয়াটি এখন পর্যন্ত তাত্ত্বিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ । এটি মুলত উপরোক্ত উভয় পদ্ধতির সমন্বিত একটি ধারণা। ধারণা করা হচ্ছে এই পদ্ধতির মাধ্যমে মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শরীরের কোনো অংশকে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব । এছাড়া এই প্রক্রিয়ার সাথে ব্রেইনের কিছু অংশের প্রতিস্থাপনও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।
 

মানব ক্লোনিং কতদূর

এবার দেখা যাক মানব ক্লোনিং’র অগ্রগতির কতটুকু । ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর রেলিয়ান নামক একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী কতৃক প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ড. ব্রিজিত বোইসেলিয়ার পৃথিবীর ১ম ক্লোন মানব শিশু জন্মের ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড থেকে। এই ঘোষণা দেওয়া হলেও ক্লোন শিশুর জন্ম কোথায় হয়েছে তা বলা হয় নাই , যতদূর জানা যায় ক্লোন শিশুটির জন্ম হয়েছে আমেরিকার বাইরে তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে , যেখানে মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ হয়নি এখনো । পৃথিবীর ১ম ক্লোন মানবকন্যার নাম রাখা হয় ইভ

এরপর দক্ষিন কোরিয়ার বিজ্ঞানী হুয়াং উৎসুক ২০০৪ সালে মানব ভ্রূণকোষ ক্লোনের ঘোষণা দিয়ে সারাবিশ্বের রীতিমতো হইচই ফেলে দেন । যা পরবর্তীতে সময়ে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে । ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেমাজেন ইনকর্পোরেশন নামে একটি বায়োটেক কোম্পানিতে কর্মরত ড. স্যামুয়েল উড ও এন্ড্রু ফ্রেঞ্চ ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পাচটি সক্রিয় মানব ভ্রূণ তৈরির সফলতার কথা ঘোষণা দেন ।

এই প্রক্রিয়ায় বয়স্ক মানুষের ত্বকের কোষ হতে ডিএনএ সংগ্রহ করে তা অন্য একজনের ডিম্বাণুতে প্রবিষ্ট করানো হয় । যদিও এটা পরিষ্কার নয় যে , উৎপন্ন ভ্রূণগুলো পরবর্তী পর্যায়ে বিকাশে সক্ষম ছিল কি না। আইনগত কারণে পরে সব ভ্রূণকেই ধ্বংস করে ফেলা হয় ।এখন অধিকাংশ দেশেই মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে । তবুও ২০০১ সালে জাতিসংঘ ১ম রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং বিরুদ্ধে আইন পাশ করেন ।

Exit mobile version